Posts

Showing posts from August, 2022

নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

Image
ঝাঁ চকচকে সপ্রতিভ চারচাকা গাড়ি নিয়ে আলাদা কোনও মুগ্ধতা লেখার নেই। অপ্রীতিও নেই অবশ্য। লেখাদের বাড়িতে গাড়ি ছিল না কোনও। তবে সেটা কোনও বলিষ্ঠ যুক্তি নয়। লেখাদের বাড়িতে প্রসাধন ব্যবহারেরও বাড়বাড়ন্ত ছিল না কোনও কালে তবু সেসব বিষয়ে সম্যক জ্ঞান সে আহরণ করে নিয়েছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। চারচাকা গাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার কোনওরকম তাগিদ সে মনের ভেতর থেকে পায়নি এতদিন। কিন্তু আজ চোখের সামনে সাত সাতটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে থমকে গেল। সাতটিই তাদের পারিবারিক। লাল, নীল, সাদা, কালো, সোনালি... একেবারে শেষেরটি গাঢ় সবুজ। লেখাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছে প্রত্যুষ। লেখা বারান্দা থেকে দেখল, সকালের সোনালি রোদে আরও ঝকঝকে হয়ে উঠেছে প্রত্যুষের উপহার। একবার তাকালে চোখ ফেরানো দুষ্কর।  মসৃণ ধাতব শরীরটাকে নরম রোদ দিয়ে ছুঁতে চাইছে সূর্য।  ছুঁয়েই পিছলে যাচ্ছে।  লেখার বাবা কারখানায় যেতেন বাসে। ঘন নীল, ধুলোপড়া শরীরে  সাদা আয়তকার একটি রঙের ফালি। চওড়া ফিতের মতো। সেখানে গোটা গোটা ইংরেজি হরফে লেখা থাকত কোম্পানির নাম।  ছাতিম ফুলের গন্ধ মাখা বিকেল হোক বা শিশির ভেজা সকাল,  লেখার বাবাকে কোয়াটারের কাছাকাছি পৌঁছে দিত সেই মলিন,

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর।

Image
কথা বলা প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ বোধহয়। তাছাড়া শুনবার লোক যে হারে কমে যাচ্ছে তাতে, এই একা-বোকাটা আর যাবেই বা কোথায়? কথাই বা আর কী বলবে? কাকেই বা বলবে? শোনার লোকই বা কোথায়! আমাদের মণিবাবু স্যার বলেছিলেন— 'কথা বলার ইচ্ছে হলে মানুষকে বেশি ঘাঁটিও না বাপু। মানুষ শুধু নিজের কথা বলে, কেউ কারও কথা শোনে না! তার চেয়ে কিছু বলবার খুব ইচ্ছে হলে লিখে রাখো কল্প খাতায়, ভেড়ে যাওয়া পুঁথির পাতায়। আর যদি সে-সব কাছে না থাকে তবে তোমার কথা আকাশকে বলো। বাতাসকে বলো গাছপালাকে বলে রাখো।' কিন্তু মুশকিল হয়েছে কী— আকাশ ব্যাপারটা বড্ড সুদূর, অত পর্যন্ত বামনের হাত পৌঁছবে না। তাছাড়া আকাশ মানে তো শূন্য থেকে মহাশূন্য শূন্যতার কাছে কিছু বলতে ভালো লাগে? ইদানিং আকাশেরও আর শোনার মতো ক্ষমতাও নেই, ওজোন স্তর ফুটো- টুটো হয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। বাতাস এত পল্যুটেড যে, তার কান আর চোখ দুটোই একেবারে গেছে। তাছাড়া যাকে দেখা যায় না, অথচ আছে বোঝা যাচ্ছে, তাকে কোনো কথা বলা মুশকিল। গাছের কাছে গিয়েও বলা যায়, কিন্তু গাছগুলো নিজেরাই এত অসুস্থ, কর্তনাশঙ্কায় সদাসর্বদা এত কম্পমান, যে তাদের কথা কে ভাবে তারই ঠিক ন

দুর্লভ সূত্রধরের স্মৃতিগদ্য 'আহাম্মকের খুদকুড়ো' পড়ে লিখছেন গৌরব বিশ্বাস

Image
সুপ্রকাশ প্রকাশিত দুর্লভ সূত্রধরের স্মৃতিগদ্য ' আহাম্মকের খুদকুড়ো ' পড়ে লিখছেন গৌরব বিশ্বাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।  ....................... একজন ব্যক্তি, যে ধরনের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তাঁর লিখিত স্মৃতিকথনেও স্পষ্টতই তার ছাপ রয়ে যায়। যেমন ধরুন, অভিজাত ধনবান কোনো বিজনেসম্যান যদি স্মৃতিকথন লিখতে বসেন, তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে আসবে-তিনি কটা দামী গাড়ি চড়েছেন, ক'বার বিদেশ সফরে গেছেন, সেখানে কী কী এক্সটিক ডিশ চেখে দেখেছেন, কোন কোন বিজনেস ডিল ক্র্যাক করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলোই তাঁর স্মৃতিকথনে উঠে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এধরনের স্মৃতিকথন সুখপাঠ্য যদিও বা হয়ে থাকে, এ তো আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের কাহিনী নয়। প্ৰকৃত মধ্যবিত্তের জীবনস্মৃতি লেখা সহজ ব্যাপার নয়। 'মধ্যবিত্ত' এই সামাজিক স্ট্যাটাসটার সংজ্ঞা বারবার বদলেছে। এ যুগে মধ্যবিত্তের স্বরূপ ধরতে পারা মুস্কিল। বরং মধ্যবিত্ত বলতে যে শিক্ষিত , সীমিত ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী, জীবনের প্রায় সব ব্যাপারেই মধ্যম পন্থার অবলম্বনকারী, নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক অনুশাসনের ধারক- এমন এক শ্রেণীর মানুষদের বোঝা

শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

পাহাড়ে বৃষ্টি নিষ্ঠুরতা এবং নির্জনতার উদযাপন ঘটায়। দার্জিলিং-এর বর্ষাকালকে যদি এক কথায় ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে তার নাম অবিশ্রাম, বিরতিহীন বৃষ্টি। কখনও আস্তে এবং কখনও মুষলধারে। যখন বৃষ্টির বেগ কম, পাহাড়ের নীচ থেকে মেঘের দল উঠে এসে কুয়াশায় ঢেকে নিচ্ছে চরাচর, আমার ঘরের জানালার কাচ ভেপে উঠছে। রাস্তাঘাটের স্যাঁৎসেঁতে ভেজা অন্ধকার ভেদ করে মাঝে মাঝে ছিটকে আসছে এক ঝলক ছাতার রং অথবা বাহারি পোশাকের আঘ্রাণ। কম সংখ্যায় টুরিস্ট। ম্যাল, চৌরাস্তা, কেভেন্টোর্সের ছাদ— সমস্তই ফাঁকা ফাঁকা। সন্ধে হলে একদম নিঝঝুম হয়ে যায়। ঘরের দেয়াল ঘেমে ওঠে। আড্ডা জমায় অদ্ভুত দেখতে পাহাড়ি পোকার দল। বনের ধারের পাইন, ইউক্যালিপ্‌টাস, বার্ডের ডাল থেকে সারাদিন টুপটাপ করে জল পড়বার আওয়াজ। ক্ষণিকের জন্য কুয়াশা কেটে গেলে আবছা জলরঙের মতো দেখা যায় নীচের দরিদ্র বস্তি। এই অবিরাম অবসাদের মতো বৃষ্টি মনকেও কীরকম বিকল করে দেয়। কাজ করতে ভালো লাগে না। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় জানালার বাইরে এই ছাইরঙা আকাশ আর ফ্যাকাশে জন্ডিস রুমির মতো সূর্যের আলোকে চেটে দেখি। এমনিতেই অনিদ্রাতে ভুগি। দিনের বেলা ঘুম পায়

শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

Image
শেষ মৃত পাখি শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য: ৫২০ টাকা #সুপ্রকাশ

শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

Image
আসছে আগামী সপ্তাহেই শেষ মৃত পাখি শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য #সুপ্রকাশ_প্রকাশিতব্য

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

সুপ্রকাশ প্রকাশিত কল্লোল লাহিড়ীর উপন্যাস ' নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি ' পড়ে পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সোমেশ্বর তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে। রইলো আলোচনাটি:  https://youtu.be/rd9u6NoHlwY

নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

Image
সারাবছর বিদেশে কাটাইয়া পূজার ছুটিতে যেদিন বাড়ি আসিলাম, সেদিন শারদীয়া শুক্লা তৃতীয়া। আমার কার্য্যস্থান হইতে বাড়ি আসিতে হইলে একটা নদী পার হইতে হয়, এই নদী পার হইয়াই আমাদের গ্রাম। অন্যান্য বারের ন্যায় এবার আমাদের এই নদীতে বেশি বান হয় নাই, জল অল্প বাড়িয়াছিল, এখন শুকাইয়া যাইতেছে। দূরবর্তী পদ্মাতীরে থাকিয়া নদী সম্বন্ধে আমার ধারণাটা কিছু প্রশস্ত হইয়াছে। বর্ষার সেই বিশালকায়া, পঙ্কিলতোয়া, কলগামিনী, কামচারিনী, পর্বতনন্দিনীর ক্রোড়দেশে কালাতিপাত করিয়া তাহার এই ক্ষুদ্র শাখাটিকে আর নদী বলিয়া ধারণা হয় না। তথাপি এই ক্ষুদ্র তরঙ্গিনী আমাদের গ্রামের নদী, আমরা আবাল্য তাহার সহিত পরিচিত, এখনো মনে পড়ে কতদিন আমরা সকাল সকাল পাঠশালা হইতে পালাইয়া এই নদীর জলে বাল্যসাথীগণের সঙ্গে মাতামাতি করিতাম, এবং বৈশাখের বৈকালে ঝড় উঠিলে পাঁচ সাত বন্ধুতে একত্র হইয়া পরিধান বস্ত্র আজানু উত্তোলন পূর্বক ইহার সকুঞ্চিত জল পার হইতাম এবং বর্গীর হাঙ্গামার মতো ওপারের দত্তদের আমবাগানে ছুটিয়া পড়িতাম । সন্ধ্যাকালে যখন নদীর ধারে আসিয়া আমার গাড়ি থামিল, তখন সন্ধ্যা অতীত হইয়াছে ; তখন চন্দ্র পশ্চিম আকাশে অশ্বত্থ গাছের অন

রাস্তার শুরু। জয়া মিত্র

Image
বহমান বাক্যধারা যেন রেখার আঁচড়ে পুরোনো দিনের কার্শিয়াঙের ছবি এঁকে চলেছে এই আখ্যানে। ছবির কেন্দ্রে মা, তাঁর তিন সন্তান— তিতির, তিন্নি, বুলবুল এবং 'বন্দী রাজকন্যা' যশোদাদিদি, যে পালিয়ে এসেছে দুষ্টু রাজার কাছ থেকে। এ আখ্যান ঘিরে থাকে কার্শিয়াঙের পাহাড়-প্রকৃতি, তিন্নির ‘পাউডার ফুল’, পাকদণ্ডী পথ, ঝরণা। মানুষও যে কত রকম— ‘উপরের ঠাকুমা', তিতির-তিন্নি-বুবুলের বাবা, চিরকাকা, সন্ধ্যাদি, জনাদা, দিলীপদা, পুলুদি, আম্মা, মুকুপিসি, মীনাদি, ঢকনি দাজ্যু— আরও অনেকে। চলে যাওয়ার শুরু দিয়েই শেষ হয় গীতিকবিতার মতো এই আখ্যান ৷ একেক জনের এক এক রকম চলে যাওয়া। পড়ে থাকে দূরবীন দারা, তিনধারিয়া, পাগলাঝোরা।  রাস্তার শুরু জয়া মিত্র প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য দাম : ১৮০ টাকা #সুপ্রকাশ

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

Image
আসছে শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯ প্রচ্ছদ : মেখলা ভট্টাচার্য #সুপ্রকাশ

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

Image
রাগে গনগনে মাথা নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে রামশরণ বুঝল, বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে শীতটা। গায়ের একটা চাদরে বশ মানছে না ঠান্ডা। ভিতরে গরম কিছু পরা উচিত ছিল। রাতের রান্না চাপিয়ে দিল গজগজ করতে করতে। মেজাজটা খিটকে থাকার জন্যই বোধহয়, রান্নায় স্বাদ হলো না তেমন। আরও খিটখিটে মেজাজ নিয়ে খাটের কোণা থেকে লাঠি, বাঁশি নিয়ে তোড়জোড় শুরু করল বেরোনোর। টর্চটা জ্বালিয়ে একবার ফ্যাকাশে দেয়ালে ফেলে দেখে নিল ব্যাটারির জোর কতটা আছে এখনও। ঝুল পড়া দেয়ালের তাকে সাজিয়ে রাখা ছবির দিকে তাকিয়ে একবার মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলল, “জয় সিয়ারাম।” সেই কবে বাবুজির হাত ধরে বিহারের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে চলে এসেছিল এই শহরে রামশরণ। ডাক্তারবাবু তখন গদিতে এই রাজ্যে। গরীব আদমির দল সরকারে আসতে ঢের বাকি তখনও। তবুও সেই দলেরই একজন মাথা টাইপ নেতার হাত ধরে চৌকিদারের চাকরিটা পেয়ে গিয়েছিল তার বাবুজি। বাবুজির এই চৌকিদারির চাকরিতেই তাদের রুটি তরকারি ছাতু লিট্টি হয়ে চলে গেছে বেশ। তারপর বাবুজি চলে যাওয়ার পর আর এদিক-ওদিক না ভেবে, ওই কাজেই ঢুকে গেছে সে নিজেও। সেই থেকে দিনে দিনে কত স্লোগানই না শুনলো রামশরণ! ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়’ থেকে শুরু ক

শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

Image
পঁয়তাল্লিশ বছর আগে দার্জিলিঙের এক সম্ভাবনাময় কবি, অমিতাভ মিত্র খুন হয়েছিলেন। অভিযোগের তীর ছিল তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু রহস্য-ঔপন্যাসিক অরুণ চৌধুরীর দিকে। কিন্তু নানা পরস্পর বিরোধী প্রমাণে সে অভিযোগ দাঁড়ায়নি। তনয়া একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক। অমীমাংসিত খুনের কাহিনী নিয়ে ধারাবাহিক লিখছেন পত্রিকায়। অমিতাভ মিত্রের হত্যা-রহস্য নিয়ে লেখার জন্য দার্জিলিঙে এলেন তনয়া। তারপর? তনয়া কি খুঁজে পেলেন এই হত্যারহস্যের সমাধান ? শেষ মৃত পাখি শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী #সুপ্রকাশ

শেষ মৃত পাখি। শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য

Image
শহরের বহির্ভাগ এগিয়ে আসছে। চারপাশে লোকজন কম। ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে শুধু আশেপাশের দোকানের আলো। কুয়াশার মধ্যে কোথাও কোথাও জটলা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। বাকি জায়গাটা ফাঁকা এবং অস্বচ্ছ অন্ধকার। অনুমান করলাম, ভিড়ের জায়গাগুলো হোটেল, পাব অথবা রেস্তোরা। এই শহরে বর্ষার নির্জনতায় যখন রাত্রি নামে, নির্জন হোটেলদের ধ্বংসস্তূপ আর পলিথিনের কম্বলে ঘুমিয়ে থাকা জিপগাড়ির দল যখন গুটিয়ে ফেলে নিজেদের, তখন মনে হয় পাহাড়ের আদিম হিমশীতল জঙ্গল এসে দখল নিচ্ছে গোটা জায়গাটার। মনে হয়, এই অবিশ্রান্ত ছিপছিপে বৃষ্টির থেকে পরিত্রাণ নেই। জলাপাহাড়ের রাস্তা দিয়ে সাবধানে গাড়ি উঠছে। কুয়াশা এখন কম। হয়তো ওপরে উঠতে সময় নিচ্ছে। আশেপাশে অভিজাত মহল্লা। জিপিএস খুলে দেখলাম, আর চারশো মিটার। অধিকাংশ বাড়ির সামনে বাগান। লনে আলো জ্বলছে। দু-একটা হোটেল। বাড়িগুলির গড়ন পুরোনো ব্রিটিশ উপন্যাসকে মনে করিয়ে দেয়। মদনদাকে জিপিএস দেখে রাস্তার নির্দেশ দিতে দিতেই চোখ তুলে দেখলাম, বৃষ্টিভেজা নির্জনতার মধ্যে একটা নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তি পাহাড়ের ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আমার গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ চোখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। তার

নির্মুখোশ শারদ ১৪২৯

Image
"রাত্রির আঁধার ভেদ করিয়া জ্বলন্ত মশাল হতে কয়েকটি অশ্বারোহী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছে উপলবন্ধুর কান্তার-পথে। গতির প্রাবল্যে স্পষ্ট তাহাদের উদ্বিগ্ন ত্বরা। তাহারা যোদ্ধা নহে, দেখিয়া বণিক শ্রেণীর মনে হয়। অথচ তাহাদের সঙ্গে সামগ্রী বলিতে সামান্য একটি পোর্টলি ভিন্ন আর কিছুই নাই। অতএব ব্যবসায় নহে, অবশ্যই অন্য কোনও গূঢ়কর্মে এই নিতান্ত অসময়ে তাহারা চলিয়াছে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশে। কালান দুর্গপরিসর সংলগ্ন প্রান্তরে যুদ্ধ শুরু হইয়াছে প্রায় ছয় মাস হইল। সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের জীবনের শেষভাগে বিশাল সাম্রাজ্যের কিছু কিছু প্রান্তে বিজাতীয় শহরু পুনরায় শক্তিসংগ্রহ করিতে থাকে। উজ্জয়িনীর সীমান্তে নামগোত্রহীন এক শক-সত্রাপ উপদ্রব শুরু করিয়াছিল এক অতি তুচ্ছ বিবাদ লইয়া। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্তরাজবংশের স্পর্শমণি। যখন অস্ত্রধারণ করিয়াছেন, সে অস্ত্র ইরম্মদসম শত্ৰুহনন করিয়াছে। তাঁহার দীর্ঘজীবনের একটা বড় অংশই অতিবাহিত হইয়াছিল উপজাতীয় শক ও হূর্ণ সম্প্রদায়ের দমনে। সে কাজ তিনি সম্পন্ন করিয়াছেন বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে। উত্তর পশ্চিম হইতে আগত এই বিদেশী শত্রুদের প্রবল প্রহার করিয়া তিনি পরাস্ত কর

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

Image
আসছে শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯ প্রচ্ছদ : মেখলা ভট্টাচার্য #সুপ্রকাশ

শারদ নির্মুখোশ ১৪২৯

Image
কার্তিক মাসের শুরুতেই এদিকে বেশ ঠান্ডা পড়ে গেছে, সন্ধ্যা এসেছে অনেকক্ষণ, চারপাশ থমথমে, প্রায় জনশূন্যও বলা চলে। বাংলোর পেছনে চির-পাইনের বনে কুয়াশা আর উত্তরপথগামী বাতাস পরস্পরের সঙ্গে নিচু স্বরে প্রেমালাপে মগ্ন, ঝিঁঝি পোকার দল ডেকেই চলেছে একটানা, বিরতিহীন, অল্পক্ষণ বসে থাকলে মনে হয়, জগতে নিরবধি ঝিল্লিরব আর গহিন বাঘ-বনের মাঝে ইংরাজ আমলের শতাব্দী প্রাচীন এই বনবাংলো ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর অস্তিত্ব নাই। দূরে সাতপুরা পর্বতমালার পূর্ববাহী মৈকাল পর্বত, দিগন্তবিথারি ঘাস জমি, আদিবাসী জনপদ, প্রাণচঞ্চল অরণ্যভূমি সবই যেন কারোর ইশারায় চরাচর থেকে মুছে গেছে। এর আগে সুধীরবাবুর সঙ্গে পালামৌ গেছি, এমন কার্তিক মাসেই, কিন্তু সেখানকার অরণ্যে আজকের মতন দমবন্ধ তো হয়ে আসেনি। বারবার যেন মনে হচ্ছে, জঙ্গলের এই অংশে মানুষের প্রবেশাধিকার নাই, বনদেবী তাঁর হৃদয়ের গোপন দুয়ারের চৌকাঠ অতিক্রম করার অনুমতি কাউকে দেন নাই, তাই হয়তো গাঢ় সন্ধ্যার অবকাশে অরণ্যভুবন এমন নিঃসঙ্গ, শ্বাসরোধী হয়ে উঠেছে। সহসা আমার চিন্তাজাল ছিন্ন করে থেমে গেল ঝিল্লিরব, কোথাও কোনো শব্দ নাই, নৈঃশব্দের সৌন্দর্যও মুছে গেছে, নীরবতার অধিক সর্বগ্রাসী কোনো মৌ

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
এক দঙ্গল ছেলেমেয়ে। একটা স্কুল। একটা মফস্বল। তার ধার দিয়ে বয়ে যাওয়া কুন্তী নদী। বিঘ্ন সময়-সমাজ, যাপনের বিপন্নতা, মূল্যবোধের ভাঙচুর-- সব পেরিয়ে এক স্বপ্নভুবনের কথা 'অনন্যবর্তী'।  অনন্যবর্তী দুর্লভ সূত্রধর  প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: সৌজন্য চক্রবর্তী  মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা  #সুপ্রকাশ

