বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

“এক দেশে এক রাখাল ছিল। খুব গরীব ছিল তারা। সারা দিন মাঠে গরু চড়িয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতো। সকালবেলা মাঠে যাওয়ার সময় শুকনো রুটি নিয়ে যেত। দুপুরবেলায় যখন খুব ক্ষিদে পেত গাছের ছায়ায় বসে শুকনো রুটি আর গুড় খেত। খাওয়ার সময় রোজ ভাবতো যদি এখানে একটা পিঠে গাছ থাকতো বেশ মজা হতো। রোজ গরম গরম পিঠে খেতে পারতাম।”

রাখালের পিঠে খাওয়ার গল্পটা একটা ফাঁকা দোতলা বাড়িতে হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতো। ঠিক দু' কানের ওপর হাত দিলে যেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় তেমন। দিদার ফিসফিসে গলায়, সন্ধ্যের হ্যারিকেনের অল্প আলোয়, শীতের এক লম্বা ছুটিতে আমার সাথে রাখালও এসে ওই বাড়িটায় থাকতো। কিন্তু আমার তো আর রাখালের মতো সাহস নেই। সারাদিন মাঠে মাঠে হইহই করে ঘুরে বেড়ালেও গরু তো চড়াইনা। বাঁশিও বাজাই না। বলতে গেলে পারি না কিছুই। কাজেই একটু একটু ভয় করে আমার। হিসি পেলে সিঁড়ির কোনের জানলা দিয়ে হয়ে যায় ওটা চোখ বন্ধ করে। কিন্তু ঘুম? আমি আরও জড়িয়ে মড়িয়ে লেপ কম্বল আর শীতের চাদরে দিদার গায়ের মধ্যে সিঁধিয়ে থাকি। কারণ আমি জানি গল্পের সূত্র ধরেই আর একটু পরেই তো রাখালের স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে একটা মস্তবড় পিঠে গাছ গজিয়ে উঠবে। সেই গাছের ডালে ডালে ঝুলতে থাকবে কত কত মিষ্টি পিঠে। আর সেই পিঠে গাছে উঠে যখন রাখাল মিষ্টি পিঠে খেতে শুরু করবে ঠিক তখনি গাছের তলা দিয়ে যাওয়ার সময় ডাইনী বুড়ি দেখতে পাবে তাকে। রাখালের সেই হৃষ্ট পুষ্ট নধর চেহারা দেখে বুড়ির ভারী লোভ হবে। সে রাখালকে কাতর স্বরে বলবে “একটা পিঠে দে না রাখাল। বড় ক্ষিদে পেয়েছে।” রাখাল তো আর ডাইনিকে চেনে না। তার বড় মায়া হবে। আহা রে বুড়িটার কি ক্ষিদেই না পেয়েছে। সে বলবে “ঠিক আছে হাত পাতো তোমার হাতে পিঠে দিচ্ছি”। ডাইনি তো চালাক। তার নানান ছল চাতুরি জানা আছে। সে বলবে “হাতে নিলে ছ্যাঁকা লাগবে”। রাখাল বলবে “তাহলে আঁচল পাতো”। বুড়ি বলবে “পুড়ে যাবে”। “তাহলে মাথা পাতো”। “উকুনে খাবে”। রাখাল দেখে আচ্ছা মুশকিল। “তাহলে দেবো কী করে? মাটিতে ফেলে দিই?” বুড়ি আঁতকে উঠবে। “না না পিঁপড়েয় খাবে। তুমি বাছা যদি একটু নেমে এসে আমার এই হাতের ঝোলাটার মধ্যে দিয়ে দাও তাহলে বড় উপকার হয়”। রাখাল আর কি করে! অগত্যা গোটা কতক পিঠে পেড়ে যেই না বুড়ির ঝোলার মধ্যে দিতে যাবে অমনি বুড়ি টুক করে সেই ঝোলাটার মধ্যে রাখালকে পুরে নেবে। আর কিছুতেই রাখাল সেই ঝোলাটার মধ্যে থেকে বেরোতে পারবে না। হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যাবে সে। ঠিক তখনই আমার চারপাশেও জমাট বাঁধবে ঘুমের অন্ধকার। যেখান থেকে আমিও সহজে বেরোতে পারবো না। রাখালের মতোই বন্দী হয়ে থাকবো দিদার সেই সুন্দর করে বলা গল্পে। মাঝে মাঝে পরশ পাবো দু'খানা হাতের। যে হাত দুটো কিছুক্ষণ পর পরই আমার গায়ের ওপর ঠিক করে দেবে লেপখানা। যে হাত দুটো মাঝরাত পর্যন্ত চুপটি করে বসে বসে ভাজবে পাটিসাপটা। অনেক সকালে ঘুম থেকে তুলে দিয়ে পাট কাঠির স্ট্র বানিয়ে খেতে দেবে রহমান চাচার এনে দেওয়া টাটকা খেজুর রস। তারপর দাঁত মাজিয়ে, চুল আঁচড়িয়ে আমার সামনে এনে ধরবে একটা সুন্দর নক্সা করা চিনা মাটির কৌটো। যার মধ্যে তখনও ঘুমোচ্ছে রাখালের সেই পিঠে গাছ থেকে পেড়ে দেওয়া পিঠে গুলো। কিন্তু সেতো তখন ডাইনীর সেই বড় ঝুলিটায় বন্দী। সেখান থেকে রাখাল ছাড়া পেল কী করে? দিদার শান্ত মুখে হাসি। সেটা শুনতে গেলে তো আবার সন্ধ্যে নামতে হবে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডেকে উঠবে ঝিঁ ঝিঁ। জোনাকিগুলো বাড়ির চারপাশে টিমটিমে আলো জ্বালাবে। তার তো দেরী আছে ঢের। দুটো পিঠে হাতে নিয়ে তাই ছুট...ছুট...। এ বাড়ি, সে বাড়ি। এ পুকু্র, ও পুকুর। এ গাছ, সে গাছ করতে করতে আবার ফিরে আসা। পিঠের কৌটো খুলে সারাদিন ধরে একটা একটা করে পিঠে খাওয়া। আমার দিদা আমার কাছে তাই সেই মিষ্টে পিঠের কৌটোটা।

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ-রূপায়ণঃ শোভন সরকার

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৩০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।