আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

আদতে উত্তর রাঢ়ের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও বাবার কাজেরর সূত্রে কিছুকালের জন্য পরিবারটিকে থাকতে হয়েছিল শুকনো আবহাওয়ার পাথুরে গরমের লালমাটির দেশে। কিন্তু সেখানেও জ্বর-জ্বারি ছিল সাধারণ অনুষঙ্গ।
সাত-আটদিন জ্বর। সকালে জ্বর কমে যায়, সকালের অরুচির জলখাবার খেয়ে জ্বরীয় পিপাসায় আকণ্ঠ জল খাওয়ার পরই আবার কম্প দিয়ে জ্বর। বাবা সকালের বেরোবার আগে মাকে বা দিদিদের কাউকে নির্দেশনা দিয়ে যান। সারাদিন লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে। ঘন্টায় ঘন্টায় থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে মা লিখে রাখেন একটা কাগজে। মাঝখানে একবার মাথা-ধোওয়া , তীব্র আপত্তি ও কান্নাসহ সাবু-বার্লি গলার্ধকরণ। মাঝে মাঝে দিদিদের কেউ এসে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যায়, দিদিরা স্কুল-কলেজে চলে গেলে মা। ওষুধ বলতে দরিদ্রের শিশি-ঝাঁকানো জল, সাদা সাদা মিষ্টি বড়ি বা পুরিয়া-বন্দি সাদা পাউডার। সেই ওষুধেই জ্বর বাড়া-কমা, সাতদিন বা দশদিনের তীব্র জ্বরের পরও কোনোরকম দুর্বলতা বা শরীরী লক্ষণ না-রেখেই জ্বরের অবসান।
যেদিন স্নান ও ভাতের অনুমতি পাওয়া যেত, সেদিন বুকের ভেতরে অন্তর্গত উৎসবের নৃত্য-- আজ ভাত খাওয়ার দিন। সে ভাত তো যে-সে ভাত নয়, জ্বরমুক্ত ভি আই পি-র জন্য প্রস্তুত ভাত।

পোড়ের ভাত।

জ্বর হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই ছিল। সাবু-বার্লির দুঃখ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল জ্বর বাড়লে সাংসারিক ব্যস্ততার মধ্যেও মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, দিদিদের একটু মনোযোগ। সর্বোপরি যেদিন জ্বর ছাড়বে, সেদিনকার পোড়ের ভাতের হাতছানি।
সকাল সকাল মা স্নান সেরে ফর্সা কাপড় পরে জ্বোরো রোগীর জন্য মাটির ছোটো হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে দিতেন। এমন একটা হাঁড়ি তখন অনেক সংসারেই থাকত। কেননা জ্বর ছিল একটি লোকপ্রিয় ব্যাপার। পোড়ের ভাতের জন্য জ্বালানি দেওয়া হতো শুধুমাত্র ঘুঁটে দিয়ে। ফলে ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ ধরে ফুটতে থাকত সেই ভাত-- গোবিন্দভোগ আতপ চালের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। ভাতের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হতো কয়েকটি তরিতরকারি। পোড়ের ভাতে এক চামচ ঘি দেওয়াটা ছিল আবশ্যিক।

ছোটোদের কাছে এই ঘি-এর ব্যাপারটা বরাবর ছিল রহস্যময়।
আামাদের শহরে তখন সত্যিকার ঘি পাওয়া যেত একটি মাত্র দোকানে। সেটা ছিল শুধুমাত্র ঘি-এরই দোকান। সেই দোকান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বাতাস ঘি-এর গন্ধে সর্বদা আমোদিত থাকত। মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি হতো। দোকানটি একটু অন্ধকার অন্ধকার, রহস্যময়। সারাদিন দোকানের ভেতরে জ্বলত একটামাত্র টিমটিমে বাতি। তাতে ভূতো-ভূতো অন্ধকার আরও বেড়ে যেত। অতীব ক্ষীণদৃষ্টি সম্পন্ন দোকানের মালিক নাকি বন্ধুমহলে বলতেন-- 'ওরে বেশি পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে শুধুমুদু পয়সা খরচ করব কেন, যতই আলো জ্বালি আমার মতো অন্ধের তো একই অবস্থা থাকবে, ওই যে বলে না অন্ধের কী-বা দিন কী-বা রাত।'

