বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

আমাদের একশো কুড়ি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চির ওপর বসে আছে মা, বড় মণি, ঠাম্মার কোলে দাদা আর হাঁদা। মাত্র কয়েকমাস বয়েস তখন দাদার। শীতের রোদ এসে পড়েছে ওদের ওপর। সবাইকে খুশি খুশি লাগছে। পেছনে যে চাদরটা টাঙানো হয়েছে তার থেকে বেরোচ্ছে অনেক দিন পাট করে আলমারিতে তুলে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধ। বাবা কি সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছিল স্কুল থেকে? নাকি বাড়ি ফিরেই ছবিটা তুলেছিল? অথবা সেদিন ছিল হয়তো ছুটির দিন। উনুনে বসানো ছিল চায়ের কেটলি। সবাই ঘুরে ঘুরে একটু একটু করে চা খাচ্ছিল যে যার ইচ্ছে মতো। তাড়া ছিল না কারোরই। তখনও তো আমি নেই। তারও তিন বছর পর এই বাড়ির ওই বারান্দায়, চেয়ারে, রোদ্দুরে আমার দখল থাকবে। কিন্তু সত্যিই কি নেই আমি তখনও? নিশ্চই আছি। আমার সেই না থাকার গল্প গুলোও যেন হাওয়ায় ঘুরছে সেখানে। ওই রোদটাকে কি আমি দেখিনি কোনদিন? চিনি না বলছো? হাতের ওপর রাখলে দিব্যি তার থেকে শীত শীত গন্ধ বেরোয়। যেমন বেরোয় চৈত্র আর গ্রীষ্মের রোদেও। পাঁচিল থেকে হেলে পড়ে উঠোন আর বারান্দার ঠিক কোনদিকটা কখন সে পড়বে তার একটা হিসেব নিকেশ ছিল। সেইসব জানতো বাড়ির মিনি আর মোটাসোটা হুলোটাও। কেমন  নাক শুকে শুকে ওরা রোদ্দুরে গিয়ে কুন্ডুলি পাকিয়ে শুতো। উনুনের আঁচে বসানো ভুস ভুস করে ধোঁওয়া ওঠা চায়ের কেটলির জল একটু চা পাতার ওপর ঢাললে লিকার চায়ে কাপ ভর্তি হয়ে যেত। বড়ো মণি পেছনে পেছনে ঘুরতো “ওরে অতো চা খেলে ক্ষিদে মরে যাবে যে। এরা ছোটো থেকেই বাবার মতো মাস্টার হয়ে গ্যাছে।” বড় মণির দাঁত একটু উঁচু ছিল বলে কথা গুলো কিছুটা লোকে শুনতে পেত আর অনেকটা হারিয়ে যেত হাওয়ার সাথে। দাদা থামের আড়াল থেকে বড়োমণিকে ভ্যাঙাতো আদর করে। তাই দেখে মা চোখ বড় বড় করতো, “এই শিক্ষা হচ্ছে তোমাদের? গুরুজন বলে কথা”। সন্ধ্যে নামলেই ঝুপ করে কারেন্ট অফ হয়ে যেত তখন খুব। পড়ার আর কোন তাড়া থাকতো না। মাসের শেষ। কেরোসিন ‘নেই’ বলা যাবে না। বলতে হবে ‘বাড়ন্ত’। নেই নেই করলে গেরস্থের অকল্যাণ হয়। মা লক্ষ্মী রুষ্ট হন। কাজেই বাড়ির সবচেয়ে যার দরকার তার কাছেই থাকবে একটি মাত্র হ্যারিকেন। আর রান্নাঘরে জ্বলবে লম্ফ। এছাড়া পুরোটাই তো ‘ব্ল্যাক আউট’।

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ-রূপায়ণঃ শোভন সরকার

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৩০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।