আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

"আমাদের শহর আর আমাদের শ্লথ-অলস-মন্থর জীবনে যথেষ্ট 'রহস্য প্রহেলিকা' ছিল না। সেই কারণে শহরের কোনা-কাঞ্চিতেও কোনো ঘটনা ঘটলে তার রেশ কয়েকদিন ধরে প্রাক্-ঊষাকালীন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সান্ধ্যকালীন তাসের আড্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। একদা ইংরেজপূর্ব ভারতীয় ইতিহাসে এই শহরের ঊন-গুরুত্ব থাকলেও পরবর্তীকালে বিশেষ বিশেষ ঘটনায় কিছু অব্যবস্থিত প্রতিক্রিয়া বিস্ফারিত হওয়া ছাড়া এখানে রাষ্ট্রীয় কোলাহল প্রবেশ করত কদাচিৎ। তখন পর্যন্ত রাষ্ট্র ছিল আমাদের থেকে অনেকটা দূরের ব্যাপার। 

সেই শহরটার চেহারা হঠাৎই যেন বদলে গেল। 

আসলে মলিন বাড়ি-ঘরদোর, কোর্ট-কাছারি, দু-চারটি সরকারি অফিস, ঘেয়ো পথ-মাঠ, পথের পাশের জমে থাকা আবর্জনা, খোলা ড্রেন, অলিগলিতে ভ্যাট-ট্যাট, আমাদের রূপেশ্বরী নদীটি--- ইত্যাদি নিয়ে শহরটা একই থাকল। শুধু খেলার মাঠগুলো বেদখল হয়ে গেল; শহরে মানুষজনের পরিমাণ বেড়ে গেল। গলগল করে মানুষের স্রোত এসে মাঠঘাট, রেললাইনের ধার, নদীবাঁধের কিনারা, স্কুল-কলেজ ভরিয়ে ফেলল। 

শহরের নিজস্ব মানুষজনও বদলে গেল খানিকটা। 

এত মানুষের স্রোত, স্কুল কলেজ বন্ধ-- কেউ আপত্তি করল না। বাজারে টান পড়লো, রাস্তাঘাট নোংরা হলো। তবু শহরের মানুষ বিরক্ত নয়। বরং তাদের মুখে-চোখে যেন অন্য আলো খেলা করতে লাগল, শরীরী-ভাষায় জাগল উদ্দীপনার কম্পন। স্রোতের মতো ভেসে আসা মানুষগুলো যেন এই পুরোনো হাঁফ-ধরা শহরের সম্মানিত অতিথি। 

হবে না-ই বা কেন?

রেডিওতে যা শোনা যাচ্ছিল, খবরের কাগজে যা বেরোচ্ছিল তাতে করে সবাই বুঝে নিয়েছিল যে, পাশের দেশ--- যে দেশটা আগে ছিল এই শহরের অনেক বাসিন্দা ও দেশভাগের পর থেকে গজিয়ে ওঠা নতুন নতুন পল্লী বা কলোনিগুলোর বাসিন্দাদেরই হাতের তালুর মতো চেনা এবং বাস্তব-হারানো স্বপ্নভুবনের অধিকার। এদিকটা পশ্চিম হলে ওদিকটা পূর্ব, এদিকটা দক্ষিণ হলে ওদিকটা উত্তর---সেইখানেই মরণপণ লড়াই চলছে, যার পোশাকি নাম 'মুক্তিযুদ্ধ'। ভাষা আর ভাতের সম্ভ্রমজাগানো গ্রাসের জন্য সে-এক অভূতপূর্ব সংগ্রাম। 

তা সেই রক্তসঙ্কুল যুদ্ধক্ষেত্রে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে তো যাওয়া যায় না, তাই সে-দেশের সাধারণ স্ত্রী-পুত্র পরিবার এ দেশের অতিথি। ঠিক এভাবে রেডিওতে বলেনি, কাগজেও লেখেনি, তবে এসব কথা তো চাপা থাকে না, বিশেষ করে আমাদের মতো এমন এক শহরের ঐতিহ্যবান নাগরিকদের কাছে! তাই মুখে মুখে এসব কথা স্ফীত-উৎসাহে রূপেশ্বরী নদীর ঘাট থেকে রেলের প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। 

গোটা শহরের এই বিপুল সহিষ্ণুতার মধ্যে আমাদের একটু একটু অসুবিধা হচ্ছিল। সবে আমরা ক্লাস নাইনে উঠেছি। নতুন নতুন বিষয়। এখন এই ঝামেলায় ইস্কুল বন্ধ। 

কথাটা বলেই ফেলেছিল মায়া-বিশু। 

---ঝামেলা আবার কী? বল 'পরিস্থিতি'। এই 'পরিস্থিতি'তে---ঝাঁঝিয়ে ওঠেছিল দেবেশ্বর। রীতিমতো আক্রমণাত্মক দেখাচ্ছিল ওকে। 

