মগ্নপাষাণ। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

"কাকন্দ জানে, কুমার বড় অস্থির হয়েছিলেন কিছুদিন যাবৎ।
ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমুৎপীড়নে মাণবিকা আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়েছিল। কিন্তু কুমারের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। পরাজয়ের গ্লানি কুমারের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করেছিল।
এই সময় এক গুপ্তচর এসে জানাল, অবন্তীর আগে আর কুমারের অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। সম্রাটের আদেশে মগধের সকল পথ অবরোধ করে সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। কুমার যেন রাজধানীতে প্রবেশ না করেন।
কুমার ও কাকন্দ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কাকন্দ বললেন, হঠাৎ কেন এই ব্যাবস্থা বুঝতে পারছি না।
কুমারেরও ললাটে ভ্রূকুটির কুঞ্চন। তিনিও সম্ভবত এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যমনস্ক ভাবে বাঁশিটি নিয়ে গিয়ে বসলেন টিলার উপরে। শুরু হলো আত্মবিস্মৃত সুরবিস্তারে কোনো অজামার অন্বেষণ।

অবন্তীকার আকাশে পুনরায় সৌদামিনী হেসে উঠলেন, গুরুগম্ভীর মেঘডম্বরে আর একবার কম্পিত হলো চরাচর। তীব্র হাওয়ার স্বননে বাঁশির সুর আর শোনা যায় না। ঘনঘোর অম্বুজভারে সারা আকাশ সমাচ্ছন্ন হলেও পশ্চিম দিকের মেঘের একফালি কিনারায় রৌদ্রকর বিচ্ছুরিত হয়ে আশেপাশের ধূসর প্রেক্ষাপটে রচনা করেছে এক অপার্থিব জ্যোতির্বলয়। কুমার বাঁশরি থামিয়ে সেই দিকেই সম্মোহিতের মতো চেয়ে ছিলেন।
অনতিদূরে প্রচণ্ড শব্দে এক বজ্রপাত হলো উন্মত্ত পবনে বেপথুমানা একটি বৃক্ষে। বৃক্ষটি ক্ষণিকের মধ্যে অগ্নিপিণ্ডে পরিণত হলো। তখনই নামল আকাশ ভেঙে বৃষ্টি।
উঠে দাঁড়িয়েছেন কুমার। কুমারের বদ্ধমূল ধারণায় বড় কঠিন আঘাত লেগেছে। ঘৃণিত ব্রাহ্মণ্যবাদের শিকার হয়েছে অসহায় বৈশ্য-বিধবা মাণবিকা। তাকে রক্ষা করতে পারেননি কুমার। তাই শিবশক্তির আরাধনায় ব্যাপৃত তিনি আজ। আহত শার্দূল বুঝি আহ্বান করছে ধ্বংসেরই দেবতাকে।

কাকন্দ বলে, এ দুঃসাহসের কি কোনো প্রয়োজন ছিল কুমার?
কুমারের মুখে যুদ্ধজয়ের হাস্যাভাস, অনিশ্চয়তার দ্বদন্দ্বজনিত গ্লানি আর নেই। অবিচলিত তরল স্বরে তিনি বললেন, ছিল কাকন্দ, দুঃসাহস নয়, এ হলো আত্মশক্তির পরীক্ষার দুর্লভ সুযোগ। শিবশক্তির মন্ত্রদীক্ষা এভাবেই হয়। জয়-পরাজয় এখানে গৌণ। কেননা, জয়ী হলে দেবাদিদেব প্রদত্ত পথনির্দেশের পুরস্কার। পরাভবে অক্ষয় স্বর্গ। উভয় দিকেই বীরের সদগতি।
-- তোমার ভয় হয় না কুমার?
-- হয়। কিন্তু সে ভয়কে জয় করবার একটা অসম্ভব আগ্রহ আমাকে গ্রাস করে, মুখে অপ্রস্তুত হবার হাসি ফুটিয়ে কুমার বললেন, কী জানো কাকন্দ, এটা একটা বিশ্বাস। একটা প্রত্যয় বলতে পারো যে, ধ্বংসের দেবতা শুধু ধ্বংসই করেন না-- তিনি সৃষ্টিও করেন। কিন্তু তত্ত্বকথা থাক। হে আচার্য, এখন আমার প্রয়োজন এই সিক্ত বস্ত্র ত্যাগ করার। একখানা অন্য পরিধান দিতে পারো কাকন্দ?
-- আমার কাপাশতন্তুর একটা সাধারণ বস্ত্র দিতে পারি। কিন্তু তা রাজকুমারের উপযুক্ত নয় বোধহয়।
-- না হোক। আপাতত শুধু সেটা শুষ্ক হলেই চলবে।
বস্ত্র পরিবর্তন করতে করতে কুমারের ওষ্টাগ্রে হাস্যরেখা দেখা দিল। তিনি বললেন, আমি কিছু কিছু অনুমান করছি কাকন্দ। বিদ্রোহ-সংক্রান্ত কোনো অসত্য বার্তা মগধেশ্বরের গোচর হয়েছে। তাই এই সাবধানতা। সামনে কঠিন পরীক্ষা আছে।
কাকন্দ কিছু বললেন না। হয়তো মনে মনে কুমারের চিন্তার গতিপথ অনুসরণ করতে চাইছিলেন। কুমারই পুনরায় বললেন, অবিলম্বে আমার পাটলিপুত্রে যাওয়া প্রয়োজন।
সে পথ তো বন্ধ। কুমার কি তবে সম্মুখসমরের প্রস্তাব দিচ্ছেন? কুমারের বিস্মিত দৃষ্টি অনুসরণ করেই যেন কুমার বললেন, ভয় নেই কাকন্দ, আমি পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না। সৈন্যদল তো ফিরে গেছে। আমরা কজনই শুধু রাজধানীতে যাব। বিকল্প পথের সন্ধান করো প্রহরী। শুনেছি দক্ষিণদিকের পার্বত্যভূমির পারে তিন্দারি বলে এক জনপদ আছে। সেখানে কোনোভাবে পৌঁছে গেলে কলিঙ্গের পথে মগধে যাওয়া সম্ভব।
-- মগধনরেশের আদেশের বিরুদ্ধে সেটা অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া হবে না?
-- হবে, কিন্তু উপায় নেই কাকন্দ। কুমারের ভ্রূকুটি সরল হয়নি, উপরন্তু মুখের হাস্যাভাস অন্তর্হিত হয়েছে। মনস্থির করেই যেন বললেন, আমাদের আজ রাতেই রওনা হতে হবে। কাকন্দ, তোমার তো কোনো বাধা নেই। তুমি সরাসরি পাটলিপুত্রে প্রস্থান করো। পিতাকে সত্য অবগত করাও। আমি তিন্দারিতেই থাকব। প্রয়োজনে সেখানেই যোগাযোগ কোরো।"

