ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার


"ঘুম ভেঙে দুঃখ হচ্ছিল, জিন্দা থাকতে কেন দারা শিকোর সঙ্গে আমার মিলন হলো না? একে অন্যকে এমন মধুর ভাষায় সম্ভাষণ? এ তো খোয়াব, ভাইয়ে ভাইয়ে স্পর্শাতীত মোলাকাত। কতকাল আগে আমি দারা শিকোর চেহারা দেখেছি। মরার আগে অর্ধপলিত কেশ-দাড়িতে তিনি কেমন হয়েছিলেন দেখতে? চামড়ায় বয়সের দাগ ছিল বা হাসিতে দমের ঘাটতি? মানুষ মরে গেলে ইহলোকের কেউ থাকে না, পরলোকের বাসিন্দা হয়ে যায়। আজ যদি আনমনে আমি তাঁর কণ্ঠ শুনি, সে দাউদ নবীর মতো মধুর হলেও মনে হবে আমার ভাইয়ের নয়, এ কোনো গায়েবি আওয়াজ।


রাত ভোর হতে কত দেরি? আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। রাজমহল পাহাড়ের গায়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত মেঘ, মরা জ্যোৎস্নায় কেমন ভয়াল দেখায়। বাগানের বৃক্ষরাজিও ভূতুড়ে, যেন মৃদু বাতাসে ফিসফিসিয়ে কথা কইছে। সবখানে চাপা স্বর—জিন নয়তো ইনসানের। আমি কি এখনও খোয়াব দেখছি? একবার মনে হলো পাঙ্খাবরদার বা খানসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, রাতের প্রহর কত, প্রসাদের প্রহরীরা কি ঠিকঠাক পাহারা দিচ্ছে? মির্জা জানি বেগ কেল্লায় আছেন না তাঁর নিজস্ব হাবিলিতে ফিরে গেছেন? পশ্চিমাকাশের জ্বলজ্বলে তারাটির মতো আমিও যে আজ রাতে একা। আমার কাউকে চাই। কারও ভরসা চাই। সহসা আব্বাহুজুরের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ মনের পর্দায় ভেসে ওঠে—বাদশা ফারদুনের মতো পুত্রের হাতে পুত্র খোয়ানো শোকার্ত এক বন্দী পিতার। বহু বছর পর পুত্র ইরাজের খুনের দাদ তোলার মওকা পেয়েছিলেন ফারদুন। দুনিয়ার মাটিতেই হত্যাকারীর সাজা হয়েছিল। স্বয়ং আল্লাতালাও রোজ হাশরের শেষ বিচারের জন্য সর্বদা অপেক্ষা করেন না। তবে তাঁর হাতে নাতে বিচার শাহনামার যুগেই হয়তো সম্ভব হতো। তখন এমনকি কোনো কোনো রাজরাজার পরমায়ু ছিল সহস্র বছর। আব্বাহুজুর তো যাট পেরোতেই ওপারের ডাক শুনছেন। বেচারি আম্মিজান। কত কম বয়সে আয়ুর পালক ছিন্ন করে কবরে শয্যা নিলেন। সেই মৃত মায়ের পেটের ভাই ছিলাম আমরা, বিবি হাওয়ার পুত্র হাবিল-কাবিলের মতো। ভ্রাতৃহত্যার দায়ে কাবিলকে আল্লাতালা ত্যাগ করলেন, তাকে বারো বছরের জন্য জন্য ফেরার হতে হলো। ফেরদৌসি তুমির শাহনামায় পড়েছি, যে ভাই ভাইকে হত্যা করে, এক ভৃঙ্গার শীতল পানির জন্য তাকে ছোটাছুটি করে মরতে হবে।


এ ইহলোক না পরলোকের সাজা?


এসব নিয়ে চুলচেরা ভাবতে ইচ্ছা করে না। মনে মৃত্যুভয় চলে আসে। আমি ঘরের পর্দা টেনে দিয়ে খানসামাকে ডাকি। ওকে কি শরাব-পেয়ালা সাজাতে বলব? তাতে ফায়দা কী। আজকাল ওসব পানিতুল্য, কোনো নেশাই হয় না। আমি দারার রুহের সম্মানে বস্ত্রালঙ্কার সরিয়ে শোকবস্ত্র পরিধান করি। তাতে মনে খানিকটা শান্তি ফিরে আসে। বুড়ো খানসামা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে যায়, দারা শিকোকে যদিও সে জন্মে দেখেনি। কাঁদুক। যারা বুকে পাষাণ-চাপা দিয়ে আছে তারাও কাঁদবে, কালো বস্ত্রে আমাকে খোয়াবগাহ থেকে বেরোতে দেখলে। দারা গত হয়েছেন হপ্তা দুই পেরিয়ে গেছে। চল্লিশ দিনের দিন রাজমহলে তাঁর চেহলাম হবে, পেটপুরে ভোজ খাবে গঙ্গার ঘাটের সব ভুখা-নাঙ্গা মানুষ, আমি যদি ততদিন জিন্দা থাকি।"



ময়ূর সিংহাসন
শাহীন আখতার  

মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।