নৈশ অপেরা।। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।।

এমন দুপুরে বুড়োরা ঘরে ঢুকে থাকে আর তরুণেরা কাজে। সেজন্য ছোটো শহর নিস্তরঙ্গ হয়। কিন্তু, তা বলে মরে যায় কি? সেন্ট জন'স-এর মাথা ঘিরে বিচিত্র আকৃতিতে কাকের দলের ঘুরপাক। জঙ্গলে কাঠপোকার কিড়কিড় বাদে অন্য শব্দ আমি পাচ্ছি না। জায়গাটায় জিপিএস কাজ করছে না, তাই দরজাবন্ধ চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে আমি এদিক-ওদিক তাকালাম। 'গোটা টাউনে ভূতেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো রাজ বসিয়েছে। এখানে আমরা কয়েক জন বাদে কেউ বেঁচে নেই। তুমি যাকে ভাববে বেঁচে, সে মরে আছে। আর যাকে মরা ভাববে, সে আসলে জ্যান্ত।' যাবার আগে দীপিকা বলেছিল আমাকে। আরও জানিয়েছিল একদিন জাদুবলে জঙ্গল ও পোড়োবাড়িদের দল উধাও হয়ে সেখানে মাথা তুলবে রিসর্ট, সুইমিং পুল, স্পা সেন্টার। 'ওই যে দেখছ চার্চ, ওটাই সেন্ট জন'স। রবিবার করে লোকজন আসে, কিন্তু বাকি সময়ে থমথমে। রাজ্যের সাপখোপের আড্ডা ওর অলটারের নীচে। আর আমার নাম দীপিকা সরেন।' আলগোছে, যেন অবহেলায় কাঁধ থেকে ঝাঁকিয়ে ফেলছে সে, যেভাবে অগ্রাহ্য করে এলোমেলো চুলের অবাঞ্ছিত ঝামরানো, জানিয়েছিল আমাকে। 'মনে রাখবে, এখন যতই গরম লাগুক, বিকেল থেকে কীভাবে তোমার হাড়ের ভেতর হিম ঢুকে যায়।' তবু আমার মনে হল সবাই আছে এখানে, জানালার ফাঁক দিয়ে আমাকে দেখছে।

আমি দেখলাম সাদা ড্রেস পরা মেয়েটাকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসতে। সামনের একটা দাঁত ভাঙা ছিল তার। মাথায় বুনোফুলের মালাকে মুকুটের মতো পরেছে দেখে আমার মনে দুম করে শব্দবন্ধ এল—জিপসিদের রাজকন্যা। অবশ্য, রাজকন্যা হবার বয়েস তার গেছে। তাকে আমি স্যাংচুয়ারির কথা জিজ্ঞাসা করলাম। সে নাক খুঁটে হলুদ শিকনি হাতে মন দিয়ে দেখল, তারপর বাঁ-দিকে হাত তুললে চোখে পড়ল দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়া সাইনবোর্ডে 'ctuary'। তারপর মেয়েটা দুদ্দাড় চার্চের পেছনে ছুটে গেল, যেদিকে ফলসা আর আমলকীর দঙ্গল জড়িয়ে-মড়িয়ে আচ্ছন্ন রেখেছে। পাশের কটেজের জানালার ভাঙা শার্সি বেয়ে একটা আদারং বেড়াল বেরিয়ে আমার দিকে রাগী চোখে তাকাল, মাটিতে নাক ঘষল দুইবার। তারপর দৌড়োল জিপসি রাজকন্যার পেছনে। আমি এগিয়ে গেলাম কারণ এমন নৈঃশব্দ্যে অভ্যস্ত নই। স্যাংচুয়ারির ভাঙা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম সামনের আগাছা ভরতি বাগানে চাপ চাপ অন্ধকার ইতিমধ্যে বাসা বেঁধেছে। তাদের পেছনে যে বিশালাকৃতির দোতলা বাড়ি, সেটার দরজা-জানালাগুলো বন্ধ। গা বেয়ে উঠে যাওয়া ঘোরানো সিঁড়ির অর্ধেকটা ভেঙে ঝুলছে। বাড়ির শরীরে গজিয়েছে নিঃশব্দ ছত্রাক। পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে একটা পুরোনো অলটো বিশ্রাম নিচ্ছে। কাকের বিষ্ঠা ও শুকনো পাতার ভিড়ে মলিন তার ছাদ। গেটের উলটোদিকের কাঁঠালগাছ থেকে কাপড়ে বানানো দুটো পুতুল ঝুলছে। ওদের নাক, চোখ কালি দিয়ে আঁকা। চোখে পড়ল, বাড়ির ডান দিকের অংশটা ভাঙা হয়েছে। সেই ভগ্নস্তূপে এখনও অবশ্য সটান দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো থাম, তাদের মাথায় একফালি ছাদ। ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর ভাঙা কাচ দিয়ে ভেতরের লাউঞ্জের অন্ধকার চোখে পড়ল। বাড়ি থেকে প্রেশার কুকারের সিটি ভেসে এল যখন, বুঝলাম ভেতরে লোক আছে। বাগানের দোলনাও অবশ্য অক্ষত। সেখানে এক বৃদ্ধা বসে ছিলেন। তাঁর পায়ের কাছে কুচকুচে কালো ছাগল, পরে নাম জেনেছি লালুরাম। ছাগলের চোখগুলো কুচফলের মতো লাল। বৃদ্ধা মোটাসোটা চশমা পরা। একটা কটকি শাড়ি পরে দোল খাচ্ছিলেন। এবার হাত তুলে বললেন, 'এসো।' আর আমি স্যাংচুয়ারির পেটে ঢুকে গেলাম।

.
.
.
নৈশ অপেরা
শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য : ৫৪০ টাকা 

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

এক যে ছিল গ্রাম।। অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। সুপ্রকাশ।।

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।