সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

"এই মধ্যশরতে প্রান্ত সমতট বঙ্গের এই গ্রামগুলির এক আশ্চর্য নৈশ শোভা হয়। শীতের শেষ মধ্যকাল পর্যন্ত একটা ঘন রহস্যময়তা মানুষের মনে কী গভীর এক মোহবিস্তার করে যেন! শুক্লপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষ নির্বিশেষে, রাত্রির গভীরতা যত বাড়ে, এই শোভা যেন ততই তার রহস্যময়তা বিস্তার করতে থাকে। শরতের শুরুটা এখানে বর্ষারই প্রলম্বিত অধ্যায়। রাঢ়বঙ্গের মতো প্রকৃতিরঙ্গ এখানে দ্রুত সাজ পালটায় না। মধ্যশরতে দু-চারদিন অসম্ভব বর্ষণের পর প্রকৃতি যেন সমতায় আসে। যেন-বা অসম্ভব অভিমানী কোনো মেয়ে দীর্ঘক্ষণ কাঁদাকাটা করে হঠাৎ শান্ততায় স্থায়ী হয়েছে। নদী নালা খালগুলো তখন হঠাৎ তাদের দজ্জালপনা শেষ করে সোজা পথে ধীরগতি হয়। ফুলে-ফুঁসে একে ভাসিয়ে, তাকে ডুবিয়ে, লণ্ডভণ্ড করার বদবুদ্ধি তাদের আর তখন নেই। তখন তাদের আঁচলের পাড়গুলো কেমন যেন আত্মত্যাগে গৈরিক। কারণ অঞ্চলের ওই অংশটুকুর জল তখন বয়ে চলে গেছে। সেখানের ঘাসেরা সব বাদামি বা গৈরিক রঙে রিক্ততার সাজ ধরেছে। জলের এই চলে যাওয়াটাই নদীর আত্মত্যাগ। এরপর থেকেই প্রকৃতির রঙ বদল হতে থাকে।

রাতের আকাশ এ সময় গামর হয়ে ওঠা সদ্য যুবতীর চোখের মতো বড় রহস্যময় হয়। দীর্ঘ বর্ষণের পর নির্মল, শান্ত, গভীর এই আকাশের বুকে তখন নক্ষত্র বুটিদার নীল চান্দেরির প্রদর্শনী।যদি চাঁদ থাকে তো আরও মোহনীয়। জোছনায় সাদা চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রেইন ট্রি, গরান, গেউয়া অথবা চম্বলে শিরিষের প্রগাঢ় মহাসভা যেন এই নিঃশব্দ গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণে ভরপুর করে রাখে প্রকৃতিকে। রাত বাড়ে। তাদের প্রগাঢ়তাও বৃদ্ধি পায়। দূরে কোনো এক নিশাচর পাখির স্থান বদলের পাখার ঝটপট এবং কর্কশ চিৎকার। সন্দেহপ্রবণ কুকুরের অসহিষ্ণুতা এবং দূর থেকে তার প্রতি-চিৎকার। পাশের জলাশয় কিংবা মাঠের জলে শোল, গজাল মাছের উল্লাস। অথবা জিওল পাতা বড়শিতে গেঁথে যাওয়া কোনো হতভাগ্য বোয়ালের প্রাণপণ হুটোপুটির শব্দ। গঞ্জ থেকে দেরিতে ফেরা কোনো গ্রামবাসীর আকুল উচ্চকণ্ঠে গান গেয়ে একা পথ চলার একঘেয়েমি কাটানো---
ও সোনা বন্ধুরে---
আশ্বিন মাসে কত খুশিতে
ভাইধন আইতো নাইওর নিতে
ভরা গাঙে রঙিলা নাও বাইয়া---।"

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
মিহির সেনগুপ্ত

প্রচ্ছদ: তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।