ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার
"আব্বাহুজুর বরাবরই আমার দুরের মানুষ। আম্মিজানের কথা ভাবলে একটা দৃশ্যই চোখের সামনে ভেসে ওঠে—তিনি মাথায় পশমি কাম্বাদার পরিয়ে আমাকে শীতের রোদ্দুরে ছেড়ে দিচ্ছেন। জায়গাটা কোথায় মনে নেই। এরপর তো বিদ্রোহী শাহজাদা খুররমের সঙ্গে তিনিই ফেরার হলেন। সঙ্গে আর সব পুত্র কন্যারা, এক আমি ছাড়া। আমার দুধদাঁত পড়ে নতুন দাঁত ওঠা সমস্তই নূরজাহান বেগমের খাসমহলে। তাঁকেই আম্মি ডাকতাম। আসল আম্মি যখন বাদশাবেগমের মুকুট পরে হাতির হাওদায় দুলতে দুলতে আগ্রা আসেন, ততদিনে আমি এগারো বছরের নওল কিশোর। আমাদের জন্য বরাদ্দ আলাদা মহল। ভাইয়ে ভাইয়ে পাশাপাশি পালঙ্কে ঘুমালেও আমরা কেউ কারও দোসর ছিলাম না। আমরা যদিও একই বাবা-মার সন্তান, তবু যেন কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের মতো স্বতন্ত্র প্রাণী। আব্বাহুজুরের নজরেও তাই। আমরা যার যার মতো দেয়ালবন্দী হয়ে পড়ি, আম্মির ইন্তেকালের পরেই কি? উঁচু আর পুরু দেয়ালের গায়ে অনিঃশেষ থাবা মারছি, আঁচড় কাটছি—মনে হয় আমার এ রকম পাগলা দশায় বাংলার নিবাস। বাংলার রাজধানী তখন জাহাঙ্গীরনগর। হুমায়ূন বাদশার আমলে ছিল গৌড়। ঘন ঘন মড়কের উপদ্রবে ত্যক্ত হয়ে গৌড় থেকে তাণ্ডায় রাজধানী সরিয়ে আনেন আফগান সুলতান সোলায়মান কররানী। মাত্র ত্রিশ বছর তা এখানে স্থিত হয়। তারপর রাজমহল ঘুরে ইসলাম খানের হাত ধরে রাজধানী শহর চলে যায় জাহাঙ্গীরনগর। ওখানে যখন আমি সুবেদার হয়ে যাই, তখন আমার শরীরে তেইশ বছর বয়সী টগবগে খুন। আজাদির আস্বাদ কে না চায়? বাংলার সুবেদারি দিনে দিনে তোফা মনে হলো।
কখন আমার মাথায় ছত্র ধরেছে এক দেহরক্ষী। আমি যেন স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো বৃষ্টি-বাদলে হাঁটছি। কোনো লক্ষ্য নেই, নিশানা নেই, কোথায় যাচ্ছি জানি না। তলোয়ারসমেত কোমরবন্ধ ঝুলে পড়েছে। পায়ের এক পাটি জুতাও গায়েব। বেহদ্দ মাতাল অবস্থায় জল-কাদা ভেঙে চৌকির পর চৌকি পেরিয়ে নদীকূলে চলে আসি। গঙ্গায় উথাল-পাথাল ঢেউ। ঢেউয়ের মুখে ছোটো ছোটো আলোর ফুলকি। জলের কলস্বরও জীজা বাঈয়ের গীতের মতো করুণ শোনায়—'আলি রে হরি বিনে রহা নাহি যে যায়/কত জনমের এ ভালোবাসা, কেমনে রাখি লুকাই।' আমার পেছনে এক পাটি জুতা হাতে সে খানসামাটি দাঁড়িয়ে, তার হাতে আরেক পাটি দিয়ে আমি পানিতে নামি। তন-মন যেতে চাচ্ছে ওপাড়ে, কিন্তু হিম্মত কই। কদিন আগেই রাজমহল থেকে দোগাছি, দোনাপুর, সুতি— টানা তেরো ক্রোশ দীর্ঘ নদীতট মিরজুমলার দখলে ছিল। আজ মুহম্মদ বিনে দোগাছির কোমর ভেঙে গেছে। দোনাপুর, সুতি থেকেও শিবির গুটিয়ে মকসুদাবাদে ঘাঁটি গেড়েছে মিরজুমলা। তার বাকি ফৌজ রাজমহলে। আমার রাজমহল, কত শখ করে গড়া সঙই-দালান, মচ্ছিভবন, দেওয়ানখানা, আনন্দ সরোবর।
জাহাঙ্গীরনগর ছেড়ে আমি যখন রাজমহলে চলে আসি, তখন এ ছোটোখাটো কসবা বৈ কিছু নয়। রাজা মানসিংহের গড়া প্রাসাদগুলোতে ভূতের রাজত্ব। চোখ মেললেই পাহাড়, ঘন জঙ্গল, নয়তো পগার বা নদীর ধূ-ধূ বালুচর। আমার সঙ্গে ছিল নবপরিণীতা দুসরা বেগম পরী বানু। আমাদের শাদির দোবারা অনুষ্ঠান হয় রাজমহলে। ভূতুড়ে প্রাসাদে ফের আস্তর পড়ে। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে যায় বিশাল বিশাল কাঠের বাড়ি। তখনকার রাজমহল পরগণার ফৌজদার যাবতীয় শান-শওকতের আয়োজন করেন। বাজার, দোকানপাট, কামারশালা, হুনুরিদের কারখানা, সরাই, বেশ্যালয়, ফকিরের আখড়া—কোনো কিছুই রঙিন বাতির সাজ থেকে বাদ গেল না। মুহুর্মুহু আতসবাজিতে রাঙা আকাশ। রাত-দিন বাজছে মসুলের জয়ঢাক, মিসরের বাঁশি, পারস্যের সানাই। যে আগুনে আমার এত ভয়, বছর না ঘুরতেই কাঠের প্রাসাদ পুড়ে ছারখার। যেন আগুন নয়, এ ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যু। তাতে পানিও তেলের মতো কাজ করে। চোখের সামনে আস্ত হারেমখানা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ফৌত হলেন মহলের অসংখ্য জেনানা। শাহজাদি গুলরুখ বানুরও জন্ম তখন। বাচ্চা ধরার মতো হারেমে কেউ না থাকায় ঢেঁড়া পিটিয়ে দাই তালাশ করতে হয়েছিল। এই তো সেদিনের কথা। ইয়া আল্লাহ্, এর মধ্যে সে কেমন লায়েক হয়ে উঠেছে। আমার টুটা-ফাটা শাহি সেলাই দিয়ে জুড়তে চাইছে আমার কন্যা শাহজাদি গুলরুখ বানু।"
ময়ূর সিংহাসন
শাহীন আখতার
মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment