আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

সেবার প্রণবদা বালক সংঘের ঠাকুর বানিয়েছিল। ঠাকুর মণ্ডপস্থ হবার পর বেজায় কানাকানি পড়ে গেল—ঠাকুরের মুখটা নাকি নীতাদির মতো। তাতেও অতটা কানাকানি হওয়ার কথা ছিল না। নীতাদির গড়ন একটু মোটার দিকে, প্রতিমার গড়নটাও ঠিক তেমনই। কোথাও কস্মিনকালেও কোনো প্রতিমাকে ঈষৎ স্থূলাঙ্গী করে তৈরি করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বারোয়ারিগুলোর চৌদ্দ বা বাইশ ফুটের মেগা কালীমূর্তিও আনুপাতিকভাবে বেশ তন্বীই থাকেন। সুতরাং প্রতিমা দর্শন করে অতিরিক্ত কৌতূহলীরা বেশ অঙ্ক মিলিয়ে নিলেন। তবে নীতাদি এবং তস্য বোন ছন্দিতা সর্বদা এয়ারহোস্টেস বা হাইনেক কলারওয়ালা থ্রি-কোয়ার্টার ব্লাউজ বা জামা পরে। কিন্তু বালক সংঘের প্রতিমার পরনে সাধারণ গোল গলার ব্লাউজ।

এসব নিয়ে ক্রমেই কানাকানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

আমাদের ইস্কুল বা রিপাবলিকে কানাকানি প্রায় হট্টগোলে পৌঁছলে সুধন্যবাবু স্যার এত জোরে ‘চু-উ-উ-উ—প্’ বলে উঠতেন যে আমরা চমকে থেমে যেতাম। স্যার বলতেন—'নর্ম্যালি কথা বলবি, কানাকানি করতে গেলে গোপন কথা বলার উত্তেজনায় এত জোরে কথা হয়ে যায় তা বলার নয়, তখন চুপ করাতে তোদের গোলমালের থেকেও বেশি ডেসিবেলে আমাদের ‘চু-উ-উ উ—প্’ বলে চেঁচাতে হয়। ব্যাপারটা ভালো নয় রে!’

এক্ষেত্রেও সেটাই হলো। কানাকানির তোড় নীতাদির বাবার শৈত্যের পাঁচিল পেরিয়ে গেল। তিনি থাকতে না পেরে মণ্ডপে এসে দেখে গেলেন ঠাকুর। কিন্তু ওঁর কিছু বলার বা করার ছিল না, কেননা, প্রণবদা তো কোনোদিন রাস্তাঘাটে নীতাদিকে অনুসরণ করেনি, তার পথ আটকে দাঁড়ায়নি, কোনোদিন মুখোমুখি কথা বলার চেষ্টা করেনি, নীতাদির স্কুল বা কলেজের সামনে পদচারণা করেনি, কখনও বিরহী যক্ষের মতো মেঘকে দূত করে নীতাদিকে কোনো বার্তা পাঠায়নি। হাঁ করে হ্যাংলার মতো কোনোদিন নীতাদির দিকে চেয়েও থাকেনি। তাছাড়া প্রণবদা নীতাদির প্রায়-বোঁচা নাকটা একটুখানি তুলে দিয়েছিল। তবু প্রতিমার গঠন, দাঁড়াবার ভঙ্গি, মুখের দুর্জ্ঞেয় হাসিটি দেখে একমাত্র নীতাদির বাবাই বুঝলেন, সবটাকে শিল্পীর কল্পনা বলে চালানো মুস্কিল। রেগে, হকচকিয়ে, ফর্সা গালে অপ্রতিভতার লাল ছোপ ফেলে ভদ্রলোক চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু বড়ো হতে-চলা আমরা কেউ কেউ ব্যাপারটা ঠিকই বুঝলাম—প্রণবদাদের বাড়িটা বলতে গেলে নীতাদিদের কয়েকটা বাড়ির পরেই। নিজেদের বাড়ির ছাদে আমাদের নিয়ে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে প্রণবদা আকাশে উড়ে চলা ‘মোমবাতি’র আলোয়, রামধনুর রঙে ছ-ফুটি পাঁচিল-ঘেরা বাড়ির ছাদে বাড়ির পোশাকে পদচারণারত নীতাদির পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়াবার, অধরোষ্ঠ ফুটে থাকা দুর্জ্ঞেয় হাসিটির সৌন্দর্য অতদূর থেকেও কীভাবে যেন দেখতে পেয়েছিল—কে জানে! হাতের লাটাই আর সুতোর মধ্যস্থতায় কোনো বিশেষ বার্তা এসে পৌঁছেছিল কিনা প্রণবদার কাছে। কিন্তু আমরা একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, প্রণবদার এমন শিল্পীসুলভ পর্যবেক্ষণ বা বিলোকনের ব্যাপারটি নীতাদির বাবার মতো মানুষের বোধের সম্পূর্ণ অতীত ছিল।

এলাকার কুচুটেরা যতটা আলোড়ন আশা করেছিল তার কিছুই হলো না। শুধু নিজেদের বাড়ির ছাদে নীতাদির বৈকালিক পদচারণা বন্ধ হলো। আর ছন্দিতা নামের শ্বেতস্বপ্ন পরীটির স্কুলের স্কার্টের ঝুল বেড়ে গিয়ে হাঁটু ছাড়িয়ে নামল।

প্রতিমা কাণ্ডের থেকেও ঢের বেশি আলোড়ন দেখা দিল সেদিন, মাসখানেকের মধ্যে যেদিন নীতাদি ঐ অনুশাসিত বাড়ির বিধি-বিধানকে অগ্রাহ্য করে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করে বসল। এক ধাক্কায় তার মায়ের প্যারালিসিস। ধাক্কাটা করোনারি ছিল।

নীতাদি চলে যাওয়ায় ও মায়ের অসুস্থতার কারণে সেই সময় থেকেই ছন্দিতার ঢ্যাঙা দাদাটাকে ছাড়া একা একা ইস্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু যাকে নিয়ে এত কিছু সেই প্রণবদাকে দেখে আপাতভাবে কিছু বোঝা গেল না। ঘুড়ি উড়তে লাগল প্রত্যেক বিকেলে। নীল আকাশের মাঝে সাদা থোপা থোপা মেঘের পাশে উড়ছিল ‘দিন-রাত্তির’, শেষ বিকেলে প্রণবদা সাঁ সাঁ করে উড়িয়ে দিল ‘মোমবাতি’।

দিন-রাত্তিরও জেতেনি, মোমবাতিও জেতেনি।

এই ঘটনায় প্রণবদার চেলারা আন্তরিকভাবে দুঃখিত হয়েছিল। যে দুলালদা সারাদিন একটা কাচা জামা কাঁধে আলগোছে ফেলে খালি গায়ে সারা এলাকার এধার থেকে ওধার ছুটে পর্যন্ত ছুটে বেড়াতো— ভাবখানা ছিল এমন—জামা তো রেডিই আছে, ইচ্ছা করলেই পরতে পারি—সেই দুলালদা পর্যন্ত মন খারাপ করে কাঁধের জামা গায়ে পরে সমস্ত বোতাম এঁটে ফেলল।

নীতাদির বাবা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়েছিলেন বেশি। আসলে তিনি ছিলেন আপাদমাথা একজন সংসারী মানুষ—ম্যানারিজমে ভরপুর। স্ত্রীর অসুস্থতাজনিত বিকলাঙ্গতা, বড়ো ছেলের স্বার্থপরতা, নীতাদির নিষ্ক্রমণ—সবকিছুকে সামলে নিতে চেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু তিনি বোঝেননি যে, মানুষের সেল্ফ-ম্যানেজমেন্ট সর্বদা মানুষের নিজের হাতে থাকে না। প্রত্যেকেরই নিজের মতানুযায়ী নিজের সংসার ও জীবন পরিচালনা করার অধিকার আছে—সেটা তেমন কিছু অন্যায়ও নয়। কিন্তু সমসাময়িক সামাজিক সাপেক্ষতার বিশিষ্ট ধারাটিকে, সমকালীন শর্তগুলিকেও অনুধাবন করতে হয়, মানানসই হয়ে উঠতে হয় তার সঙ্গে, ধৈর্যের সঙ্গে তার মোকাবিলা করে তাকে সপক্ষে নিয়ে আসতে হয়। এসব দিক হয়তো ভেবে দেখেননি নীতাদির বাবা। তিনি মারা গেলেন।

বাবার ক্রিয়াকর্ম হয়ে যাবার পর মাস খানেকের মধ্যে ছন্দিতাদের এই পরিবারটি বাড়ি বিক্রি করে কোথায় চলে গেল, বোধহয় দু-চারটি যে আত্মীয়স্বজন ছিল তাঁদের কাছেই নির্ভরতা খুঁজতে গেল পরিবারটি।

আমাদের জনপদটি যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। শুধু প্রণবদা কোথা থেকে একটা বাহারি ফেজ-টুপি জোগাড় করে সেটা মাথায় চাপিয়ে বেশি বেশি করে ঘুড়ি ওড়াতে লাগল—রাগ করে স্পেশাল মাঞ্জা লাগিয়ে নিজের মোমবাতি ঘুড়ি দিয়ে গন্নাকাটা বা পেটকাটি ঘুড়ি দেখলেই কেটে দিতে লাগল। 

আর সেই ছেলেটি?!

যার সাদা-মাটা জীবনে পুঁজি-পাটা ছিল কম! তবু কী করে যেন ছন্দিতা নামের সেই মেঘদূতীর মুখে বাহাত ফুটে না-ওঠা দুঃখের রেখা সে পড়তে শিখেছিল। আ-কৈশোর ত্বকের ভেতরে সেই বালিকার মুকুল মুকুল গন্ধকে লালন করেছিল— নিজের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ঝিম্ ধরানো নৃত্যের ছন্দকে অভিযোজিত করেছিল সে। সেই ছেলেটিই একমাত্র বুঝতে পেরেছিল—'বেদনার পরম গোপন কথাখানি’—যে কথা কাউকে বলা যায় না, কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না।

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

অলংকরণঃ দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।