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
'এবার কী করবে?' টুকু ঘাসের ওপর একটু আড়াআড়ি বসেছে। ওর নিখুঁত প্রোফাইল আমার নজরে আসছে। 'সমাজনীতি-রাষ্ট্রনীতি? নাকি মন দিয়ে পড়াশোনা?' আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করে যাচ্ছে টুকু। আমি উত্তর দিচ্ছি না। তাকিয়েই আছি ওর দিকে। আজ কড়কড়ে মাড় দিয়ে ইস্ত্রি করা কট্‌কি-প্রিন্টের সুতির শাড়ি প্লিট দিয়ে গুছিয়ে পরেছে টুকু। কালো ব্লাউজের কাঁধের কাছে সাদা পুঁতিওয়ালা একটা বড়ো সেফটিপিন দিয়ে আঁচলটা আটকানো। ঈষৎ পা-মুড়ে হাঁটু-দুটো থুতনির কাছে এনে বসেছে। ওর সাইড প্রোফাইলে আধখানা টিপ দেখা যাচ্ছে। কাঁধ ছুঁয়ে শাড়ির লম্বা আঁচল পেছনের ঘাসের ওপর অলসভাবে শুয়ে আছে। দুই-হাঁটু শাড়ির কুচিগুলোকে বহন করে ঠিক পায়ের পাতার ওপর এসে থেমেছে। ওর পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে না, পায়ের পাতাদুটি সায়ার চওড়া ক্রচেট-লেসে ঢাকা। আমাদের সামনে কুন্তীর জল – আমাদের কৈশোরের, কৈশোরোত্তীর্ণ ছেলেকালের আশ্রয়। আমি তাকিয়ে আছি কুন্তীর ওপারে। আমি জানি—রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে টুকু কথা বলতেই পারে, সে কথা তির্যক হয়ে ওঠাও স্বাভাবিক। দিন কয়েক আগেই নাইট স্কুলের কমিটির বার্ষিক মিটিং হয়ে গেছে। মিটিংয়ের একবারে শেষপর্বের

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
এই বাড়িটি ছিল শহরের এক নাম করা উকিল গোপীকান্ত তালুকদারের। এখানে সপরিবারে আসার আগেই সতীশচন্দ্র রাখাই-কোম্পানির মাড়োয়াড়ি মালিকের সঙ্গে দেখা করতে আসার সুবাদে স্থানীয় কোর্টের বারে মোক্তার হিসেবে নাম লেখাতে গিয়েছিলেন, তখনই গোপীকান্ত উকিলের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সতীশচন্দ্র বাড়ি ভাড়া খুঁজছেন শুনে গোপীকান্ত নিজের বাড়িতেই তাকে সামান্য ভাড়ায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নাম লেখালেও, তখন তখনই সতীশচন্দ্র মোক্তারি প্র্যাকটিস শুরু করতে পারেনি। সে উপায় তাঁর ছিল না। মোক্তারি জমতে সময় লাগে, এই শহরে নামকরা উকিল-মোক্তারের অভাব নেই, নতুন কারও পক্ষে চট করে দাঁত ফোটানো মুশকিল। গোপীকান্ত উকিলের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সতীশচন্দ্র সাহস পাননি। প্র্যাকটিস জমতে জমতে খাবেন কী! যতই সস্তার দিন হোক, পঞ্চাশ টাকায় দুই মেয়ে নিয়ে সেদিনও সংসার চলা কঠিন ছিল, তাই দিনের বেলা মাড়োয়াড়ি কোম্পানিতে রাখাই মালের 'আয়াত নির্যাত'-এর হিসেব রাখার কাজ, রাত্রে স্থানীয় একটি প্রেসে প্রুফ দেখা। দিনরাত খাটতেন সতীশচন্দ্র। আর প্রায় সারারাত আইনের বই পড়া, নোট করা, মোক্তারির প্রস্তুতি নেওয়া। এমন পয়সা ছিল

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
শহরের বৈকালিক কোলাহল এড়িয়ে তাঁরা কুন্তীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন। খেয়াঘাটে দু-চারজন ভ্রমণপিয়াসীর আনাগোনা। তাঁরা পশ্চিমদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। অনেকটা হেঁটে যেখানটায় এলেন, সেখানে উঁচু মাটির বাঁধ। এটা নিচু এলাকা। বর্ষাকালে যাতে না ভাসে তার জন্য বাঁধ, বাঁধের মাঝ বরাবর একটা কালভার্টের মাঝখানে ছোটোমাপের স্লইস গেট। বর্ষার সময়টা বন্ধ থাকে। বাঁধের ওপরে সিমেন্টের বেঞ্চ গোটাকয়। তাঁরা পাশাপাশি বসলেন। কুসুমিতা সংকুচিত। জড়োসড়ো হয়ে বসেছেন, তাঁর মাড় দেওয়া ইস্ত্রি শাড়িতে খস্থ আওয়াজ উঠল। শচীপ্রসাদ কুম্ভীর বিলম্বিত স্রোতের দিকে তাকিয়ে বললেন – 'আজ, এতদিন পর একসঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে তোমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে, না?' কুসুমিতা বললেন—'খুব। কী লজ্জা!' 'অনভ্যাস। যাঁরা প্রায়ই একসঙ্গে কেনাকাটা করতে যান, বেড়াতে বেরোন, একই অফিসে হয়তো কাজ করেন, তাঁরা কী লজ্জা পান? পান না। কেন বলো তো?' কুসুমিতা জবাব হাতড়াচ্ছিলেন। শচীপ্রসাদ বললেন— 'অভ্যাস। কুসুমিতা, তুমি অনভ্যস্ত। টুকু তোমার মেয়ে, তুমি ভাবতেই পারছ না যে সে বড়ো হয়েছে, তার নিজস্ব একটা হৃদয় হয়েছে, সে কাউকে একান্ত করে ভালোবাসবে

