ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার

"গঙ্গায় বালুচরে তিরন্দাজদের মহড়া চলছে। উঁচু পাড়ে রেশমের চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে শাহ সুজা তা নিরীক্ষণ করছেন। মাথার ওপর সূর্যের কোপানল, নিচে চিকচিকে তপ্ত বালু। আমরা ঘেমে নেয়ে উঠছি। সে সময় উঁচু পাড় থেকে তলব আসলো। আমার হাতের নড়বড়ে টিপ কি এর কারণ? চুগলখোরদের টিপ্পনিও মনে পড়লো--- নর-মাদানির্বিশেষে সুন্দর মুখের সমঝদার শাহ সুজা। চুলে পাক ধরলেও বাতিক যায় নাই। আমি কুর্নিশ করে সামনে দাঁড়াতে তিনি পিঠ চাপড়ে শাবাশি দিলেন, যদিও এর কোনো কারণ ছিল না। খানিকটা আনমনা আমি তখন। তাঁর চোখের মণি নীল নয় বলে মনে মনে হতাশ হচ্ছিলাম। তিনি তোপখানার আতা বেগকে গাদাবন্দুক আনার হুকুম দিলেন। বন্দুকে আগেই বারুদ পোরা ছিল। আমি যখন এর অগ্নিসংযোগের পলতেটা পরখ করছি, তখনও মনে একটাই ভাবনা কন্যাদের চোখের রং কি হামেশাই মায়ের রঙের হয়? বেগম পরী বানুকে আমি কখনো দেখিনি। তাঁর চোখ জোড়া হয়তো নীলকান্তমণির মতো নীল, প্রস্তরময়।

এ বিষয়ে আরও কিছু জানতে চাইলে বৃদ্ধ ওয়াকিনবিশ খুব বিরক্ত হন। তাঁর কাছে আমার ভাবনাটা তুচ্ছ, ফালতু, যে আমি স্বেচ্ছায় কল্লা দিতে যুদ্ধে যাচ্ছি। তবে রাজমহলের মতো নাখাস্তা জায়গা ছাড়তে পারাটাই, ওয়াকিনবিশের মতে, যে কারও জন্য সৌভাগ্যের। বয়স তাঁর ডানা ভেঙে দিয়েছে। শাজাহানাবাদেও এখন নয়া বাদশা। তাঁর হুকুমদার শাহেনশা অবাধ্য পুত্রের হাতে বন্দী। তিনি মোমবাতি হাতে আমাকে ঘরের কোণে নিয়ে গেলেন। ওখানে সদ্য পোড়ানো এক মুঠো ছাই তাঁর বিরহের কবিতায়। কাগজ পোড়া গন্ধের ভেতর শুষ্ক নয়নে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন।

যুদ্ধের উন্মাদনাটা অন্যরকম। সবাই যেন আমার মতো দাগা খাওয়া, সামনে মৃত্যু জেনেও বিকার নেই। পথে পথে লুটপাট, জনপদ মিসমার করে বাতাসের বেগে এগিয়ে যাও। পেছনের কান্না, ধূলা ছাইয়ের কে খোঁজ রাখে, যেখানে নিজের জানেরই পরোয়া নেই? হুঁশ ফেরে, এলাহাবাদ থেকে তিন মঞ্জিল পর বিরান ক্ষেত্র খাজোয়ায়। ঘন তালসারির আড়ালে বিশাল হ্রদ বেষ্টন করে শাহ সুজার শিবির পড়ে। এর তিন প্রায় ক্রোশ পশ্চিমে কোরাহ নামক স্থানে দুশমন শিবির— শাহজাদা সুলতান মুহম্মদ আগ্রা যাওয়ার পথ রোধ করে রেখেছেন। সত্ত্বর পুত্রের সঙ্গে যোগ দেন সম্রাট আওরঙ্গজেব আর দক্ষিণ থেকে আসে সেনানায়ক মিরজুমলা। যুদ্ধে হারজিত আছেই তা বলে এমন বেদম মার। জানে বাচঁলেও আমি শাহ সুজার খাতা থেকে মুছে গেলাম। তিনিও আর দুই পা এক করতে পারেননি। দুশমন তাড়া করতে করতে খাযোয়ার যুদ্ধের মাত্র তিন মাসের মাথায় তাঁকে গঙ্গার পশ্চিম তীর থেকেও বিতাড়িত করে। আমি রাজমহল ছেড়ে আসার মাস ছয় পর আমার স্থলাভিষিক্ত হন আরেক আশিক। আরেকটা কাহিনীর শুরু রাজমহলের বিপরীত দিকে, গঙ্গার পূর্ব পাড়ে, বাংলার পরিত্যক্ত রাজধানী তান্ডায়।"

ময়ূর সিংহাসন
শাহীন আখতার

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ
সঙ্গের মুঘল ছবিতেঃ শাহ সুজা ও গজ সিং।

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।