নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

অনেক রাতে মর্গে নিয়ে যাওয়ার পরে বডি ওপেন করে রাখা হয়েছিল স্ট্রেচারে। এমন ভাবে যে সবসময় রাখা হয় তেমন নয়। কিন্তু সেদিন হয়েছিল। কেন? তা কেউ জানে না। জানতে চায়নি। ডোম খুলে নিয়েছিল জামাকাপড় সব। উদোম হওয়া দেহটার ওপরে ঝুলছিল একটা পাওয়ারফুল বাল্ব। তার আলোতেই ডোম দেখেছিল গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া একটা লাশ। তার বাঁদিকের ভুরুতে একটা কাটা দাগ। মুখে টোল খাওয়া হাসির এক নীরব প্রসন্নতা। এতো কষ্ট করে মরেও হাসি পায় তাহলে মানুষের? কি ভীষণ নির্মল এক শান্তি আছে যেন শুয়ে থাকা শরীরটায়। আছে এমন একটা কিছু যা জ্যান্ত শরীরকেও টানে। ইচ্ছে করছিল ডোমের লাশের ভুরুর ওপরে কাটা দাগে একটা চুমু খেতে। কিন্তু সুযোগ হয়নি। ভুরুর কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়েও ফিরে এসেছিল সে। কার যেন পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল। চকিতে তাকালে আমাকে দেখেছিল দরজার কাছে। “কৌন হ্যায় আপ? এখানে কী করছেন? ঢোকা শকত মানা আছে।” একশো টাকা গুঁজে দিয়েছিলাম হাতে। লোকটা “হারামির বাচ্চা” বলে খিস্তি মারতে মারতে বাইরে চলে গিয়েছিল। খুব কাছ থেকে দেখছিলাম মন্টুকে অনেক দিন পরে। তার নিরাভরণ শরীরে তখনও সুইমিং পুলের জলীয় আভা। বাল্বের চড়া আলো শুষে নিচ্ছে যেন দেহটাকে। এইভাবেই কি মরতে চেয়েছিল মন্টু? এইভাবেই শুয়ে থাকতে হতো তাকে মর্গের টেবিলে? আর কেনই বা আমি এসেছি এমন বিপদের মুখে পড়তে আবার? কাকে খুঁজছি আমি? আমার ছোটবেলাকে? হারিয়ে যাওয়া এক জনপদকে? নাকি একটা মানুষকে যে আসলেই কালপুরুষ দেখতে ভালোবাসতো। যার জঠরে লুকোনো রয়েছে গোটা একটা সময়। আমাদের জীবনের প্রথম সমস্ত পাপ। হঠাৎ মনে হল ভ্যাপসা মর্গটা নদীর শীতল হাওয়ায় ভরে গেল। দুপারের কুশ ঘাসের ঝোপ হাওয়ায় মাথা তুলে দুলে উঠলো। স্ট্রেচারটা যেন নড়ে উঠলো নৌকার মতো। ওই তো মন্টু উঠে বসছে আস্তে আস্তে। ওই তো আমার দিকে তাকিয়েছে সে। নৌকার পালে লেগেছে হাওয়া। নৌকা বইছে তরতর করে। “হেঁইয়ো হো... হেঁইয়ো...হো...হেঁইয়ো হো...ঝড় ভাঙা ঘর কত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবে...” কারা যেন কোরাসে গাইছে। গর্জন করছে। বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই গান। তারমধ্যে সেই ঘোর লাগা অন্ধকারে বয়ে চলেছে দুই কিশোর। একজন ফিসফিস করে বলছে “কালপুরুষকে যারা ভালোবাসে...”। কৈশোরের ঠোঁটের ওপর এসে পড়ছে আর একটা ঠোঁট। ভরে যাচ্ছে চারিদিক কেয়োকার্পিন তেলের গন্ধে। জ্বলে যাচ্ছে মনে হচ্ছে দুটো শরীর। তাকিয়ে থাকছে একটা ছেলে অপলক আর এক ছেলের নিরাভরণ শরীরের দিকে। ছলাৎ ছলাৎ করছে নদীর জল। মায়া আবরণে ঘিরে ধরছে নদী সভ্যতা, বন্দর, মানুষের জীবনের প্রথম সব কিছু।  একটা গোটা ইতিহাস আবিষ্কার করছে যেন তারা। “হেঁইয়ো হো...