নব বৈশাখের এক দিন। সেকালের সমাজচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা

"আমরা আমদহের যে বারের মেলা দেখিতে যাইতেছি, তাহা আমাদের গ্রামের ভটচাযের কীর্তি। খোকা গ্রামস্থ শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত কালীনাথ তর্কালঙ্কারের পুত্র, কিন্তু বাপের টোল থাকিলেও বিদ্যার সে ধার ধারিত না।পৌরোহিত্য ও গ্রহশান্তি করিয়া কোনো প্রকারে সংসার চালাইত এবং পিতার নামে বিকাইবার চেষ্টা করিত। পৌরোহিত্যে বিশেষ কিছু হয় না দেখিয়া একদিন রাত্রি-শেষে সে স্বপ্ন দেখিল। আমদহে তাহাদের যে ব্রহ্মোত্তর জমিটুকু ছিল, তাহার এক প্রান্তে আমবাগানের পাশে এক বেনা-ঝোপের নীচে সমাহিত থাকিয়া শিবঠাকুর তাহাকে স্বপ্ন দিলেন, 'মাটির নীচে বড় কষ্টে আছি, আমাকে তুলিয়া সেখানে স্থাপন কর, পূজা কর, তোর মঙ্গল হইবে।'... খোকা ঠাকুর তাহার স্বপ্নের কথা গ্রামে প্রচার করিল, তাহার পর ঢাক-ঢোল লইয়া গিয়া মাটির ভিতর হইতে শিবলিঙ্গ উত্তোলন করিল এবং একখানি ক্ষুদ্র কুটির নির্মাণ করিয়া সেখানে তাহাকে প্রতিষ্ঠিত করিল। শনিবারে মহাদেবের আবির্ভাব হওয়ায় প্রতি শনিবারে সেখানে উৎসব আরম্ভ হইল। নিকটবর্তী গ্রাম হইতে অনেকে পূজা দিতে আসিতে লাগিল। মহাদেবের মানত করিয়া কাহারও পুত্রের কঠিন রোগ আরোগ্য হইয়াছে, কোনো নারীর মৃতবৎসা-দোষ সারিয়াছে, কাহারও গাভীর দুগ্ধ বৃদ্ধি হইয়াছে-- খোকা ঠাকুর এইভাবে গ্রামে-গ্রামে দেবমহিমা প্রচার করিতে লাগিল। তাহার মৌখিক বিজ্ঞাপন বিফল হইল না। এখন প্রতি শনিবার বারতলায় মেলা বসিতেছে, দোকানিরা পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করিতে আসিতেছে, মেছুনি মাছের ঝুড়ি লইয়া মাছ বিক্রয় করিতেছে। দধি, দুগ্ধ, সন্দেশ, আম-কাঁটাল প্রভৃতি ফল বিক্রয় হইতেছে।

যুগে যুগে বিজ্ঞাপন-প্রচারের ফল দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। পাঁচ-সাত ক্রোশ দূর হইতেও কত গোরুর গাড়িতে চাপিয়া খোকা-ঠাকুরের শিবের পূজা দিতে আসিয়াছে। শিবের চালা ঘরখানির চতুর্দিক ভক্তমণ্ডলীর সমাগমে পূর্ণ। খোকা ঠাকুর টিকিতে একটি চাঁপা ফুল গুঁজিয়া, ললাটে রক্তচন্দনের ফোঁটা দিয়া এবং রুদ্রাক্ষের মালায় কণ্ঠ ভূষিত করিয়া লোহিত পট্টবস্ত্রে শিবের পূজা আরম্ভ করিয়াছে। ঠাকুরের পৌরোহিত্যের ভিন্ন-ভিন্ন ইউনিফর্ম আছে, প্রয়োজানুসারে সে তাহা ব্যবহার করে। জন্মাষ্টমীর অপরাহ্নে সে যখন তাহার যজমান বাড়িতে জন্মাষ্টমীর ব্রতকথা শুনাইতে যায়, তখন তার দেহ রাধাকৃষ্ণ-মার্কা নামাবলীতে আবৃত থাকে এবং কণ্ঠে তিনকণ্ঠী স্থূল তুলসীর মালা শোভা পায়। ললাটে, লোমশ বক্ষে হরেকৃষ্ণ-খচিত ছাপা। শিবের পূজা উপলক্ষে সে শাক্ত সাজিয়াছে। খোকাকে তাহার ভােল পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে উৎসাহভরে বলিত-- ভেক ভিন্ন ভিখ মেলে না রে ভাই! যে পূজার যে মন্ত্র, ওটা ভক্তির বাহ্যরূপ।

অদূরে একটা বটগাছ, তাহার ছায়ায় ভস্মাবৃত দেহ, কৌপীন-সম্বল কয়েকটা গেঁজেল-সন্ন্যাসীর সমাগম হইয়াছে। মুহুর্মুহু গাঁজা চলিতেছে, দুর্গন্ধে সেখানে দাঁড়াইবার উপায় নাই! কিছু দূরে তিন জন মেছুনি ইলিশ মাছ বিক্রয় করিতেছে, সুদূরবর্তী পদ্মার তীর হইতে তাহারা হাঁটাপথে রাতারাতি এই সকল মাছ আমদানি করিয়াছে। দারুণ গ্রীষ্মে মাছগুলি পচিয়া বালিশের মতো ফুলিয়া উঠিয়া নাড়ি বাহির হইয়া গিয়াছে। বহু দূর পর্যন্ত সৌরভ বিকীর্ণ করিতেছে, কিন্তু পচা ইলিশের ক্রেতার অভাব নাই। পল্লী-রমণীগণের ইহা উপাদেয় খাদ্য। কাঁটালের বিচি, সজনে-খাড়া ও পটল সহযোগে পচা ইলিশের ঝুরি তাহারা অমৃতোপম মনে করে।"

নব বৈশাখের এক দিন

সেকালের সমাজচিত্র
দীনেন্দ্রকুমার রায়
সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা

মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা

অলংকরণঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

#সুপ্রকাশ 

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।