📕📕📕
খ্রিস্টজন্মের দুশো সত্তর বছর আগে মগধের সিংহাসনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বিন্দুসার-পুত্র অশোক। ধর্মরাজ্য স্থাপনের সংকল্প নিয়ে মৌর্যসম্রাট প্রিয়দর্শনের সম্রাট অশোক প্রিয়দর্শী হয়ে ওঠার সে অনুপম গাথা ভাস্বর করেছে ইতিহাসের পাতা। কিন্তু সে পৃথক প্রসঙ্গ।
অশোক বিন্দুসারের কোনো অখ্যাত রানির পুত্র। মাতৃকুলে ছিল না রাজরক্তের কৌলীন্য। কোনোমতেই তিনি হতে পারেন না পিতার রাজ্যের নৈসর্গিক দাবিদার। সম্রাট বিন্দুসার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী চয়ন করেও যাননি। সেক্ষেত্রে সর্বার্থেই তাঁর অগ্রমহিষীর পুত্র সুসীমের সিংহাসনে বসবার কথা। 
অথচ চার বছর পরে অভিষেক হয়েছে অশোকের। কিন্তু কীভাবে জ্যেষ্ঠভ্রাতা সুসীমকে অতিক্রম করে কনিষ্ঠকুমার সিংহাসনে আসীন হলেন, তা আজ বিস্মৃতির অন্ধকারে। ইতিহাস ঐ চতুর্বর্ষব্যাপী অশান্ত ঘটনাপঞ্জীর কোনো বিশ্বস্ত বয়ান সঞ্চয় করে রাখেনি। হিরণ্ময় নৈঃশব্দে মূক হয়ে আছে মহাকালখণ্ডটি। দুইপ্রান্তের আলোকিত সূত্রগুলির ঐতিহাসিক গ্রন্থিটি অদৃশ্য এক অপার্থিব অন্ধকারে।
ঐতিহাসিকদের একটা সহজবোধ্য অনুমান হল ভ্রাতৃবিরোধ। সিংহাসন দখলের লড়াই চলেছিল চার বছর। ভাই-এ ভাই-এ হানাহানি।
বৌদ্ধ গ্রন্থে আছে কুলকলঙ্কের কিছু রক্তাক্ত ইঙ্গিত। পুরাণ-গ্রন্থাদিতেও সম্রাট আত্মীয় হননকারী রূপে উক্ত। সেখানে বলা আছে, বহু ভ্রাতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল তাঁর হাত। রাজ্যলাভের নিমিত্ত অশোক মেতে উঠেছিলেন অনধিকার ক্ষমতার প্রয়োগে। হিংসার আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। বয়েছিল অগণিত শোণিত-ধারা।
কিন্তু শিলাকীর্ণ অক্ষরগুলি যে আজও রয়ে গেছে ! তারা মিথ্যে বলতে পারে না। দুই সহস্রাব্দীরও বেশি সময়ের শীত-গ্রীষ্ম ঝঞ্ঝাবৃষ্টি পেরিয়ে সেগুলি পৌঁছে দিয়েছে সুদূর অতীতের কিছু অকপট বার্তা।
জড় পাথরের মাঝে উন্মোচিত হয় সুদূর অতীতের আলোকিত ইতিহাস। কোনো এক প্রিয়দর্শী রাজার হৃদয়মোক্ষণ করা আত্মোপলব্ধ জীবনদর্শন! এক দিগ্বিজয়ী সম্রাট-কথিত অনাহত শান্তির বাণী।
বহু ভ্রাতৃরক্তে হাত রঞ্জিত করে সিংহাসনে আরোহণ এবং কলিঙ্গ যুদ্ধের গণহত্যার শোকে অস্ত্র ত্যাগ।-- প্রচলিত ইতিহাস-ভাষ্যের এই দুই বৈপরীত্য মিলবে কীভাবে? 
রহস্যাবৃত ঐ চতুর্বর্ষতেই উত্তর রয়েছে সব প্রশ্নের। 
সে-সব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ঐতিহাসিক আখ্যান, 'মগ্নপাষাণ'। 

মগ্নপাষাণ
সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৬৬ টাকাা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।