হেঁইয়ো হো... হেঁইয়ো হো...” দুটো শরীর আঁকড়ে ধরছে একে অপরকে। ম্যাজেলানের পৃথিবী পরিক্রমণের মতো ওরা একে অপরকে বেড় দিয়ে বেঁধে ফেলছে। টিমটিম করে জ্বলছে লন্ঠন। দূরে বন্দুক তৈরীর কারখানা থেকে ধোঁওয়া উড়ছে। বারুদের মতো ছাই হয়ে ঝরে পড়ছে দেহ একে অপরের ওপর। “জ্বলে পুড়ে মরার চেয়ে ভালোবাসায় মরা অনেক ভালো”। কেন বলেছিল মন্টু কানের কাছে ফিসফিস করে এই কথা? তারপর থেকে আর দেখা হয়নি তাদের কোনদিন। ইচ্ছে করেই যোগাযোগ রাখেনি কেউ কারোর সাথে। আজ তাহলে এতোদিন পরে কেন আবার? আমি জানি। ঠিক জানি। ইচ্ছে করেই গিয়েছিল মন্টু ওই তেরো তলার সুইমিংপুল বারে। হারানো কৈশোরের সাথে দেখা করতে। লুকিয়ে চালান দিতে তার একমাত্র শেষ সম্বল ধূসর লাল রঙের ডায়েরী। গলা খাঁকাড়ি দেয় ডোমটা। বুঝতে পারি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। “আভি জায়গা তো কুছ নেহি হোগা...সাবলোক সব আ রাহা হ্যায় ইধার। এক নোট পর ইতনাহি...”। বেরিয়ে এসেছিলাম। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি মন্টুর সাথে কোনদিন। সত্যিই কি দেখা হয়নি? আমাকে কি ফিরে যেতে হয়নি ক্লাস টেনের ওই ঘরটায়? একটা লাস্ট বেঞ্চ কি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকেনি? ফিসফিস করেনি নদীর ধারের কুশ ঝোপ গল্প শোনার অছিলায়? “তারপর...তারপর কী হলো...” বলে বিরক্ত করে তোলেনি? এর বেশ কিছু দিন পর একদম সক্কালবেলায় বিগত রাতের নেশার ক্লান্তিতে সামনের ফ্ল্যাটের ঘুলঘুলিতে একটা ভুতুম প্যাঁচাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলাম। পাখিটা তাকিয়ে ছিল আমারই দিকে। কেমন যেন ড্যাব ড্যাব করে। ভাবখানা এমন “ভুলে গেলি সব?” সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল সেবার। কি ভুলে যাচ্ছি আমি? কাকে? আয়নার সামনে এসে যখন দাঁড়ালাম, জানতাম ঠিক, যেভাবে নিজেকে সাজিয়েছিলাম এতোদিন ধরে তেমনটা আর ফিরে পাবো না কোনদিন। বছর ষোলোর একটা ছেলে আয়নার মধ্যে থেকে তাকিয়ে ছিল যেন আমারই দিকে। যাকে চিনতাম আমি বহুযুগের ওপার থেকে। হঠাৎই আমার চারপাশটা বদলে গেল। ছোট্ট ফ্ল্যাটটা পালটে গিয়ে হয়ে গেল পুরনো একটা বাড়ি। কতদিনের পুরনো একটা পাড়া কোথা থেকে যেন উড়ে এসে জুড়ে বসলো আমার সামনে। একটা হারানো সময় ফিসফিসিয়ে বললো, “ফিরে যেতে হবে...দূরে...বহুদূরে...”। নদীর ধারের কুশ ঘাসের ঝোপটাকে যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মাথা দোলালো তারা। বুঝতে পারলাম এখানে এই মুহূর্তে যা অভিনীত হবে তা পূর্বনির্ধারিত। পূর্ব পরিচিত। আমাদের ফেলে আসা টুকরো পথের অংশ। থার্ড বেলের আওয়াজ কানে বিঁধলো হুইসিলের মতোই। সাদা পর্দার ওপরে এসে পড়লো প্রজেক্টারের নরম আলো। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারিনি এই চিত্রনাট্য আমি লিখতে চাইনি কোনদিন। আমার লেখার কথা ছিল না। কেউ সুপারিশ করেনি এইসব লেখার। সাদামাটা ধরতাই গল্প লিখলেই জীবন কেটে যেত। বাধ্য হলাম সেই গলিটায় ঢুকতে। অনেক চেনামুখ তাকিয়ে থাকলো স্পষ্ট। কেউ কেউ ফিসফিস করে বললো “শব্দহীন হয়ে যাও। বলো না সব কথা সবাইকে। ওরা তোমায় গুম করে দেবে। কিম্বা ঘুম পাড়িয়ে রাখবে আজীবন”। আমি কারও কথা শুনিনি। শোনার মতো পরিস্থিতি ছিল না। সাদা বরফের মতো উড়ছিল কাগজগুলো। আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম ঝিরঝিরে সেই উড়ো কাগজের বরফের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন নিঃসঙ্গ লেনিন। দেখছিলেন তাঁর সমাজতন্ত্র টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার মুহূর্তগুলোকে।

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।