এই রে! প্রমাদ গুণি আমরা। যেদিন অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইস্কুল বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়, সেদিন প্রেয়ারের বক্তৃতায় আর সভায় হেডস্যার 'পরিস্থিতি' শব্দটা বারকয়েক ব্যবহার করেছিলেন।

আমরা বরাবরই দেবাটাকে একটু 'ইয়ে' বলেই জানি। হেডস্যার বলার দুদিন পরে তার মুখে 'পরিস্থিতি' জাতীয় শব্দের মোক্ষম প্রয়োগে থমকে যায় বেচারা মায়া-বিশু। আমরা সুদ্ধু একেবারে হকচকিয়ে যাই। আমরা পরস্পরের দিকে তাকাই---'নাঃ, এবার যেখানে-সেখানে, অজায়গায়-কুজায়গায় এই শব্দটা প্রয়োগ করে জ্বালাবে দেখছি!'---চিন্তিত মুখে বলে মাণিক্য। 

ইদানিং নানান ধরনের বদখত শব্দ দেবা জোগাড় করে ওর কবি-দাদা শিবেশ্বরের কাছ থেকে, আর যত্র-তত্র সেগুলো কপচে ব্যোমকে দেয় সকলকে। 

---আরে একটা দেশ লড়ছে মুক্তির জন্য, অপমান আর শোষণের হাত থেকে, অত্যাচারীদের নাগপাশ থেকে দেশটাকে স্বাধীন করার জন্য---তাকে ঝামেলা বলবি! দেবা প্রায় শাসিয়ে ওঠে। 

সবুজ জমির ওপর লাল গোলকের মধ্যে চ্যাপটা ম্যাপওয়ালা পতাকাটা আমরা প্রথম দেখি দেবারই হাতে। 

শহরে মানুষের ঢল নামার মধ্যেই আমাদের রিপাবলিকে হেডস্যারের উদ্যোগে একটা সভা হয়ে গেল। ইস্কুল বন্ধ থাকলেও হেডমাষ্টারমশাই স্যারেদের সঙ্গে উঁচু ক্লাসের ছেলেদেরও ডেকেছিলেন। গীতা আর উপনিষদের শ্লোক বলে তিনি প্রমাণ করে দিলেন-- এ-ও আসলে এক-ধরনের ধর্মযুদ্ধ। তিনি বুঝিয়ে দিলেন-- 'এই ধর্মযুদ্ধ কিন্তু ঠিক ক্রুসেড নয়। এ যুদ্ধ ধর্ম-সম্প্রদায়ের জন্য নয়--এ হলো বাঙালির জাতিসত্তা ও ভাষা-স্বাতন্ত্র্য রক্ষার লড়াই। আমাদের পাশের দেশটা অন্য দেশ হলেও তার মানুষগুলো আড়াই দশক আগেও আমাদেরই অংশ ছিলেন-- এখনও তাঁরা আমাদেরই লোক, আমাদের ভাষাতেই কথা বলেন-- আমাদের মতো করেই খাওয়া-দাওয়া করেন, জীবনযাপন করেন। তাঁরা আজ আক্রান্ত। তাঁরা অনাচারী-অত্যাচারী-প্রজাপীড়ক-হানাদার রাজশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। সেই কারণেই বিপন্ন সাধারণ মানুষেরা নিরাপত্তার সন্ধানে আমাদের দেশে এসেছেন। তাঁরা আমাদের অতিথি। এ যেন অত্যাচারীর বিনাশ আর সাধারণ-সাধুজনদের রক্ষার জন্য যুদ্ধ! এই পরিস্থিতিতে আমাদেরও কিছু করতে হবে, মানবধর্মের পক্ষে থাকতে হবে। এঁদের সকলকে যথাসাধ্য আতিথ্য দিতে হবে---যথা ধর্ম তথা জয়, জয় আমাদের হবেই।'... ইত্যাদি ইত্যাদি। 

হেডস্যারের কথা ভালো করে শেষ হওয়ার আগেই দেবেশ্বর নিজের পকেট থেকে সবুজ জমির ওপরে লাল গোলোকের মাঝখানে মেটে-হলুদ প্রস্তাবিত মুক্তদেশের ভূখণ্ড পরিসীমা-চিহ্নিত একটা পতাকা বের করে তার এক-কোণা ধরে রুমালের মতো নাড়তে নাড়তে চিৎকার করে উঠেছিল--- 'জয়, স্বাধীন বাংলাদেশের জয়। মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ!' 

আর কী আশ্চর্য! আচমকাই সবাই--- এমন কী হেডস্যারের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুমথনাথবাবু স্যার, স্বভাব-গোমড়া কানাইবাবু স্যার, নীরেনবাবু স্যার--- এমন কী ভূপেশবাবু স্যার পর্যন্ত গলা মিলিয়ে মাত্র দিনকয় আগে রমনার রেসকোর্স ময়দানে মুজিবুর রহমানের দেওয়া সাতই মার্চের বিখ্যাত ভাষণের মতো অনাগত স্বাধীনতার জয়ধ্বনি দিয়ে উঠেছিলেন।"

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ: দুর্লভ সূত্রধর
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৮০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।