পল্লীগ্রামের রথতলায়। সেকালের সমাজচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা
জমিদার মুখুয্যে-বাড়ির বাহিরের প্রাঙ্গণে যে বিস্তীর্ণ স্থানটি ফাঁকা পড়িয়া থাকে, সেই স্থানে দোলে, রথে মেলা বসে। মুখুয্যেবাবুদের এখন ভগ্নাবস্থা, তাঁহাদের জমিদারির অধিকাংশ বিক্রয় হইয়া গিয়াছে, যাহা অবশিষ্ট আছে, তাহাও কুড়ি-পঁচিশ শরিকের মধ্যে বিভক্ত। অর্থাভাবে কোনো শরিকই উৎসবে এখন আর পূর্বের ন্যায় সমারোহ করিতে পারেন না। অনেককাল পূর্বে তাঁহাদের প্রকাণ্ড কাঠের রথ ছিল। একবার অগ্নিকাণ্ডে সেই রথ পুড়িয়া গিয়াছিল, কেবল কাঠের চাকাগুলি ও অশ্বযুগল অগ্নিমুখ হইতে রক্ষা পাইয়াছিল। এখন প্রতি বৎসর পাঁচ-তালা বাঁশের রথ প্রস্তুত হয় এবং চাকাগুলি ও ঘোড়া-দুইটি তাহাতেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
কাকার সঙ্গে রথতলায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, মুখুয্যেবাবুদের গৃহদেবতা গোপালদেব রথে আরোহণ করিয়া তাঁহার সিংহাসনে উপবিষ্ট। নানাপ্রকার পত্রপুষ্পে এবং ফুলের মালায় রথখানি বিভূষিত। আঙিনার অদূরবর্তী প্রশস্ত রাজপথে রথ আনিয়া রাখা হইয়াছে। রথের প্রত্যেক তালায় এক-এক দল বালক-বালিকা সারি দিয়া বসিয়া টানের প্রতীক্ষা করিতেছে এবং স্টিমারের কাছি অপেক্ষাও স্থূল দড়া দুই গাছার, প্রত্যেকটি বোধহয় ত্রিশ-বত্রিশ হাত দীর্ঘ-- পঁচিশ-ত্রিশ জন গ্রামবাসী রথে-আবদ্ধ দড়া ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। যাঁহার পালি, তিনি গোপালের বৈকালীর আয়োজন শেষ করিয়া বাহিরে আসিবেন, তিনি আদেশ করিলে ঐ সকল লোক রথ টানিয়া লইয়া যাইবে এবং গ্রাম ঘুরিয়া সন্ধ্যার পর রথতলায় ফিরিয়া আসিবে। রথ সেখানে প্রত্যাগমন না-করা পর্যন্ত রথতলার মেলায় লোকের ভিড় সমানই থাকিবে।
মেলায় নানা প্রকার পণ্যদ্রব্য বিক্রয় হইতেছে। তন্মধ্যে সোলা-নির্মিত সুরঞ্জিত নানা বর্ণের পাখি, ডুলি, পালকি, নর-নারী, জীবজন্তু, গ্রামের কুমারদের নির্মিত সুচিত্রিত ছোটো ছোটো ঘট, ছোবা, ভাঁড়, ফল, নানাপ্রকার পুতুল, দেব-দেবীর মূর্তি, গ্রামস্থ কর্মকাররা স্থানে স্থানে বসিয়া হাতা, বঁটি, ছুরি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্র বিক্রয় করিতেছে। কোথাও আম, কাঁঠাল, পাকা কাঁকুড়ের স্তূপ দেখিলাম। প্রচু পরিমাণে পাকা কাঁকুড় (ফুটি) বিক্রয় হয় বলিয়া এই উৎসব অনেক স্থানে কাঁকুড়ে পরব নামে অভিহিত। পথের ধারে অদূরবর্তী বটতলায় একজন শ্বেতাঙ্গ মিশনারি বক্তৃতা শেষে বিশ্রাম করিতেছেন এবং তাহার সহকারী স্যামুয়েল বিশ্বাস এক পয়সা দামের একটি ক্ষুদ্র নাড়ুগোপাল হাতে লইয়া নবাগত দর্শকগণকে তাহা দেখাইয়া বক্তৃতা করিতেছে-- 'ইহা তোমরা দেবতা মনে করো, কিন্তু আমি ইহা মাটিতে ফেলিয়া দিলেই ভাঙিয়া যাইবে। ঐ রথে এইরূপ যে পুতুলটি বসিয়া আছে, তাহা পাথরের; কিন্তু রথ হইতে নীচে ফেলিয়া দিলে তাহাও ভাঙিবে, ইহা কখনও ভগবান হইতে পারে না, যদি ভগবানকে পাইতে চাও, তাহা হইলে সদাপ্রভুর একজাত পুত্র যিশুর ভজনা করো, তিনি অন্তত নরক হইতে তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন।'-- তাহার পর তাহারা তিন-চারিজন সমস্বরে গান আরম্ভ করিল--
'বেথেলহেমে হইল যিশু চন্দ্রের উদয়,
গায় সবে ধরাবাসী জয় জয় জয়।'
কিন্তু দর্শকগণ সে গান না শুনিয়া 'মালামোর' আঙ্গিনার চারিদিকে সমবেত হইল। রথতলার এক পাশে অনেকখানি স্থান বাঁশের বাখারি দিয়া ঘিরিয়া রাখা হইয়াছিল ; সেই স্থানে বিভিন্ন গ্রামের মল্লগণ 'মালামো'(মল্লযুদ্ধ) করিতে আসিয়াছিল। এক-এক জোড়া মাল তাল ঠুকিয়া এবং উরুদেশে চপেটাঘাত করিয়া পরস্পরকে আক্রমণ করিবার জন্য সেই ঘেরের ভিতর ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
দর্শকগণ ঘেরের চারিদিকে কাতার দিয়া দাঁড়াইয়াছিল, তাহাদের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া মালামো দেখিবার উপায় ছিল না, এজন্য কাকার সঙ্গে অদূরবর্তী দোতালায় উঠিলাম। উহা জমিদারদের বৈঠকখানা। কাকার বন্ধু নীলকান্তবাবু এই বৈঠকখানার মালিক, সুতরাং তাঁহার দোতলার বারান্দায় বেঞ্চিতে বসিয়া মল্লযুদ্ধ দেখিবার অসুবিধা হইল না। তখন রথ-টানা আরম্ভ হইলয়াছিল। বহু দর্শক রথের সঙ্গে বাজারের দিকে চলিল। ঢাকীরা পাখাওয়ালা ঢাক বাজাইতে বাজাইতে রথের আগে চলিল, তাহার পরেই মুখুয্যে-পাড়ার সংকীর্তনের দল। দুই জোড়া খোল 'বুজতা-বুজাং বুজতা-বুজাং' শব্দে বাজিতে লাগিল, সঙ্গে সঙ্গে গায়কের দল মাথা নাড়িয়া টিকি দুলাইয়া নাচিয়া-নাচিয়া গাহিতে লাগিল--
'গোবিন্দ গোপীনাথ মদনমোহন দয়া করো হে!'
পল্লীগ্রামের রথতলায়
সেকালের সমাজচিত্র
দীনেন্দ্রকুমার রায়
সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সৌজন্য চক্রবর্তী
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৫০ টাকা
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment