সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

📕সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম📕
মিহির সেনগুপ্ত
----------------------
বাংলা ভাষায় সবথেকে আন্ডাররেটেড ক্লাসিক কিছু থেকে থাকে, তার ওপরের দিকেই থাকবে এই বইটি। দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নস্টালজিয়াক্লিষ্ট মানুষের থেকে মিহির সেনগুপ্তের অবস্থান বহু যোজন দূরে। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বরিশালের একদম প্রত্যন্ত চাষী-জেলে সহ নিম্নবর্গের মানুষের বিচার কেমন? 
তাই মিহির সেনগুপ্তের আনন্দ পুরস্কার-প্রাপ্তির বক্তৃতা থেকে তাঁর দেশবোধ সংক্রান্ত একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলানো মুশকিল।--
"দেশ ছাড়ার দীর্ঘদিন বাদে যখন শরতের কাকভোরে সীমান্ত পেরিয়ে বেনাপোলে ঢুকব, সেদিন নো-ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল, সেটা যেন একটা বিরাট হাঁ-মুখ ফাটল, যেখানে আমার দেশ নামক বোধটা চিরকালের মতো তলিয়ে গেছে তার দু-পাশের দুটো অথবা পরবর্তীকালে তিনটি নির্বোধ, হৃদয়হীন, চৈতন্যহীন রাষ্ট্রকে দেখে। তার কোনোটিতেই আমার দেশবোধ বা অস্মিতার চিহ্নমাত্র নেই। কেউ যেন আর কোনোদিন জিজ্ঞাসা করবে না, তোমার দেশ কোথায়? ভদ্রাসন কোথায় ছিল তোমার? আমাকেও আর কষ্ট করে উত্তর খুঁজতে হবে না। কারণ এতদিনে তো জেনেই গেছি, দেশ বলে সত্যিই কিছু আর নেই।"

📕📕📕📕📕📕📕📕📕
বইখানা থেকে দুটি ছোটো ছোটো অংশ তুলে দেওয়া যাক। এই দুটি অংশ আমার খুব প্রিয়।

