নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

ভাঙা পাঁচিলের ইঁটের ফাঁক থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বার করলো পচা। তারমধ্যে রাখা আছে জামা প্যান্ট। ঝটপট করে স্কুলের ড্রেস খুলে অন্য জামা কাপড় পরে পালটে নিল নিজেকে। চোখে দিল হাল ফ্যাশানের রোদ চশমা। গলায় কলারের নীচ দিয়ে বাঁধলো একটা ফুল ফুল রঙের রুমাল। পকেট থেকে বার করলো শস্তার জেসমিন সেন্ট। জামার হাতায়, কলারে বুলিয়ে নিলো একটু। এমন ভাব করছে যেন শুধু মাথায় টুপিটাই নেই। থাকলে এক্ষুনি হয়তো “তিরচি টোপিওয়ালে...” গান ধরতো। নাসিরুদ্দিনের মতো টুপি উড়িয়ে দিতো হাওয়ায়। আমার দিকে তাকিয়ে পচার সম্বিত ফিরলো যেনো। “কী রে চেঞ্জ কর।” আমি আকাশ থেকে পড়ি। কী চেঞ্জ করবো? পচা জানতে চায় “ব্যাগে তোর কোন এক্সট্রা গেঞ্জি নেই? বা জামা?” স্কুলে আসার সময় একমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া আমরা কেউই জামা কাপড় সঙ্গে আনি না। ভিজে গেলে অনেক সময় ছাড়াই হয় না সেই জামা। বিরক্ত হই। কোন কিছুই নিয়ে আসিনি আমি। নিজে সাজবি সাজ। জামা পাল্টাতে হলে আমি যাবো না। ফিরে যাওয়ার একটা মোক্ষম সুযোগে এলো আমার কাছে। কিন্তু পচা কিছুতেই ছাড়তে চাইলো না। পাঁচিলের আরও খান তিনেক ইঁট সরিয়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বার করলো সে। তারমধ্যে দেখলাম কয়েকটা গেঞ্জি, জামা রাখা। বুঝতে অসুবিধে হলো না এটা ওদের একটা গোপন ঠেক। এখান থেকেই ভোল পালটে মাঞ্জা মেরে সেকেন্ড পিরিয়ডে স্কুল কাটে সবাই। সেই গল্প ঘুরে বেড়ায় এ ক্লাস সে ক্লাস। কলের ঘর। বাথরুম। খেলার মাঠে। ফিসফিস করে ওড়ে। কোন কোন গল্প আবার মিথ হয়ে যায়। বছরের পর বছর একই গল্প ফাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলে এর তার মুখে মুখে। “সেই যে সেই ছেলেটারে...স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে গিয়ে প্রেমে পড়লো বৌদির...। সেই যে সেই বৌদিরে...হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো রোজ। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। শ্রীদেবীর মতো কানে বড় বড় দুল। হাতকাটা ব্লাউজ। গায়ে কিউটি পাওডারের গন্ধ। ছেলেটা ন্যালা খ্যাপা। লাস্ট বেঞ্চে বসে। একটু ভালোবাসা পেলেই বর্তে যায়। বউদিটাও তাই। আসলেই ভালোবাসা ভালোবাসায় হোলস্কয়ার হয়। ওরা দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসে। খুব সিনেমা দেখে একসাথে। একদিন হলো কি রোজকার মতো ছেলেটা এলো স্কুল কেটে সিনেমা দেখতে। কিন্তু বৌদি এলো না। আর কোনদিনই এলো না। আসবে কী করে? স্টোভ ফেটে মরে গিয়েছিল যে বউটা। লোকে বলেছিল মেরে ফেলেছে তার স্বামী। তারপর থেকে পাগোল হয়ে গেল ছেলেটা। সিনেমার হলের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো ঝড় জল রোদ মাথায় নিয়ে। কিচ্ছু খেতো না। কিচ্ছু করতো না। কেউ তাকে সিনেমা হলের সামনে থেকে নিয়ে যেতে পারলো না কোথাও। এমনকি বাড়িতেও না। হসপিটালেও না। তারপর একদিন তাকেও পাওয়া গেল না আর। হাওয়ার সাথে মিলিয়ে গেল যেন সে। পড়ে রইলো গল্পটা। সিনেমা হল। আর দুপুরের নুন শো”। রাস্তা ঘাটে পাগোল দেখলেই আমার গল্পটা মনে পড়ে যেতো। কার ভালোবাসাতে আঘাত পেয়ে এমন হলো লোকটা? কে কাকে ভালোবাসি বলেও ছেড়ে চলে গেল চিরদিনের জন্যে? একবারও ফিরে তাকালো না। পৃথিবীতে ভালোবাসাটা এমন কেন যেখানে সুখের চেয়েও দুঃখ পেতে হয় বেশী? বেদনাতেই ভালোবাসার ঘাটা বড় দগদগে হয়ে ওঠে। আনন্দেতে নয়? ইংরাজি স্যারের গলাটা ঠিক তখনি যেন কোথা থেকে ভেসে আসে “দ্যাটস ভেরি বয়...হ্যাজ গন এভার গন...গন ফর এভার...নেভার টার্ন ব্যাক। ঝটপট করে অনুবাদ করো খোকারা...দেখি কেমন তোমরা পণ্ডিত হয়ে উঠেছো”। হুলো তাড়াতাড়ি লিখে ফেলেছিল খাতায়। “সেই ছেলেটা... সেই যে গেল...গেলই গেল...আর এলো না...”। সবাই স্যারকে খাতা দেখালেও হুলো দেখায়নি। পাতাটা ছিঁড়ে আমার হাতে দিয়ে বলেছিল, “এটা ওই পাগোল ছেলেটাকে দিলাম যে বৌদিকে ভালোবেসে হারিয়ে গিয়েছিল”। তাকে আমিও চিনতাম না। হুলোও না। গোটা স্কুলের কেউ না। গল্পের মধ্যে অমর হয়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটার কথা শুনলেই তবু কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠতো মনটা। আর কিছুই ভালো লাগতো না তখন। এতো দুঃখ পেয়ে সিনেমা দেখার কোন মানে আছে? নাকি ভালোবাসার? প্রশ্নগুলো জাগতো মনে। তারই মধ্যে কেউ কেউ দুঃখটা পেতে ক্লাস কাটতো। কেউ কেউ আবিষ্কার করতে যেতো প্রেমকে। ভালোবাসাকে। কিউটি পাওডারের গন্ধকে। ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিককে। কিন্তু আজ আমি কোথায় যাচ্ছি? কোন ভালোবাসার সন্ধানে? আর কেনই বা যাচ্ছি? পচাই বা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেন? 

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।