ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার

"তান্ডার গোপন দরবারকক্ষে আমি শাহ সুজা ধড়াচূড়া পরে বসে আছি। চোখের পাতার মতো আমার মাথার তাজও ভারি। মোতির ঘেরের পাগড়িটা কপালে আঁট হয়ে থাকায় নিজেকে ন্যুব্জ আর কমবুদ্ধির নাকেস আকেল মনে হলো। আমি পিঠ টান করে মাথার তাজ ঠেলে দিই পেছনে। সুলতান মুহম্মদ উবু হয়ে নজর পেশ করে। বিশাল রুপোর খাঞ্চায় গোলকুণ্ডার মস্তবড়ো হীরকখণ্ড ঘিরে কবুতরের রক্তবিন্দুর মতো ফোঁটা ফোঁটা চুনি আর ছোটো ছোটো জ্বলজ্বলে অসংখ্য হীরা। খাঞ্চার কিনারা আশরাফি মোহরে থাক থাক করে সাজানো হয়েছে। সঙ্গের উপহার দামেস্কের কারুকাজময় তলোয়ার-জোড়া খানসামার হাতে দিয়ে আমি ফের খাঞ্চার দিকে তাকাই। পাথরের দাম যাচাই করি মনে মনে। সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে—‘অর্থস্য পুরষো দাস, নার্থ্যা দাস কদাচন।' জঙ্গের বেলায় তো কথাই নেই। খোদার অশেষ দয়া আর এই মণি-কাঞ্চনের জোরেই তো আমি দেড় সন যাবত জঙ্গ-জেহাদে টিকে আছি। মদিরার সুবাদে মনটা নরম হয়ে ছিল, উঠে দাঁড়িয়ে সুলতান মুহম্মদকে আলিঙ্গন করলাম। আমার বুকে নীড় খসা পক্ষীছানার মতো কাঁপছে ছাওয়াল, আমার ভ্রাতুষ্পুত্র, আমার রিশতাদার। চোখে জল এসে গেল।

আমার পাশের কুরসিতে হাঁটু মুড়ে বসেছে মুহম্মদ। কোলে হাত। চোখ আনত। পাগড়ির মধ্যিখানের মরকত মণি আরেকটা চোখের মতো কপালের ওপর জ্বলজ্বল করছে। অবিকল আওরঙ্গজেবের মুখের গড়ন—টিকলো নাক, ধারালো চিবুক। তবে সেই রকম সফেদ হয় নাই। রাজপুত মা নওয়াব বাঈয়ের তামা-বরণ পেয়েছে। চোখের মণিও মায়ের মতো আগুনরঙা। শেষবার দিল্লির শাহি কেল্লায় মুহম্মদকে যখন দেখি, তখন ও তেরো বছরের নওল কিশোর। গলার স্বর সবে ভাঙতে শুরু করেছে, পাতলা মিহি দাড়ি-গোঁফে তখনও খুর পড়েনি। সে সময় সুলতান মুহম্মদের সঙ্গে আমার কন্যা গুলরুখ বানুর শাদির খুচরা আলাপ হয়।