📖📖📖📖📖📖
"সব মানুষের থাকে বোধহয় এক সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। ঋতুকালের কোনো এক নির্দিষ্ট আবর্তে সেই মোকামের কথা তাঁর স্মরণ হয়। কেউ তা বোধ করে বর্ষায়, কেউ শরতে বা শীতে, কারোর বা অন্য ঋতুতে।
একসময় রাজারা এই ঋতুকালে দিগ্বিজয়ে বেরোতেন। এখন আমাদের মতো গেরস্তেরা যায় বেড়াতে। আমি ভাটিকুমার, আমার বোধ যেন-বা বাঁধা আছে শরতে। তাই ঘাসের ডগায় শিশির পড়লে আমার প্রাণ আনচান করতে শুরু করে। তখন বাক্স বাঁধার হুটোপুটি। কিন্তু বহু স্থানে গিয়ে থুয়ে দেখেছি প্রাণের মধ্যে ওই হায় হায় ভাবটি থেকেই যায়। এই ভেজা শিশিরভেজা ঘাসের উপর কাকে যেন চেয়েছিলাম! কৌশানির বিজন বাসে, রানিক্ষেতের শৈলাবাসে, কংখালের গঙ্গাকিনারে গিয়েও মনে হয়েছে, না, এ ঠিক নয়।
অবশেষে তার সন্ধান পাই কালীগঙ্গার পারের এক হিজল-কাশ-হোগল-নলখাগড়ার ঝোপে। আর সেই হলো কাল। এখন ঘাসে শিশির পড়লেই পা চঞ্চল। এই আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। একদা এখান থেকেই দেহতরী ভাসিয়েছিলাম গোনে, তাই এখন উজানযাত্রায় যাই সিদ্ধিগঞ্জের মোকামে। কালীগঙ্গার শেষ ঘাট আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।
হোগল, কাশ, নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে থাকে আবার এক মুখ। সে মুখের কোনো বাস্তব অবয়ব নেই, আবার আছেও বা। সে এক বিশাল বিস্তার নদীতে ভাসে। নদীর নাম জানি-- ওই কালীগঙ্গা। মুখের নাম, সাধ করে রাাখি জলেশ্বরী। সেই মুখ দেখতে যাওয়া। ওখানে আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।"
📖📖📖📖📖📖📖📖📖
"হোটেলের বাইরে পা দিতেই কালীগঙ্গার সেই আলোকস্তম্ভ চোখে পড়ে। ফকির বলেন-- মোগো কচার চক্ষু। চারদিকেই এখন অন্ধকার। শুধু তার মাঝখানে ওই আলোকস্তম্ভটি ঘুরে ঘুরে নদীর উপর তার রোশনি ফেলে যাচ্ছে। আকাশেও এখন নক্ষত্র। পূর্বে সামান্য আভা, পথ জনহীন। যেখানে সারা দিনমান হাজার লোকেরা কলোচ্ছ্বাস, সেখানে এই নির্জনতা বড়ো বিষণ্ণতা আনে।..
ঘাটে এসে সবাই জেটির উপর বসি। সামনে কালীগঙ্গা। পূর্বমুখী আমরা, ডাইনে দূরে আলোকস্তম্ভ, বাঁয়ে নদীর আঁতুরঘরের রাস্তা ঘন অন্ধকারে সম্পূর্ণই দৃষ্টির আড়াল, অথচ তার অস্তিত্বের ঘোষণা, আমাদের সামনে সামান্য উজ্জ্বল আলোয় দ্রুত ধাবমান কচুরিপানার অনন্ত মিছিলে সম্যক প্রতিভাত। আবার আলোকস্তম্ভের পর থেকে নদীর গতিপথ সেই একই দুর্ভেদ্য অজ্ঞেয় অন্ধকারে ঢাকা। আমরা শুধুমাত্র সামনের সামান্য উজ্জ্বল অংশের মিছিলটুকু দেখি, বাকিটা অনুভবে বুঝতে চাই। যেটুকু দেখি সেইটুকুই অনুভব-- সেটুকুই কার্যকারণের সূত্র এবং যুক্তি সিদ্ধান্তের একমাত্র উপকরণ। সেখানে যাঁরা অনুভবের গ্রাহক তাঁরা তাঁদের তত্ত্ব গড়েন এবং তা গানে, কথায়, ভাবের আদান-প্রদানে বিশ্বাসের জগতে স্থাপন করেন। আর যাঁরা যুক্তি, তর্ক এবং কার্যকারণে তাকে ধরতে চান, তাঁরা নেতি নেতি বলে হুতাশ করেন। এখন এই নদীর বিশাল বিস্তারকে অনুভবে ধরব, কী কার্যকারণে-- বুঝি না। বস্তুত এখন এই প্রদোষ সময়ে, যখন সমগ্র চরাচর সুপ্ত, কোনো কোলাহল নেই, কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, তখন যেন অনুভবই তীব্র হয়ে ওঠে। মন বিচার করতে চায় না, বিশ্বাস করতে চায়। সে বিশ্বাস কীসের ওপর বিশ্বাস, জানি না, তবে তা যুক্তি বা ন্যায়সূত্রের জটিলতায় না গিয়ে সাধারণের, সহজ বিশ্বাসের সরল পথেই যেন বেশি সাবলীল। তখন এই ফকিরদেরই মতো বলতে সাধ হয়--
মানুষরতন, কর তারে যতন-- যাহা তোমার প্রাণে চায়।

📖📖📖📖📖
কচুরিপানা এক আশ্চর্য উদ্ভিদ। অমর, শেষ নেই তার। ভেসে যাওয়া অনন্ত কচুরিপানার স্তূপে এই আলো-আঁধারিতে যেন ভেসে যায় অনন্ত মুখ। সে মুখ মানুষ-মানুষীর। তার মধ্যে যেমন বকুলের মুখ দেখি, তেমনি তার ধর্ষকের মুখ। যেমন সশস্ত্রের মুখ, তেমনি নিরস্ত্রের, সেই স্রোতে ভাসমান। আমাদের চারিদিকের অন্ধকার পরিমণ্ডল ক্রমশ আলোয় উদ্ভাস পেতে থাকে। সেই আলো-আঁধারিতে নিজেদেরকেও একসময় যেন ভেসে যাওয়া কচুরিপানা বলে বোধ হয়। একসময় আমাদের সেই মৌন প্রেক্ষণের নিথরতা ভঙ্গ হয়। তখন সূর্য উঠতে থাকে। কচার পূর্বদিগন্ত লাল। দোতরাং-এ ফকির বাঙ্ময় হন--

বেরাম বেড়ে অগাধ পানি
তার নাই কিনারা তরণী পারে..."

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ: তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০ টাকা 

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।