সময় ভ্রমণ (দার্জিলিংঃ পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা)। সৌমিত্র ঘোষ

পাহাড়ের কাঁধে, মাথায়, নদীর পাড় দিয়ে, কখনও পাহাড় কেটে বা দুই পাহাড়ের মধ্যের খাঁজে ছোটো-বড়ো রাস্তা চলে গেছে নানা দিকে। কিছু রাস্তা পুরোনো। পুরোনো মানে সত্যিকারের পুরোনো, সায়েবরা এ অঞ্চলে ঢোকার আগেও সে-সব পথে স্থানীয়দের যাতায়াত ছিল। সমতল থেকে সিকিম ঢোকার পথ, নেপাল আর দার্জিলিং এলাকা হয়ে তিস্তা অবধি যাওয়ার পথ। জোসেফ ডালটন হুকারের হিমালয়ান জার্নালে সে সব পথের বর্ণনা আছে। কুচবিহার আর বক্সাদুয়ার হয়ে ভুটান, সেখান থেকে তিব্বত গিয়েছিলেন জর্জ বোগালে, হেস্টিংস সাহেবের দূত হয়ে। ওই পথে গিয়েছিলেন স্যামুয়েল টার্নার এবং চার্লস ল্যাম্বের বন্ধু ম্যানিংও। কিছু পরে উদ্ভিদতত্ত্ববিদ গ্রিফিথ। কোম্পানি শাসনের গোড়ার দিকের কথা, তখনও দার্জিলিং স্বাধীন সিকিম দেশের অংশ, কালিম্পঙ ভুটানের। দার্জিলিং-এর নিচের সমতল এলাকা, যেটা এখন দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমা, আর লাগোয়া বাংলাদেশের রংপুর, তার অনেকটাই দখলে ছিল নেপাল থেকে আসা গোর্খা সেনাদের। পাহাড় কেন, সমতলেও পথ বলতে সে অর্থে কিছু ছিল না। কলকাতা থেকে রংপুর হয়ে পাহাড়ে উঠতে ছ-সাত দিন থেকে পনেরো-কুড়ি দিন (১৮৩৮-১৮৩৯-এর এক হিসেব অনুযায়ী কলকাতা থেকে দার্জিলিং অবধি ডাক পৌঁছেতে ছ-দিন লাগতো) লেগে যেত।

পাহাড়ের পুরোনো পথঘাট কেমন ছিল বলতে গিয়ে সায়েবরা রোমহর্ষক সব বর্ণনা দিয়েছেন। পথের রেখা নেই বেশিরভাগ জায়গায়, বন কেটে পথ করে নিতে হয়। কোথাও চার হাতে পায়ে পাথর শিকড় লতাপাতা ধরে পাহাড় চড়তে হয়, কোথাও পাথরে ঠেকানো নড়বড়ে বাঁশের মই, বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে পিছল। অসংখ্য নদী এবং ঝোরার ওপর হয় বেত দিয়ে তৈরি ঝোলা পুল, নয় দড়ির সাঁকো, না-হলে আড়াআড়ি গাছের ডাল ফেলে রাখা। পথের বিপদের সঙ্গে বনের বিপদ, বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপবিছে, বাঘভাল্লুক। ওইসব পথে সায়েরা যখন তাদের তাবু আর সাজসরঞ্জাম সব নিয়ে স-ভৃত্য স-অনুচর যাত্রা করতেন, সে এক হই হই ব্যাপার হতো। পুরোনো পথগুলো কেবলই এক পাহাড় থেকে নেমে অন্য পাহাড়ে উঠতো। দার্জিলিং আর সিকিম অঞ্চলে প্রথম প্রথম যাচ্ছেন যে সায়েবরা, বারবার বলছেন, নদীর পাড় দিয়ে সহজ পথ বার করা যায়, সেটা না করে এতো কঠিন ঘোরাপথ কেন?

সুতরাং সায়েবরা রাস্তা বানানোয় মনোযোগী হলেন। ভালো পাকদণ্ডী, যা দিয়ে ছোটো ঘোড়া যেতে পারে। ইংরেজিতে বলা হতো, ব্রাইডল পাথ। পাহাড় কেটে সমান করে কিংবা পাথর ফেলে ফেলে এই জাতীয় পথ তৈরি হতো। ঘোড়া যাওয়ার উপযুক্ত ব্রাইডল পথ ছাড়া ছিল কার্ট রোড। উনিশ শতকের শেষপাদে পাহাড়ে রেল ঢুকছে, মোটরগাড়ি আরো পরে। প্রায় একশো বছর ধরে সমতল থেকে পাহাড়ে যাতায়াত হতো কার্ট রোড ধরে। কার্ট বলতে মূলত গরু আর মহিষ টানা গাড়ি, অবশ্য ওম্যালির গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে, ১৮৭৯ নাগাদ ট্রেন চলাচল শুরু হবার আগে অবধি টাঙ্গা করে দার্জিলিং পৌঁছাতে হতো। ঘোড়া যে পথে যেতে পারে গরু-মহিষ পারে না, ফলে চওড়া, আস্তে আস্তে উঠছে এমন পথ বানানো হতো।

দার্জিলিং পাহাড়ে যাবার একমাত্র পথ ছিল পাঙ্খাবাড়ি রোড। সে সময় পাঙ্খাবাড়ি থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত পুরো রাস্তাটাকেই বলা হতো ওল্ড মিলিটারি রোড। রাস্তাটা ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর তদারকিতে বানানো হয়েছিল, দায়িত্বে ছিলেন লর্ড নেপিয়ার। এখন যে পথে কার্সিয়াং থেকে দার্জিলিং যাওয়া হয়, সেই হিল কার্ট রোড তৈরি হবার আগে অবধি পাহাড়ের মাথায় মাথায় যাওয়া ওল্ড মিলিটারি রোডই ছিল আদি পথ। কার্শিয়াং-এর ঠিক ওপরে ডাউহিল। সেখান থেকে চিমনি বাগোরা হয়ে ওল্ড মিলিটারি বা ওল্ড কার্ট রোড চলে যাচ্ছে জোড়বাংলো হয়ে জলাপাহাড়ের চুড়োয়, জলাপাহাড় থেকে নেমে দার্জিলিং। পথটা এখনও আছে, অনেকটাতেই যাতায়াত করা যায়।

পুরোনো গাছগাছালি আর নিবিড় বনে ছাওয়া। পুরোনো ঘরবাড়ি, নতুন পুরোনো লোকজন নিয়ে গড়ে ওঠা জনবসতি। অনুপম নিসর্গ নিয়ে ওল্ড কার্ট রোড নির্জনে এককোণে পড়ে আছে, লোকজনের যাতায়াত সে পথে খুব কম। অন্তত কিছু দিন আগে পর্যন্ত তা-ই ছিল। তবে হোটেলওয়ালারা খবর পেয়ে গেছে, আর কতদিন সে নির্জনতা থাকবে বলা মুশকিল। বিধির বিধানের অন্য নাম উন্নয়ন। কে আটকাতে পারে!

বছর পঁচিশ আগে প্রথম যখন ওল্ড কার্ট ধরে জোড়বাংলো থেকে ডাউহিল হয়ে কার্শিয়াং এ নামি, ওই রাস্তার কথা বিশেষ কারোর জানা ছিল না। হিলকার্ট রোড ধরে দার্জিলিং-এর দিকে যেতে ডানদিকের পাহাড়ের মাথায় বনজঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা ওল্ড কার্ট রোড চোখে পড়ে না। সাধারণের যাতায়াতের গাড়ি অর্থাৎ বাস, ট্যাক্সি ইত্যাদি ওপথে যায় না। বাকি থাকে ইতিহাস।

সময় ভ্রমণ
দার্জিলিংঃ পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা

সৌমিত্র ঘোষ

প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

অলংকরণঃ অদ্বয় দত্ত, শুভশ্রী দাস
মুদ্রিত মূল্যঃ ৫০০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।