আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

সাধারণভাবে ছেলেরা আর মেয়েরা তখন আলাদা আলাদাই আবীর খেলত। মেয়েরা রাস্তায় বেরিয়ে দোল খেলত না। চকিতে মেয়েদের প্রকাশ্যে রঙ খেলতে দেখা গেলেও এসব ক্ষেত্রে যা চলত, তাকে একটু আধটু লুকোচুরি খেলাও বলা যায়। অর্থাৎ যাদের বিশেষ বিশেষ জনকে আবীর দেওয়ার অবকাশ ছিল, আবীর মাখার বিশেষ বিশেষ ব্রীড়াবনত গাল ছিল--- তাদের কথা আলাদা। নইলে পাশাপাশি দু-চারটি বাড়ির মেয়ে মিলে চলত মেয়েদের দোল খেলা।

সে-সময়ের বিচারে যাকে বলত বাড়াবাড়ি, সেই সীমা-অতিক্রমের ঘটনাও কালেভদ্রে জানা যেত। রঙদোলের পরদিন স্কুলে গেলে শরীরের দৃশ্যমান অংশে ইতি-উতি লেগে থাকা রঙের জন্য অল্পবিস্তর বাক্যবাণ শুনতে হতো। আমাদের অবশ্য কোনো কিছুতেই তেমন তাপ-উত্তাপ ছিল না। কেননা রঙদোল পুরোপুরি সাহসীদের উৎসব ছিল, আমাদের মতো তেমন ডরালু ও ত্রস্ত বালকদের সেসব বালাই ছিল না। আমাদের মত আহাম্মকেরা দোলের দুদিন আগে থেকে নাড়াপোড়ার জন্য শুকনো ডালপালা, কাঠ-পাতা যোগাড় করতাম, পাড়ার নবীন সংঘের এক চিলতে মাঠে সেগুলো স্তূপ করে সাজাতাম। তারপর তাতে  বিশিষ্ট কোনো ডাকাবুকো আগুন দিলে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে নাচতাম। পাড়ার দাদাদের মোম-কুমকুম তৈরির প্রক্রিয়া সম্ভ্রমের সঙ্গে লক্ষ্য করতাম, দোলের দিন সকালে জল বয়ে আনতাম, বড়োদের নির্দেশে বালতিতে রঙ গুলতাম, আর জল বেশি-কম হয়ে যাওয়ার জন্য বকুনি খেয়ে মরতাম, পিচকিরি দিয়ে বেলুনে রঙ-পোরার সময় বেলুন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতাম, কোনো বেলুন ফেটে গেলে মুখ-ঝামটা খেতাম, ভীরু হাতে দু-চারটি রঙ-ভরা বেলুন এর-ওর গায়ে ছুঁড়ে আনন্দে লাফালাফি করতাম, পরিশেষে সর্বাঙ্গে রঙ মেখে মায়ের কাছে অচেনা হয়ে নদীতে স্নান করতে যেতাম। 

তবু আমাদের কারও কারও সুদূর কল্পলোকে কোনো এক ব্যালকনিতে জেগে থাকা দুটি চোখ, রঙ-বেলুন থেকে আত্মরক্ষায় সচকিতে ঘরে ঢুকে যাওয়া দুটি ত্রস্ত পায়ের কথা মনে পড়ত। কার সলাজ-চোখদুটির দিগন্তে নেমে-আসা পল্লবের কথা মনে আসত কোন্ আহাম্মকের? এখন ফুরিয়ে গেছে রঙ, হারিয়ে গেছে দোল---শুক্লপক্ষের শেষদিনের সেই 'কৃষ্ণ-অরূপতা'টুকু তার স্থায়ী চিহ্ন নিয়ে জেগে আছে শুধু।

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৮০ টাকা
প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।