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
সব মানুষেরই জীবনে কিছু স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন ! নাকি কল্পনা? দীর্ঘ সময় আমি উড়োজাহাজের স্বপ্ন দেখেছি। ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় থেকে প্রায় প্রতিদিন। স্বপ্নটা আসত উড়োজাহাজে চেপে। ঠিক চেপে নয়, উড়োজাহাজের গায়ে সেঁটে। আমার স্বপ্নের মধ্যে ছিল চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের মতো রুপোলি ধাতুর ঝলক, আর একটা হাঁ-খোলা দরজা। আর সেই চারপাশ খোলা দরজা, শুধু একটি কালো রাবারের প্যানেল দিয়ে পান্নার স্লাইডিং ডোর যাওয়ার ব্যবস্থা, যার সুইচ বা পুশ বাটন পাইলটের চেম্বারে—সেই দরজার খোদলটার পাশ দিয়ে আসত হু-হু করে ঝোড়ো বাতাস। ভেতরে কিছু ঘোষণা, বাইরে শুধু শূন্যতার পদাবলী।  আর আমি সেই দরজার পাশে উড়োজাহাজের বাইরের রূপালি দেওয়ালের ডিম্বাকৃতি বাঁকের মুখে সেঁটে আছি। বাতাস, ঠাণ্ডা, ভয় আমার শরীরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে উড়ো জাহাজের খোলা দরজার ভেতরে। অনন্যবর্তী দুর্লভ সূত্রধর  প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য: ৩২০ টাকা  ছবি: পিন্টারেস্ট #সুপ্রকাশ

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
দশ মিনিটের মধ্যে আমরা কুন্তীর ঘাটে। ধু-ধু দুপুর। খেয়াঘাটে একজনও যাত্রী নেই। আবার যাত্রী হবে বেলা তিনটে থেকে। তখন ওপার থেকে দুধ বেচতে আসা ঘোষমশাইরা দুধের খালি ড্রাম, ক্যান, টিন, বালতি নিয়ে ঘাটে আসে। দুধের মধ্যে সকালে ভাসানো খড় আর নদীর ঘাটের মাটি দিয়ে পাত্রগুলো মেজে নদীর জলে ধুয়ে তেল ভাব ছাড়িয়ে, তারপর কোনো গৃহস্থ বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সরষের তেল মেখে নদীতে ডুব দিয়ে সাইকেল সুদ্ধু খালি পাত্রসহ ওপারে ফিরে যাবে। কেউ কেউ ওপারের খেজুরতলায় গিয়ে 'তালের অস' খেয়ে 'নিতি নিতি যাও গো আধে.....' গাইতে গাইতে অলস-মন্থরভাবে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরবে। খেয়া নৌকাটা ঘাটের একপাশে বাঁধা। কেউ কোথাও নেই। কুন্তী ছোটো নদী। ওপারে তিন মাইলের মধ্যে বসতি নেই। তিন মাইল দূরে গোয়ালাদের গ্রাম, ঈশ্বরচন্দ্রপুর। নদীর ধার থেকে ঈশ্বরচন্দ্রপুরের আগে পর্যন্ত মায়ের আঁচলের মতো বিছানো ফসলের খেত। এপার থেকেই ছোলা, বেগুন, টম্যাটোর খেত নজরে আসছে। সাইকেলগুলো রাইকুমার দাদার টোঙের বাঁশে হেলান দিয়ে রেখে তনয় নীচের ঠোঁট দুটো টেনে ধরে শিস দিতেই খেয়া মাঝির টোঙটা থেকে মাঝি রাইকুমার দাদার চোদ্দ বছরের ছেলে কাল্লু ব

অনন্যবর্তী। দুর্লভ সূত্রধর

Image
টুকু বাড়িতে আজ কচি কলাপাতা রঙের একটা ফ্রক পরে আছে, দুই বিনুনি করা চুল। মনে হয় গতকাল বিকেলে এই বেণী-দুটো রচিত হয়েছিল। তাই এখন শিথিল, কয়েকটা খুচরো চুল ওর কপোলে ওড়াউড়ি করছে। ভারি অদ্ভুত লাগে আমার। এই টুকু সবসমেত, সবটুকু নিয়ে আমার! তনয় আমায় পড়ার ঘরে বসিয়ে স্নান করতে যায়। টুকুর দেখা পাই না। টেবিলের ওপর থেকে হাতের সামনে থাকা যে বইটা তুলে নিই সেটা খুলতেই টুকুর হাতের লেখা একটা চিরকুট দেখতে পাই। যদিও অনুচিত তবু প্রবল কৌতূহলে চিরকুটটায় চোখ বোলাই। —'কেন এত অনন্ত বিষাদ।' এসব কেন লিখেছে টুকু ? এটা কি কোনো কবিতার চরণ? এটা কেন পড়ার টেবিলে লিখে রেখেছে টুকু? তনয় স্নান করে আসে, টুকুও আমার জন্য চা আর মায়ের ভাণ্ডার থেকে ডালের বড়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। আমি বুঝি—এই সময় সংযোগ টুকুর স্বনির্বাচিত। আমি মনে মনে তারিফ করি ওর বুদ্ধির। নইলে কী জানি— বাবার শটিভাঙায় যাওয়া, কৃষ্ণাদির স্বেচ্ছা-নির্বাসন... প্রতিটি সকাল আসে বিমর্ষ হয়ে, প্রতিটি সন্ধ্যা আলোহীন ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হতে থাকে। একাই কুন্তীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকি। ইটভাটার মাটির স্তূপের ওপর বসে ভাটার মজুরদের নিরন্ধ্র ইটচালার ঘরকন্না দ

শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

Image
"রাত্রির শেষ যাম অতিক্রান্ত হল প্রায়। অন্ধকার তরল হয়েছে। আকাশ ক্রমশ অতি বৃহৎ মৎস্যের উদরের মতো রক্তাভ পাণ্ডুর হয়ে আসে। বহু বৎসর এই সন্ধিপ্রকাশকালে অব্জাজননীর ঊষাবন্দনায় প্রাসাদশীর্ষ নন্দিত হয়েছে। যত রাত্রিশেষ অতিক্রান্ত হয়েছে, আরও যত রাত্রিশেষ উদিত হবে তাদেরই অন্তরীক্ষ পথে চিরন্তনীদের প্রথমা এই ঊষা আসছেন। বিকশিত হতে হতে জীবজগৎকে তিনি আগ্রত করছেন বোধে। মৃত যে, আহ্বান করছেন তাকেও। অন্ধকার মোচন করে জ্যোর্তিময়ী এই আকাশদুহিতা উঠে আসছেন আজ। আগামী সমস্ত দিনই অজরা অমৃতা, ইনি নিজেকে চালিত করে নিয়ে যাবেন। সে কণ্ঠ স্তব্ধ হয়েছে তাও বহু বৎসর হল আজ। আবার আমার অন্তঃস্থল মন্থিত করে আদি তেজের প্রতি, আলোকের প্রতি সেই বন্দনা জেগে ওঠে। এক নারীর হৃদয় থেকে বেদনাধারায় তাঁরই উত্তরকন্যা অন্য নারীর হৃদয় প্লাবিত হয় আলোর স্তরে, যে আলো অন্ধকার থেকে মুক্তি। মনে হয় এত দীর্ঘকাল এই তীব্র দাহে দগ্ধ হয়ে আলো দিয়ে চলেছেন, তবে কি নারী নন সূর্য ? কে বলেছে তাঁকে পুরুষরূপ ? আমার একটি দিনের শুরু হচ্ছে রাজপুরীতে। বিধিনিয়মে। আমার অন্য দিনের শুরু হচ্ছে রান্ধুনীর পল্লীতে, গোপালকের কুটিরে— পরিশ্রমে, স্নেহে, উষ

শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

Image
"সেই অন্ধকারেও শ্মশানে একটি নির্বাপিতপ্রায় চিতা জ্বলছিল। তার পার্শ্বে দণ্ডায়মান মনুষ্যমূর্তি অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। আমার কণ্ঠ থেকে কোনো কাতর স্বর নির্গত হয়ে থাকবে, সে অতি কর্কশভাবে বলে উঠল— কে ওখানে? মনুষ্য হও বা প্রেতযোনি– এই গঙ্গাতীরের শ্মশানে আমার অধিকার, আমার সমক্ষে এসো— সে কোনো মৃতের শোকার্ত স্বজন নয়, শ্মশানধারী চণ্ডাল। অন্ধকারে স্থলিত চরণে তার দিকে অগ্রসর হয়ে নিজমুখে বললাম— ভদ্র, আমি অতি হতভাগিনী, নিজে পুত্রের মৃতদেহ  নিয়ে এসেছি তার শেষ সংস্কারের নিমিত্ত।  মৃত সৎকারের কাজ করে করে হয়তো তার চিত্ত এমনই পাষাণ হয়েছিল যে আমার বাক্যে তার চিত্ত কিছুমাত্র দ্রবীভূত হল না। অতি পরুষ ভাবে সে বলে উঠল— দুর্ভাগিনী হও আর সুভাগিনীই হও শ্মশানের কড়ি দাও, আমি দাহকার্য সমাধা করে দেব। আমার মস্তকে যেন কঠিন আঘাত লাগল। এতক্ষণ ছিল শুধু অন্তরের মহাশোক, এখন এই ব্যবস্থার সামনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। কোনোদিন মৃত্যু কি শ্মশান অভিজ্ঞতা নেই যার সে কী করে জানবে শ্মশানের কড়ির কথা? কড়ি কোথায় পাব আমি? এক লহমা বুঝি মনে হল পদ্মমাধব জানে এ কথা, তবু সে পাশে থাকল না, সে বলেছিল— বসে থাকো যতক্ষণ না তোমার পুত্

শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

Image
"একটি জম্বুবৃক্ষের নিচে রোহিতাশ্ব পড়ে ছিল। বিস্তৃত প্রস্তরপট। হয়তো অপরাহ্নে লোকজন এখানে এসে বসে। তার একপাশে বৃক্ষের শাখার তলে উপুড় হয়ে পড়ে ছিল আমার অসহায় বালকপুত্র । তার হাতে বৃক্ষের ক্ষুদ্র ভগ্নশাখা, আর মুখের কাছে, বৃষ্টি জলের মধ্যেও, এতটুকু রক্ত সেই অকরুণ শিলার উপর জমে আছে। স্বাচ্ছন্দ্যে আরামে সে জন্মেছিল, আরামে স্নেহে সুখে সে বেড়ে উঠেছিল। নিষ্ঠুর আত্মগর্বী রাজার অক্ষমণীয় অহংকারের কারণে সে আজ এইখানে পড়ে আছে। বুঝি যে মা তাকে দিনে তিনবার উদরপূর্তি করবার মতো আহাৰ্যটুকু দিতে পারে না, তাকে বিব্রত না করে সে নিজেই ক্ষুধানিবৃত্তির উপকরণ সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। আমার কিছুতে প্রত্যয় হয় না যে সে আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে। সে কি জানে না যে তার দুঃখিনী মায়ের জীবনে সে-ই একমাত্র অবলম্বন ? যদি মাকে সে ত্যাগ করে যায় তবে চার বৎসরের এত কষ্ট শত লাঞ্ছনা অপমান সহ্য করিয়ে সেই মাকে কেন সে বাঁচিয়ে রেখেছে? একদিন তার ক্ষুদ্র বাহু দুটি দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সে বলেছিল— মাগো, যদি তুমি মরে যাও আমি তবে কার কাছে থাকব? সেই কথা শুনে দুই মুষ্টি অধিক খাদ্যের আশায় আমি দুধের বালককে রৌদ্রে ঘ

শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

Image
"জ্ঞান হওয়া অবধি শৈব্যা শুনে এসেছে, মাতা ও সন্তানের সম্পর্ক দৈবনির্দিষ্ট। এজন্য সন্তানের জন্ম দিয়ে মাতৃমর্যাদা লাভই স্ত্রীলোকের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এবং পুত্রের জননীই সংসারে সমাজে সাক্ষাৎ দেবীস্বরূপা। সে মুহূর্তে মাতা ও সন্তানের মধ্যকার সেই দৈবনির্দিষ্ট অচ্ছেদনীয় সম্পর্কের কথা মিথ্যা প্রমাণ হল। কেবল অর্থশালী ক্রেতাটির কৃপাই শৈব্যাকে তার আপন শরীরসঞ্জাত সন্তানের নৈকট্য ভিক্ষা দিতে পারে। সেই সদ্যপ্রভু ক্রেতা অত্যন্ত পরুষভাবে উত্তর দিল— তুমি বরাঙ্গী, তদুপরি রাজমহিষী ছিলে, এ কারণেই চতুঃসহস্র স্বর্ণমুদ্রা তোমার জন্য ব্যয় করেছি। এর এক-চতুর্থাংশ মূল্যে কুশলা দাসী ক্রয় করা যায়। তার ওপর তোমার পুত্র ? অসম্ভব। এ আমার কোন কাজে লাগবে। আমি পরে শুনেছি সেদিন সেই প্রাঙ্গণে বহু জ্ঞানবৃদ্ধ, বহু শাস্ত্রজ্ঞ এমনকী কোনো কোনো মুনিও উপস্থিত ছিলেন। এই সমস্ত কিছু তাদের সকলের সামনেই সংঘটিত হচ্ছিল। যখন ভর্তা তাঁর পত্নীকে অর্থমূল্যে বিক্রয় করেছিলেন, যখন ধনবান বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি শিশুটির অপ্রয়োজনীয়তার কথা বলে মাকে ক্রয় করে নিজ আলয়ে যাচ্ছিল, যখন সর্বসমক্ষে ঘোষণা করেছিল যে অযোধ্যার মহিষীকে ক্রয় করছ

শৈব্যা কথন। জয়া মিত্র।

Image
"সেদিন হঠাৎ মহারাজ স্বয়ং এলেন অবরোধে। তাঁর মুখে কোনো কথা ছিল না কিন্তু সেই মুখ রক্তবর্ণ, তাঁর ভ্রূ ঝড়ের আগেকার আকাশের মতো থমথম করছে। স্তন্যপানরত রোহিতাশ্বকে কোল থেকে নামিয়ে আমি ত্রস্ত উঠে দাঁড়ালাম। মহারাজ আমার প্রকোষ্ঠ নিজের করতলে ধরে দ্রুত পদক্ষেপে বাইরের দিকে রওনা হলেন। কী যেন আতঙ্কে আমার বুকে স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে, মহারাজের এই পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা আমার অভ্যাস নেই। আমার আঁচল স্খলিত  হয়েছে, চুল খুলে গিয়েছে, কোনো কিছু সংবৃত করে নেবার কোনো অবসরই আমি পাচ্ছি না। অজানা কোন এক ভীতিবশে আমি শুধু কোনোরকমে নিচু হয়ে রোহিতাশ্বকে কোলে তুলে নিয়েছি। অকরুণ অন্যমনস্ক রূঢ় আকর্ষণে চলতে চলতে মনে ভাবছি মহারাজ কি আমার প্রতি অপ্রসন্ন হয়েছেন। বিধান করেছেন দণ্ডাদেশ ? আমাকে কি নিয়ে চলেছেন ঘাতকের কাছে? কী অপরাধ আমার হয়ে থাকতে পারে, কেন শাস্তি হতে পারে এসব বিচার করবার কথা আমার মনেও আসেনি, কেননা এসব ক্ষেত্রে কোনো কারণ সন্ধান কেউ করে না। কেবল একটিই কথা ভাবছি--- আমি নারী, সহজেই ক্রোধ উদ্রেক করতে পারি, দণ্ডদানের যোগ্য বিবেচিত হতে পারি, কিন্তু রোহিতাশ— এই যে সুকুমার নবনীকোমল শিশু, একেও