সেকালের পল্লীর বাসন্তীমেলা। সেকালের সমাজচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সম্পাদনা: শতঞ্জীব রাহা

"আমাদের বাসভবনের পূর্বসীমায় গ্রামের যে প্রধান পথ থানা হইতে গ্রাম-প্রান্তস্থ আদালত পর্যন্ত প্রসারিত, সেই পথের পূর্বে একটি প্রশস্ত ময়দান অবস্থিত, বহুকাল হইতে তাহা 'গড়ের মাঠ' নামে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে, নবাবি আমলে গোয়ালা চৌধুরী নামক ভূস্বামীগণের এখানে গড় ছিল এবং তাহার নীচে ভূগর্ভে যে পাতাল-ঘর ছিল, সেই পাতাল-ঘরে এই রাজপরিবারের ধনসম্পত্তি সঞ্চিত থাকিত। রাজবাটি কিছু দূরে ছিল। একবার মারাঠা ফৌজ রাজবাড়ি লুণ্ঠন করিতে আসিলে রাজপরিজনবর্গ সেই পাতাল-ঘরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। বর্গীরা পাতালঘরের সন্ধান না পাইলেও যে রক্ষীর নিকট পাতালঘরের বহির্দ্বারের চাবি ছিল, সেই রক্ষীকে হত্যা করে। এজন্য রাজপরিবারস্থ কোনো লোক পাতালঘরের বাহিরে আসিতে পারেন নাই, দীর্ঘকাল রুদ্ধগৃহে আবদ্ধ থাকিয়া তাহারা প্রাণত্যাগ করেন। সেই সময় হইতে প্রবাদ, এই মাঠে কেহ গৃহনির্মাণ করিয়া বাস করিলে তাহাকে নির্বংশ হইতে হইবে। এই জন্য এই মাঠে কেহ গৃহনির্মাণ করিয়া বাস করে না। এই মাঠেই খেলার স্থান নির্বাচিত হইয়াছিল।
মেলা বসাইবার পূর্বে এই মাঠটির বিভিন্ন অংশে বহু সংখ্যক অস্থায়ী কুটির নির্মিত হইয়াছিল। দুই পাশে সারি সারি কুটির-মধ্যে প্রশস্ত পথ। সম্মুখে সমুচ্চ বংশতোরণ। তোরণের অদূরে অত্যুচ্চ মঞ্চ নহবৎখানায় পরিণত। মেলার সময় প্রভাতে, মধ্যাহ্নে, সায়াহ্নে, গভীর রাত্রিতে এই মঞ্চে সুস্বরে নহবৎ বাজিত। কুটিরগুলির কোনো অংশে জুতার দোকান ; কৃষ্ণনগরের সরভাজা, সরপুরিয়া ; বহরমপুরের ছানাবড়া, খাগড়াই মুড়কি ; বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা ইত্যাদি বিভিন্ন জিলার বিখ্যাত খাদ্যদ্রব্যের দোকান। 
........................................................
বাসন্তী পূজার সঙ্গে কয়েকদিন নানা প্রকার উৎসব চলিল। অবশেষে গ্রামের লোক শুনিতে পাইল-- নবদ্বীপ হইতে কৃষ্ণনগরের পথে ষাটখানি গোরুর গাড়িতে মতি রায়ের যাত্রার দল আসিতেছে।
মেলার আসরে কয়েকদিন খেমটা, ঢপ, কবি, কীর্তন কিছুই বাদ যায় নাই, কিন্তু যাত্রা আরম্ভ হয় নাই। মতি রায়ের যাত্রার দল আসিয়াছে শুনিয়া চতুর্দিকের পঁচিশখানি গ্রামের লোক যাত্রা শুনিতে মেহেরপুরে ছুটিল।
মতি রায় স্বয়ং আসিয়াছিলেন, তিনি উভয় জমিদার পরিবার-- মল্লিক ও মুখুয্যেবাবুদের কর্তৃপক্ষের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া রাত্রিশেষে আসরে গান আরম্ভ করিলেন। বিষয়-- 'ভীষ্মের শরশয্যা'।
চাটাইয়ের প্রকাণ্ড টাপোরের নীচে যাত্রার আসর হইয়াছিল। টাপোর শুভ্র চন্দ্রাতপ দ্বারা আবৃত, তাহার চতুর্দিকে লাল ঝালর। চাঁদোয়ার নীচে শ্রেণীবদ্ধ লাল, নীল, সবুজ কাচের বেল-লণ্ঠন, প্রত্যেকটির ভিতর এক একটি মোমবাতি। মধ্যে মধ্যে দশ-পনেরোটি ডাল-বিশিষ্ঠ বেলোয়ারি ঝাড়। আসরের বাঁশের খুঁটিগুলি মৃত্তিকা দ্বারা আবৃত--- এক একটি থামের মতো দেখাইতেছিল, সেগুলি লোহিত বস্ত্র ও জগজগা মণ্ডিত। প্রত্যেক স্তম্ভে এক একটি দেওয়ালগিরি সংরক্ষিত। প্রত্যেকটি দেওয়ালগিরির নীচে সে-কালের আর্ট স্টুডিও বা রবি বর্মার অঙ্কিত চিত্রপট। প্রকাণ্ড আসরে ফরাস, বংশদণ্ডের রেলিঙের সম্মুখে শ্রেণীবদ্ধ বেঞ্চ। রেলিঙের পশ্চাতে সারি সারি চাটাই প্রসারিত-- তাহা ভিন্ন গ্রামের 'চাষাভুষো' দর্শকগণেরই অধিকারভুক্ত।
.....................................................
বেলা একটার পর যাত্রা ভাঙিলে ভোঁ ভোঁ দুম দুম শব্দে মধ্যাহ্নের নহবৎ বাজিয়া উঠিল। দর্শকগণ যাত্রার সমালোচনা করিতে করিতে গৃহে ফিরিল। সেদিন হাটবাজার বন্ধ। মেছুনি তরিতরকারি-বিক্রেতা সকলেই যাত্রা শুনিতে আসিয়াছিল। তাহার আর কোনোদিন তো মতি রায়ের যাত্রা শুনিতে পাইবে না, হাট-বাজার তো প্রত্যহই বসিবে।"

সেকালের পল্লীর বাসন্তীমেলা
সেকালের সমাজচিত্র
দীনেন্দ্রকুমার রায়

সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সৌজন্য চক্রবর্তী

মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।