আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

📕 ক্ষয়িষ্ণু শীত-সকাল আর তেল-হলুদে স্নান।📕

আমাদের শহরে তখন সরস্বতী পুজোর খুব জাঁক ছিল। সব দেবদেবীর মধ্যে সরস্বতীই ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিজস্ব ব্যাপার, যাকে বলে এজমালি এলাকা। বারোয়ারি বা পাড়ার পুজোর বদলে স্কুল-কলেজ ছাড়া মুখ্যত তিনি ক্লাবে ক্লাবে পূজিতা হতেন। শহরের ক্লাবগুলি কী সব নাম ছিল। সেসব নামের মধ্যে আমাদের শহরটির সংস্কৃতির সৌরভ পাওয়া যেত— পূর্বপথ, আলোকলতা, সুবর্ণরেখা, কচি-কিশলয়, সখা-সংসদ, বীরপুরুষ, শিশিরবিন্দু, থাক, রূপবান, রূপারোপ, কোমলগান্ধার, সৃজনসাধী, রূপরাজ, উদয়াচল, ঝিলম, রূপায়ণ, রজনীগন্ধা, পূর্ব-বলাকা, শ্যামসজনি—ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ছাড়া বালক সংঘ, কিশোর সংঘ, সবুজ সংঘ, তরুণ সংঘ, আমরা কজন, আমরা সবাই, বিদ্যুৎ সংঘ, সেভেন বা নাইন বুলেটস্, সেভেন স্টার—এসব তো ছিল। অলিতে-গলিতে গণ্ডায়-গণ্ডায়!

ভালো করে লক্ষ্য করতে বোঝা যায়—সে-সময় সরস্বতী পুজোয় ত্রিস্তর ক্লাব ব্যবস্থা চালু ছিল। প্রথম স্তরে ছিল বড়োদের ক্লাব, তার পরের বয়ঃস্তর বা সদ্য যুবকদের ক্লাব, বাকি সব কচিকাঁচাদের ক্লাব। নিজের নিজের স্কুল-কলেজ লাইব্রেরি ছাড়াও আমরা প্রত্যেকেই পাড়ায় বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোনো-না কোনো ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকতাম। তখন আদরের একমাত্র সন্তানটির জন্য বাড়ির মধ্যেই সরস্বতীর আরাধনার আয়োজন ছিল না, সে শুধুমাত্র অর্থ ছিল না বলে নয়, হয়তো মানুষ তখন বাড়িতে নয়, বাস করত সমাজে।

সরস্বতী পুজোর আগে স্কুলে পড়াশোনা শুরু হতো না—তাইরে নাইরে না করে আমরা বছরের প্রথম মাসের দিনগুলো কাটিয়ে দিতাম। সরস্বতী পুজোর উদ্‌যোগ-আয়োজনে বিপুল শ্রম ও উদ্যম ব্যয় করার পর এবং কুল না-খাওয়া সম্পর্কে বিধিনিষেধ কঠোরভাবে অনুসরণের পর অবশেষে শিশিরভেজা শীতগন্ধ মেখে সেই পুজোর দিনটি এসে পড়ত।

পুজোর আগেরদিন রাত্রে অর্ধ-জাগরণ, ভোরবেলায় হিম গায়ে মেখে, ঊষাকালে অস্তমান শেষ নক্ষত্রটিকে সাক্ষী রেখে বালক-বালিকা কিশোর-কিশোরীর দল। ফুল তুলতে বেরিয়েছে ভোরের কাকলি তখনও অশ্ৰুত অথবা নিঃশব্দ, চোখের ইশারায় গৃহস্থের আঙিনা থেকে ফুল তোলা সারা। প্রায় কারও বাড়িতেই ফুলের বাগানের স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবু অধিকাংশ বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে উকি দিত বারোমেসে টগর, কিংবা আঙিনায় দু-তিন রঙের গাঁদা, কুন্দ ফুলের চিরসবুজ ঝোপ তো পাওয়াই যেত।

যারা ডাকাবুকো -- তারা তো আরও আগে, ভোররাত্রে উঠে পড়েছে, বাড়ির সকলের নজর এড়িয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়েও পড়েছে পুজোর ফুল সংগ্রহের জন্য! ফুলের বাগানওয়ালা গৃহস্থের সঙ্গে সে-এক অদ্ভুত লুকোচুরি। গৃহস্থ জানেন ফুল চুরি হবেই—তবু পাহারার ব্যবস্থা রাখা হতো না। পাহারা রাখা হলেও ফুল চোরেরা সুকৌশলে কাজ হাসিল করত ঠিকই। ফুলচোরদের নীতিবোধ এমনই ছিল যে, গাছ মুড়িয়ে কেউ ফুল তুলত না—গৃহদেবতার বরাদ্দের ফুলটুকু রেখে বাকিটা তারা সুনিপুণভাবে তুলে নিয়ে যেত।

চোখের ইশারার সেই ভাষা শুধুমাত্র কিশোর-কিশোরীদের কাছেই পাঠযোগ্য ছিল, পরিচিত ছিল হয়তো সেই চোখ-মুখের সমূহ-বর্ণমালা—শুধু পাত্রবিশেষে বদলে যেত নিরুচ্চার্য ভাষাপাঠের সেই পদ্ধতি!

সেদিন খুব ভোরে ওঠা, কোনো কুঁড়েমি নয়।

সকালে গা শিরশিরানি শীত।

সরস্বতী পুজোয় দিন-দুয়েক বয়ঃসন্ধির কিশোরেরা ও সদ্য-যুবকেরা পথেই থাকত সারাদিন।

মেয়েরাও কম যেত না। বড়োরা ছেলে আর মেয়েদের পারস্পরিক উপস্থিতিকে কান এবং মাথা, আগুন আর ঘি-এর সঙ্গে তুলনা টানতেন। তাই ঐ দুদিন কোনো দিদি সাজুগুজু করে রাস্তা দিয়ে গেলে আমরা বলতাম—'ঐ যে আগুন চলে গেল। পেছন পেছন পাড়ার কোনো লায়েক দাদার পদচারণা ঘটলে বলতাম— “ঐ যে এবার ঘি গড়াচ্ছে। আমাদের বিচার-বিবেচনা মতো সৌন্দর্য, গুরুত্ব, আভিজাত্য, আগুন জ্বলবার সম্ভাবনা অনুযায়ী আগুন আর ঘি-এর আকার ও ওজন স্থির করতাম আমরা। ভয়ানক চোখা কোনো সুন্দরী গেলে বলা 3[8]- ওরে, মশাল চলে গেল। খুব সেজে-গুজে গেলে 'রঙমশাল', সাধারণ হলে দেশলাই কাঠি।

আমাদের পাড়ার নন্দিতাদিরা তিন বোনই ভয়ানক সুন্দরী, রবীন্দ্রনাথের মতো করে বললে—যাদের সৌন্দর্য অন্যায় রকমের, যাকে বলা যেতে পারে বিধাতার বাড়াবাড়ি। কিন্তু নন্দিতাদিরা সব সময়েই মায়ের সঙ্গে বের হতো। আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে রাস্তায় কখনও চোখ তুলে ছেলেদের দিকে তাকাতো না। তাদের আমরা বলতাম 'পাঁচ-ব্যাটারি'র টর্চ—আলো আছে, বিভা আছে, বিচ্ছুরণ আছে—নেই শুধু উত্তাপ, আমাদের মাণিক্যর ভাষায় এই ধরনের সুন্দরীরা 'অনাগুন ’ বা ‘নিরাগুন।' ছেলেদের পরিচয় হতো ওজনে-- যোগ্যতানুযায়ী তারা একশো গ্রাম থেকে এক কিলো পর্যন্ত ঘি—শুধু সদ্য ডাক্তার হয়ে আসা সবুজদা ছিল একেবারে এক টিন!

সকালে অঞ্জলি দেবার পরে ছেলেরা চোখ মেলে দিত পথে পথে। আর মেয়েরা হাসির পশরা নিয়ে সে-পথ আলো করে চলে যেত। ছেলেরা তো যেমন-তেমন, মেয়েরা সেদিন হোল-সেল শাড়ি। ক্ষয়িষ্ণু শীতভাঙা রোদে অধিকাংশেরই পরনে লাল পাড় বাসন্তী রঙ। তাদের হাতে-পায়ে সকালের তেল হলুদে স্নানের চিহ্ন অনেক স্পষ্ট। আর সকলেরই মাথা ঘষা, ফাঁপানো চুল ছাড়া পেয়ে উড়ন্ত। শ্যাম্পু আর কণ্ডিশনারের যুগলমিলনের বাহার তো আর ছিল না—মাথাঘষার কাজে সৌখিনরা ‘শিকাকাই' সাবান ব্যবহার করতো। তার অভাবে কাপড়-কাচা বল সাবানও ব্যবহৃত হতো, কিংবা রিঠে ফল ভিজিয়ে রেখে তার জল–সুতরাং চুলের অবস্থা কন্ডিশনার ছাড়াই একেবারে ‘কণ্ডিশনড্ যাকে বলে। চুল ছোটো হোক বা বড়ো হোক, মসৃণ হোক বা কর্কশ হোক, সোজা হোক বা কোঁকড়া হোক—সকলেরই তেলহীন খোলা-চুলের বাহার।

বিকালে সকালবেলার বাসন্তী রঙের শাড়ির রঙ বদল হয়ে তা রঙ-বেরঙের। কিন্তু সরস্বতী পুজোর সন্ধ্যায় উপকরণের ঘাটতিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে কত কবিতার জন্ম হতো, অনবরত দৃষ্টির বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে কত রূপোন্যাসের সূচনা হতো।

তার শুরু তেল হলুদে হলেও অধিকাংশই তেল হলুদে শেষ হতো বলে মনে হয় না। শিশিরে আর্দ্র গাছতলায় ঝরে পড়া ফুলের চলিষ্ণুতায় জীবন কাকে, কোথায় কতদূর নিয়ে যেত তা জীবনই জানে।

আহাম্মকের খুদকুড়ো
দুর্লভ সূত্রধর

প্রচ্ছদ: সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ: দুর্লভ সূত্রধর

মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।