বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

"মায়ের একটা গ্রাম ছিল, আড়িবেলিয়া। মা সেখানে মাঝেমাঝেই লুকিয়ে পড়তো। দিদার একটা মিষ্টি পিঠের কৌটো ছিল। দিদা সেই কৌটোতে মনের আনন্দে সাজিয়ে রাখতো পিঠে খাওয়ার গল্প। মনির ছিল এক টুকরো দেশ। মনি সেই দেশে মাঝে মাঝেই হারিয়ে যেত। বাবার ছিল একটা ইয়াশিকা ক্যামেরা। বাবা সেই ক্যামেরায় সবার ছবি তুলে রাখতো। হাঁদার ছিল একটা চায়ের দোকান। হাঁদা সেই দোকানে কাছে-পিঠের, দূরের সবাইকে চা খাওয়াতো। গল্প করতো। আড্ডার মৌতাত জড়িয়ে থাকতো সারাটা দিন। কেটলিতে টগবগ করে জল ফুটতো। ডেকচিতে উথলে উঠতো হরিণঘাটার দুধ। কাচের বয়ামগুলো ভরা থাকতো নানা রকমের বিস্কুটে। কোনটায় লেড়ো, কোনটায় লম্বু আবার কোনটায় সুজির বিস্কুট। বড় টিনের বাক্সোয় ভর্তি থাকতো মুড়ি। ভাঙা প্যাকিং বাক্সোতে রাখা থাকতো মাটির ভাঁড়। ভোর চারটেয় এ্যালার্ম দেওয়া থাকতো ঘড়িতে। সবার ঘুম থেকে ওঠার আগেই হাঁদা উঠে পড়তো। দোকানের চাবি, দুধের ডেকচি নিয়ে বেরিয়ে পড়তো বাড়ি থেকে। জল ছিটিয়ে দোকানের সামনের রাস্তা ঝাড় দিয়ে, উনুনের আগুন উসকিয়ে তার ওপরে নতুন কয়লা দিয়ে প্রথম জলের কেটলিটা বসাতো। ততক্ষণে গঙ্গা থেকে স্নান সেরে আসতে শুরু করে দিয়েছে অনেকে। জুটমিলের নাইট ডিউটি শেষের ভোঁ পড়লো বলে। সকালের বাজারের লোকজন এসে জড়ো হচ্ছে আস্তে আস্তে। কলকাতা ক’তে চলছে প্রভাতী সঙ্গীতের আসর। রাগ ভৈরব। এর হাতে ওর হাতে উঠে আসছে গরম চায়ের ভাঁড়। সবাই দিনের প্রথম চায়ে পরম তৃপ্তিতে চুমুক দিচ্ছে। হাঁদার হাত চলছে যন্ত্রের মতো। তারমধ্যে বশিরচাচার বেকারির ভ্যান চলে এসেছে। গুনে গুনে বাপুজী কেক, বিস্কুটের প্যাকেট, মিষ্টি পাউরুটি নামানো হচ্ছে। আগের দিনের বাসি যা কিছু নিয়ে নিচ্ছে হিসেব মিলিয়ে বসিরচাচা। যাওয়ার আগে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে চায়ের ভাঁড়ে। সকালের রঙটা ফিকে হতে হতে গাঢ় হচ্ছে। এরপরে সারাটা দিন গনগনে আঁচের সামনে একের পর এক কেটলি বসবে। চা হবে। ছয় ঋতু আসবে যাবে। রুটিনের কোন পরিবর্তন হবে না। একমাত্র শরীর খারাপ ছাড়া হাঁদার দোকানও বন্ধ হবে না এক দিনের জন্য। এমনকি সেই সময়ের দোর্দন্ডপ্রতাপ দলের বনধ ডাকা সত্ত্বেও দোকানের একটা পাল্লা খোলা থাকবে। উনুনের আঁচ জ্বলবে গনগন করে। চায়ের কেটলিতে চা থাকবে না বাড়ন্ত।"

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মেখলা ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্য : ৩৩০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।