মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন। সম্পাদনাঃ সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

আটাত্তর সালের ওলট-পালট করা বন্যার স্বাদ আমার হোস্টেলে বসেই নেওয়া। আমার জীবনেও অনেকটা ওলট-পালট সেই ঘটনার সূত্র ধরে। যতদূর মনে পড়ে, তার আগে পাঁচ-ছ'দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়েছিল। বাইরে বেরোনো বন্ধ। কলেজের ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। পুরোনো যে সব বিল্ডিং আছে, তাদের নিচের তলার অর্ধেক জলের তলায়। আমাদের হোস্টেলের বাইরে হাঁটু সমান জল জমে গেছে। কিছুটা এগিয়ে রাস্তায় গেলে কোমর সমান। ততদিনে বাংলা ভাসানো বিখ্যাত আটাত্তরের বন্যা গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি নদীয়া জেলায়। যদিও কেউই নিরাপদ নেই। খোদ কলকাতায় জনজীবন স্তব্ধ। রেডিও আর কিছু কিছু লোকমুখে জানতে পারছি মানুষের অসহায় অবস্থার কথা। সে সময়ে ফ্লাড রিলিফে যাওয়াটা ছিল দস্তুর। আমাদের হোস্টেল আর কলেজ থেকেও কয়েকটা টিম গেল। নিজে না গেলেও তাদের রিলিফের জিনিস জোগাড় ও নিয়ে যাবার বন্দোবস্তে অংশ নিয়েছিলাম। মনে আছে এরকম দুটো টিমে সঙ্গী হয়েছিলেন কবি সৃজন সেন আর চলচ্চিত্র পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী। সেই টিমের ছেলেরা ফিরে এসে বন্যার যে ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছিল আমাদের সামনে তাতে ক্ষোভ বাড়ছিল সকলের। নবীন সরকারের পক্ষে যতটা করা সম্ভব, তারা হয়ত তার বেশিই করছিল, তবু প্রয়োজনের তুলনায় তার অপ্রতুলতায় অভিযোগের পাহাড় জমছিল। সেই সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয়তাটুকু বেশি করে অনুভব করেছিলাম আমরা। আর সেই সূত্রে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যাপন আর সমস্যার চেহারাটা স্পষ্ট হচ্ছিল আমাদের কাছে। বন্যার পরেও নানা প্রসঙ্গে তা জানার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে যাই। আর সেখানে অনেক সমমনোভাবাপন্ন ছাত্রদের সঙ্গে সখ্য বাড়ে, বিনিময় বাড়ে। এরপরেই রাজনীতির পাঠে হাতেখড়ি হয় আমার। হোস্টেলে রাজনীতির গভীর চর্চা আর অনুশীলনের একটা পরম্পরা ছিলই। রীতিমত ক্লাসের মতো করে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে পরিচয় করা ইত্যাদি ছিল সেসব ক্লাসের অঙ্গ। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে দিনবদলের বিপ্লবের আগুন স্তিমিত, আঁচটুকু কিন্তু যথেষ্ট উত্তাপ ছড়াচ্ছে। বন্দিমুক্তি আন্দোলন দেখেছি। গণসংগীত, নাটক, ফিল্মে আলো ছড়াচ্ছে এই ধারার সুর। সেই সময় থেকে ছাত্রজীবন, ইন্টার্ন ও হাউস-স্টাফ থাকার শেষদিন অবধি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কর্মসূচী, তা মেডিকেল ক্যাম্প, রক্তদান শিবিরের মতো কিছু হোক, বা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামের কর্মসূচী হোক, তাতে যোগ দিতে দুবার ভাবিনি। সেই শিক্ষা সারা জীবনের মতো কটি কথা শিখিয়ে দিয়েছিল। আজ এই পরিসরে তার নির্যাসটি সকলকে জানাতে চাই।

১. 'রাজনীতি' শব্দটি ঘৃণা করার মতো শব্দ নয়। সামাজিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের প্রতিটি কাজের ফলাফল নির্ধারণ করা শক্তিটির নাম রাজনীতি। তাই সামাজিক বৈষম্য দূর করার ন্যূনতম প্রচেষ্টার মধ্যে থাকতে গেলেও রাজনীতি বিষয়ে স্পষ্ট মতামত তৈরি ও ব্যক্ত করার ইচ্ছে থাকা চাই। আজ যখন দেখি, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে টেলিভিশনের পর্দায় একজন রাজনীতিক অন্য একজনকে বলছেন, দয়া করে রাজনীতি করবেন না, তখন আমার করুণা হয় এদের জন্য। ভাবি যে, রাজনৈতিক চরিত্ররাই যদি রাজনীতি কথাটিকে ঘেন্না করতে শেখান, তবে ঘটনার পেছনের রাজনীতিটা মানুষ তো বুঝতেই চাইবে না। অবশ্য আজকের রাজনীতিকদের তো তাতেই লাভ। সত্যি উন্মোচিত হলে তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষতি।
২. বৈষম্যই ইতিহাসের চালিকাশক্তি। নতি ছাড়া চাকা গড়াবে না। তেমনি ইতিহাসের ঘটনা সংঘটনের জন্যও নতির প্রয়োজন আছে। ক্ষমতার তারতম্য সেই নতির রূপ। কখনও তা বলবান থেকে দুর্বলের দিকে, আবার কখনও তা বিপরীতমুখী। তাই একান্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় বাস্তবতা নেই। কিন্তু চাকার গতিপথের অভিমুখ বৃহত্তর কল্যাণের দিকে চালিত থাকা উচিত, যা এই অভিমুখে সমাজের গতিকে নির্দিষ্ট করবে।

৩. বৃহত্তর কল্যাণের অভিমুখে চালিত ব্যবস্থায় নিজের যদি ন্যূনতম ভূমিকা রাখতে হয়, তবে পক্ষগ্রহণ জরুরি। কারণ 'নিরপেক্ষ' এমন এক আপাত-নিরীহ শব্দ, যার মতো বিপজ্জনক শব্দ আর হয় না।

আজ জীবনের প্রদোষকালে এসে হোস্টেলবাসের দিনগুলো মনে করতে গিয়ে মনে হয়, আমার আজকের জীবনের ইমারতটা যে স্তম্ভগুলো দাঁড় করিয়ে রেখেছে, তাদের ভিত্তির নির্মাণ হয়েছিল ওই দিনগুলোতেই। স্মৃতিবাহী জলবিন্দুরা মনে করিয়ে দেয়, রোদ ঝলমলে দিনের পাশে পাশে অনেক বজ্রবিদ্যুতের ফলায় ফালাফালা হয়ে যাওয়া মর্মন্তুদ রাতের সমাবেশও ছিল সে-জীবনে। তেমনই সফলতার আলোকিত দিগন্তের দিকে হাঁটতে গিয়ে মাঝরাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়া অনেক মানুষের ব্যর্থতার আর্তনাদের পাশাপাশি তাদের শবদেহের ওপর দিয়ে ইতিহাসের রথের চাকার গড়িয়ে যাবার উল্লাসও ছিল। ভালো-মন্দ দুই-কেই মহামানব সুলভ নিস্পৃহতার সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসাতে না পারি, তাতে উদ্বেল না হয়ে জীবনের সামগানে আজও যে গলা মিলিয়ে চলতে পারি, সে ওই দিনগুলোর দান।

আমার ডাক্তারি পড়ার হোস্টেল-জীবন
ভাস্কর দাস

মেস-হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনাঃ সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্যঃ ৫৬০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।