সারাদিন ঘি জ্বাল দেওয়ায় দোকানের সবই তেলতেলে, চকচকে-- দাড়িপাল্লা থেকে বাটখাড়া, 'করচা' করার অবনীন্দ্রিয় কুটুম-কাটুমগুলো থেকে দোকানের টেবিল-বেঞ্চি-- মায় মালিকটি পর্যন্ত। তাঁর লম্বা দাড়িও ঘিয়ে রঙ প্রাপ্ত হয়েছিল। চোখে ছিল মোটা ফ্রেমের পুরু কাচওয়ালা চশমা। পরনে থাকত খাটো ধুতি আর ফতুয়া। তাঁর দাড়ির মতোই সে-দুটির রঙ বোধহয় এককালে সাদাই ছিল, কিন্তু আমরা দেখতাম তার রঙ কালচে মেটে মেটে। সারা শরীর তাঁর ঘি-ময়। খরিদ্দারদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন ইঙ্গিতে। আঙুল দেখিয়ে ঘি-এর পরিমাণ বোঝাতে হতো তাঁকে। কেননা চোখের মতোই তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা ছিল কম, আর কথা বলতেন আরও কম।
...................................................................
আমাদের মতো পরিবারগুলোতে এই দোকান থেকে ঘি আসত নিয়মিত, কিন্তু তা সাধারণভাবে ছোটোদের পাত পর্যন্ত পৌঁছাতো না। বাড়ির খাটিয়ে কর্তারা পাতে খেতেন, আর বিশেষ বিশেষ তরকারিতে সেই ঘি ব্যবহত হতো। আমাদের বাড়িতে বাবার পাতের আলুসেদ্ধ মাখা হতো ঘি দিয়ে। তিনি আমাদের জ্ঞানকালে পুরোপুরি নিরামিষাশী ছিলেন। সুতরাং আমরা ঘি-এর গন্ধ যতটা পেতাম, পাতে ততটা পেতাম না।

তা এই ঘি-দেওয়া পোড়ের ভাতের গন্ধে দশদিনের ভাত-উপবাসী জ্বরের রোগীর জ্বর-জ্বর ভাব পালাতো অনেক দূরে। আর পোড়ের ভাতের লোভে যাকে বলে 'পরিমল লোভে আসিয়া জুটিল'-র বাস্তব দৃশ্য।
সকলেই জানতো জ্বরের পর ভাত-খাওয়াটা যতটা কাঙ্ক্ষিত ছিল, জ্বরের মুখে ততটা খাওয়ার সাধ্য ছিল না। এক চামচ করে পোড়ের ভাতের ভাগ পেতে দাদার লুব্ধ-ঘুরঘুরানি শুরু হয়ে যেত। দিদিরা যদিও ছিল একটু বড়ো, ছোটো ভাইদের অভিভাবক, তবু সুযোগ পেলে তারাও একটু ভাগ পেতে চাইত। এমন-কী পাশের বাড়ির ছোটোরাও এসে জুটত। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য-- সারি সারি ছোটোরা বাটি নিয়ে বসে পড়েছে, আর মা সকলের বাটিতে একহাতা করে পোড়ের ভাত দিয়ে যাচ্ছেন। সেই এক হাতা ভাত তারিয়ে তারিয়ে খেতে সময় লাগত আধ ঘন্টা! তাই আশপাশের কারও জ্বর হলেই আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম, খোঁজ রাখতাম কবে তার ভাত খাওয়ার দিন।

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ: দুর্লভ সূত্রধর 
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৮০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।