আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

গোটা গরমকাল ধরে আমরা সকালের পান্তাভাতে তো বটেই— নানাভাবে কাসন্দ খেতাম। কাসন্দ মা কিনতেন বাড়িতেই। কাসন্দ যিনি দিতে আসতেন তাঁর চেহারাটি ছিল দেখবার মতো। রোগা, অস্থিসার চেহারা। গায়ের রঙ ছিল একবারে উজ্জ্বল আভাযুক্ত কালো—পরে বুঝেছি এটাকেই সম্ভবত উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলে। তিনি রাস্তায় ‘কাসন্দ’ হেঁকে যেতেন। সেই হাঁকের লিপ্যন্তর করা অসম্ভব। প্রথমে সামান্য টেনে কা.... তারপর আরও সামান্য টানে সন্.... তারপর সহসা একটি শ্বাসাঘাতে দ্ঃহ্। তারপর পুনরাবৃত্তির সময়—‘কাসন্দ নেবে নাকি গো-ও, কা..., সন্... হ্।

তাঁর মাথায় থাকত ভেতর-দিকটা গোবর-মাটিতে নিপুণভাবে নিকোনো একটি বেতের ধামার মধ্যে বসানো কাসন্দর মাটির হাঁড়ি। হাঁড়িটির বহিঃগাত্র একেবারে যাকে বলে তৈলচিক্কণ, তা-ই। পরনে অতি-সাদা খেটো ধুতি আর হাতাওয়ালা অতীব ফর্সা গেঞ্জি। তাঁর কোমরটি বয়সের ভারে সামান্য ঝুঁকে এসেছে সামনের দিকে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাঁকে কখনও ধামা সামলানোর জন্য হাতদুটিকে ব্যবহার করতে দেখা যেতো না। হাঁড়িসহ ধামাটি মাথায় গামছার বিড়ের ওপর অবিচলিতভাবে শোভা পেতো। বাড়ির দরজায় এসে তিনি হাঁক দিতেন—কৈ গো মা!’

মা হয় একটি কলাই-করা কাঁসি বা চিনামাটির বাটি নিয়ে হাজির হতেন দরজায়।

সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে ধীরেসুস্থে মাথা থেকে হাঁড়িসহ ধামাটি নামিয়ে তিনি জুৎ করে বসতেন, তারপর আরও ধীর লয়ে শুরু হতো বিকিকিনি। তাঁর চরিত্রে কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো, তর্ক-বিতর্ক, কোলাহল ছিল না। মায়ের আনা পাত্রে তিনি নারকেলের খোলার মাঝখানে একটি বেতের অতি-মসৃণ বাঁশের কাঠি ঢোকানো হাতা দিয়ে হাঁড়ি থেকে মেপে কাসন্দ দিতেন। মায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে নিজের কোমরের ধুতির বাঁধন থেকে গেঁজেটাকে মুক্ত করে তার মধ্যে পয়সাটা রাখতেন, তারপর গেজেটা যথাস্থানে গুঁজে এবার আমাদের, মানে তাঁকে ঘিরে ধরা ছোটোদের দিকে মন দিতেন। তখন আমাদের তিন-চারটি ডানহাত তাঁর দিকে প্রসারিত। আবার হাঁড়ির মুখের মাটির সরার ঢাকনাটা খুলে তাঁর ঐ হাতা দিয়ে হাঁড়ি খুঁটিয়ে খুঁজে পেতে তুলে আনতেন ছোটো ছোটো আমসির টুকরো। সামান্য কাসন্দ-মাখানো সেই আমসি দিতেন আমাদের প্রসারিত হাতের তালুর গর্তে। আর মুখে বলতেন—'হাত টাত পয়ঃপোষ্কার তো?'

আমরা প্রায়ই তাঁকে একটা প্রশ্ন করতাম, উত্তরটা জেনেও ‘এমন কাসন্দ কে বানিয়ে দিল গো?'

বিস্ময়জনক হলেও উত্তরটা একই ছিল— 'আমার মা গো। আমার মা ছাড়া এ ‘পৃথিমী’তে আর কেউ কি এমন কাসন্ বানাতে পারে গো! তাঁর নিজেরই বয়স আন্দাজ করা যেতো না, বছরের পর বছর আমাদের চোখে তাঁর বয়স বাড়তোও না— তবু চমক লাগতো আমাদের—এই মানুষটিরও মা! তাঁর আবার কত বয়স কে জানে! তিনি অনন্তকাল ধরে তাঁর সন্তানদের জন্য অতুলনীয় কাসন্দ বানিয়ে চলেছেন!

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।