সময়টা তখন খুব খারাপ যাচ্ছিল। এক যুগ পুরা না-হতে কিল্লা কান্দাহার ফের বেহাত হয়ে গেছে। হিন্দুস্থানের প্রবেশদ্বার কান্দাহার। তাই এর পাথুরে কিল্লার দখল নিয়ে সাফাবি আর তৈমুরিদের যোজাযুজি সেই আদ্যিকালের। বারবার তা হাত বদল হয়েছে। রক্তও ঝরেছে বিস্তর। ইসায়ি ১৬৩৮ সনে পারস্যের কিল্লাদার আলি মর্দান খান গদ্দারি করে কিল্লা তুলে দেন বাদশাহ শাহজাহানের হাতে। সেই শুভক্ষণে মুঘলশাহির তরফে হাজির ছিলাম আমি, বাইশ বছর বয়সী শাহজাদা। সঙ্গে মির্জা রাজা জয় সিংহ। থলচেটিয়ার পাহাড়ি পথের ধারে রঙিন ফুলের বাহার, ছোটো ছোটো উজ্জ্বল ঝরনা আজও চোখে ভাসে। হেলমন্দের তীরে কিন্না কান্নাহার হাতির মতো শুঁড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জঙ্গের ঝক্কি নেই, মুফতে কেল্লা ফতে। উত্তরের বেড়া দেওয়া দ্রাক্ষাকুঞ্জ, তরমুজখেত দখলে চলে আসে। তখন আওরঙ্গজেবের নাম-নিশানাই ছিল না। এর পর যখন কিল্লা কান্দাহার ফের পারস্যরাজ্ঞের দখলে চলে যায়, আওরঙ্গজেবকে ফৌজিপ্রধান করে পাঠানো হয়। কাঁড়ি কাঁড়ি বাদশাহি মোহর আর অজস্র লোকক্ষয় হলেও কিল্লা বেদখলই রয়ে গেল। দ্বিতীয় দফায় আব্বাহুজুরের ফরমান পেয়ে আমি রাজমহল থেকে সসৈন্য এগিয়ে গেলাম। নদীতে ভাসানো হলো বাংলার বেশুমার বোরাক বাঁশ, যা দিয়ে কিল্লায় চড়ার মই গড়ানো হবে। সব ঠিকঠাক। লাহোর তক গেছি, শাহেনশার কী মর্জি, এবারও কিল্লা অবরোধের সিপাহসালার আওরঙ্গজেব। তা বলে পেঁচার মতো মুখ ভার করে থাকা বাড়ে নেই আমার। দিনে রাভির স্বচ্ছ জলে মাছ শিকার, রাতে তাঁবুতে তাবুতে হীরামান্ডির সেরা নাচনেঅলিদের মনকাড়া নাচ-গান। সেসবেরও একদিন মেয়াদ ফুরোলো। আমি শিবির গুটিয়ে দিল্লি রওনা হলাম। আওরঙ্গজেব তখন কিয়া কাপাহারের ঘেরাও উঠিয়ে সেনা-সামন্ত নিয়ে ফিরছিল। দিল্লির উপকণ্ঠে আমাদের পাশাপাশি তাঁবু পড়ে। আওরঙ্গজেব তখন ফুটন্ত সুরুয়ার মতো টগবগ করছে-গোলায় বারুদের আঁটুনি যুৎসই হয়নি, বেকার কামান দাগাই সার, তা না হলে সে নাকি কিল্লা জয় করেই ফিরত। আক্ষেপে আমিও মাথা নাড়ি। আওরঙ্গজেব বাহাদুর তো, তা হবেও বা। রাতে পিচফল, সিরাজি, বেলেহাঁসের কাবার সহযোগে সে ভোজের আয়োজন করে। খানা পিনার আড়ালে ভায়ে- ভায়ে গোপন বৈঠক। ঘরে দুসরা কোনো প্রাণী নেই। আমি সিরাজির ঘোরে জড়িয়ে জড়িয়ে কথা কইছিলাম। বেশরাবি আওরঙ্গজেব দাঁতে দাঁত ঘষে। দারার কী গুণ আছে, যা আপনার নেই? আচমকা আওরঙ্গজেবের প্রশ্ন শুনে আমি হতচকিত, হাতের পেয়ালা নামিয়ে মাথা চুলকাতে থাকি। নিজের গুণের হদিস পাই না। তখন নিশি রাত। অদূরে থেমে থেমে পেঁচা ডাকছে। কথা বলতে গিয়ে নিজের গলার স্বরে চমকে উঠি আমি। মালুম নেই তখন কী বলতে কী বলেছিলাম। আওরঙ্গজেবকে বিরক্ত মনে হলো। কিন্তু রাত তো বেশি বাকি নেই। সহসাই সুলতান মুহম্মদ আর গুলরুখের শাদির টোপ ফেলে আওরঙ্গজেব। এর নেপথ্যের অনুঘটক যে বোন রোশনআরা, পরে শুনেছি। আমরা যখন সিনায় সিনা মিলিয়ে বিদায় নিচ্ছি, ততক্ষণে জঙ্গলের পাখ পাখালি ডাকতে শুরু করেছে। মাত্র সাত সন আগের কথা। মনে হয় আরেক জন্মের কাহিনী।"

ময়ূর সিংহাসন
শাহীন আখতার

মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।