সময় ভ্রমণ(দার্জিলিঙঃ পাহাড় ও সমতলের গল্পগাছা)। সৌমিত্র ঘোষ

পেশক বা পাশোকের কথা হচ্ছিল। পুরোনো বনের জায়গায় এখন সেগুনবাগান, অন্য গাছ একটাও নেই। এক বর্ষাকালটা ছাড়া বাকি সময়টা পেশকে ইদানীং রঙও ধরে না সেরকম। বৃষ্টির জল পেলে সেগুনপাতা জ্যান্ত হয়ে ওঠে নীচের জমিতে এক-আধটা ঘাস গজায়, কিছু মাটিছোঁয়া লতাগুল্ম, কিছু ছোটো গাছ। বৃষ্টি না থাকলে সবটা শুকনো, বিবর্ণ, ন্যাড়া।
সেগুন গাছ মাটি থেকে এত জল টানে যে অন্য উদ্ভিদ সেগুনবাগানে জন্মাতে পারে না। পেশকের প্রথম চড়াই শেষ করলে পেশক চা বাগান, গ্রাম। ওই জায়গাটায় একটা টিলার ওপরে পেশকের পুরোনো বাংলোটা ছিল। পারিলিং থেকে কালিম্পঙ, সিকিম, তিব্বত যেদিকেই যাওয়া হোক, পেশক বাংলোটা যাত্রাবিরতির পছন্দসই জায়গা ছিল। ফিকে সবুজ কাঠের পুরোনো বাড়িটাকে আমিও দেখেছি, স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। অথবা দেখিনি।

কিংবা চোখ দিয়ে না হলেও মন দিয়ে দেখেছি। কোথায় চোখের দেখা শেষ আর মনের দেখা শুরু, কে বলতে পারে!

পেশকের বন বা বাংলো কিছুই এখন নেই। বন কাটা হয়ে গেছে কোনকালে, বাংলোটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রথম গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সময়। অথচ দিব্যি দেখতে পাই, টিলার ওপরে পেশকের সবুজ কাঠের বাংলো, তার সামনের ঘন বনের মধ্য দিয়ে সরু পাকদণ্ডী তিস্তায় পৌঁছেছে। সেই পাকদণ্ডী দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একের পর এক মাল বোঝাই খচ্ছরের সারি, ভুটিয়া-নেপালি-শেরপা কুলির দল, মালের বোঝায় ঝুঁকে পড়া। তার পিছনে কি সামনে ঘোড়ায় চেপে সাহেবদের দল, অভিযাত্রী, রাজপুরুষ, সৈন্য, পবর্তারোহী। কে নেই সেখানে! জোসেফ ডাল্টন হুকার, যিনি প্রথম দার্জিলিং আর সিকিমের গাছপালার দীর্ঘ তালিকা বানিয়েছিলেন; এল এ ওয়াভেল, যিনি পায়ে হেঁটে সিকিম ও দার্জিলিং হিমালয়ের প্রায় সবকটা উঁচু পাহাড়ে ঘুরেছিলেন, লামাইজম বা তিব্বতি মহাযান বৌদ্ধধর্ম নিয়ে প্রামাণ্য বই লিখেছিলেন, বারবার মনে করিয়েছিলেন এলাকার পুরোনো লোকজন, গাছপালা, জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রাখার কথা। 

পেশক থেকে পথ উঠে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ওঠার সময় ডানদিকের ঢাল নেমে যাচ্ছে। রংগীতে, বাঁদিকের ঢাল তিস্তায়। চা এবং দুধ পুড়িয়ে তৈরি করা ছোটো ছোটো গোল গোল প্যাঁড়ার জন্য বিখ্যাত লগড় চা বাগান ছাড়িয়ে আরো খানিক চড়াই উঠলে একলা নিঃঝুম লামাহাটা, যেখানে এখন পর্যটনের ঢল, ফলে রাস্তার পাশের বাড়িগুলো বড় এবং পাকা, বড় বড় পাইন গাছের গুঁড়ি নীল সাদা, গুঁড়ি ঘিরে বাঁধানো সিমেন্টের বেদী, এখানে ওখানে বাচ্চাদের খেলা করবার ও বড়োদের ছবি তুলবার মতো রঙে স্লিপ, বেঞ্চি, এটা সেটা। 

এই রঙিন নতুন লামাহাটা তৈরি হবার আগে পুরোনো লামাহাটা ছিল সত্যিকারের মেঘের দেশ। ওই পথ দিয়ে যেতে আসতে কতবার যে দেখেছি পাইনগাছের গুঁড়িতে গুঁড়িতে লতিয়ে উঠছে পুরু সাদা মেঘ, এত ঘন যে গাছের মাথা দেখা যায় না। পাইনবনের পাশে সেই মেঘের বাগানে লম্বালম্বি টাঙানো আছে রঙিন বৌদ্ধ প্রার্থনা পতাকার সারি, লাল নীল হলুদ সবুজ, সে পতাকায় লেখা 'ওম মণিপদ্মে হুম'। 

সময় ভ্রমণ
দার্জিলিঙঃ পাহাড় ও সমতলের গল্পগাছা
..............................
সৌমিত্র ঘোষ

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

অলংকরণঃ শুভশ্রী দাস, অদ্বয় দত্ত

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।