নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

“তুই একটা উল্লুক।” স্কুল যাওয়ার পথে চোখদুটো গোল গোল করে হুলো বললো। শেষ পর্যন্ত তুইও আমাকে গালাগালি দিবি হুলো? “এটা গালাগালি নয়...। উল্লুক একটা রেয়ার স্পিসেস। যেটা আসলে তুই। সংরক্ষণ যোগ্য।” বিজ্ঞের মতো উত্তর দিলো হুলো। আমিও ছাড়বার লোক নই। কেন? সংরক্ষিত হবো কেন? “এইসব মারাত্মক চিন্তা ভাবনার জন্য। বোঝা উচিত আসলেই ক্লাসের ভেতরের পলিটিক্সটা কি। সবুজের নীচে লাল? নাকি লালের ওপরে সবুজ? গোটাটাই তরমুজ? নাকি তরমুজটা আসলেই পাকা পেঁপে। কিংবা কোন একটা শংকর জাতীয় ফল?” হুলো মাঝে মাঝে কি যে বলে কিছুই বোঝা যায় না। হেঁয়ালির মতো কথা বলাও একটা স্বভাব ওর। সেটা একটা আর্টের পর্যায়ে নিয়ে যায়। ওর কাকা বিদেশ থেকে ন্যাশানাল জিওগ্রাফি নামের একটা ম্যাগাজিন আনায়। খুব দাম নাকি তার। সেখান থেকে নানান কিছু পড়ে হুলো। সুন্দর দেখতে সেই ম্যাগাজিনগুলোকে সাজিয়ে রাখে বইয়ের আলমারিতে। হুলোদের বাড়িতে প্রচুর বই আছে। অনেকটা লাইব্রেরীর মতো। হুলো সেইসব বই পড়ার চেষ্টা করে। সারা রাত জেগে ম্যাগনেফাইঙ গ্লাস দিয়ে পিঁপড়ের চলাচল দেখে। টিকটিকির যাতায়াতের রুট খোঁজে। নর্দমার ধেড়ে ইঁদুরগুলোকে রুটি খাওয়ায়। ওরা নাকি হুলোকে পাতালের খবর এনে দেয়। গলিত লাভা কত পরিমাণে টগবগ করে ফুটছে পৃথিবীর অতল গহ্বরে সেসব জানে নাকি ইঁদুরগুলো। এমনকি বর্ষায় এবার কতটা জল জমবে। নদীর জল ঘাট ছাপিয়ে রাস্তায় কার কার বাড়ির সামনে পৌঁছাবে ইঁদুর আর ছুঁচোর চলাচল দেখে বলে দেয় হুলো। পাড়ার তাবড় মাতব্বরেরা তার কথায় কেউ কান না দিলেও আমাদের মতো কেউ কেউ দেয়। তাতে অপকারের থেকে উপকার হয় বেশি। অনেক কঠিন কথা খুব সহজ করে বোঝা যায়। এই পৃথিবী, তার প্রকৃতি, অরণ্যের আদিমতা, নদীর ধারে নিম গাছের ডালে বসে থাকা সেই কবেকার শকুনেরা নাকি চিলেকোঠার ঘরে থাকা হুলোকে নানান কিছু বার্তা পাঠায়। কয়েক হাজার বছর আগে হুলোদের বাড়ির জায়গায় কী ছিল তা নিয়ে অনেক কিছু সংকেতের আনাগোনা হয়। হুলো রাত বিরেত জেগে সেইসব অচেনা সাংকেতিক ভাষা নাকি আয়ত্ত করার চেষ্টা করে। পৃথিবীর বাইরেও প্রানের কোন অস্তিত্ত্ব আছে কিনা তা দেখার জন্য হুলো টর্চ নিয়ে মাঝে মাঝে ছাদের কার্নিশে ঘোরাফেরা করে। আকাশের দিকে তাকিয়ে টর্চ জ্বালায় নেভায়। কত কিছু যে করে! তার  এমন ধরনের পরীক্ষা নীরীক্ষার কথা শুনলে বাড়ির লোক আগে কানে তুলো দেয়। পাড়ার লোক কাজ আছে বলে কেটে পড়ে। কিন্তু আমি খুব গভীর মন সংযোগ দিয়ে শুনি সব। চিলেকোঠায় ওর ল্যাবে গিয়ে দক্ষিণের খোলা জানলা থেকে নদীটাকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়। কুশ ঘাসের ঝোপটাকেও। হাওয়ায় শব্দ ভেসে আসে শোঁ শোঁ। সেগুলো সাংকেতিক ভাষা কিনা আমি বুঝতে পারি না। আমার বিশ্বাস হুলো বড় হয়ে বেশ বিরাট কিছু হবে। সাহেব মেম সব ঘুরঘুর করবে তার চারপাশে। কথায় কথায় সেলাম ঠুকবে। তমালের বাবার মতো গাড়ি নয় প্লেনে করে ঘুরে বেড়াবে সে। কাজেই সে যখন তার নিজের বাড়ির চিলেকোঠায় এইসবের সাধনা করে আমরা তখন ডিসটার্ব করি না তাকে মোটেই। ভবিষ্যত বলে কথা। তাকে লালন করতে হয় খুব যত্নে। একটু এদিক ওদিক হলেই তপস্যা ভঙ্গ হয়ে যাবে। ঊর্বশী নাচতে শুরু করে দেবে শোলের হেলেনের মতো মেহবুবা মেহবুবা গাইতে গাইতে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডর সামনে। সমাজ ভ্রষ্ট হবে। দিক নষ্ট হবে। একটা জাতি উদভ্রান্তের মতো কাঁটাতারের এদিকে আর ওদিকে ছুটোছুটি করে মরবে। সেসব তো হতে দেওয়া যায় না। কাজেই হুলোর এই যে নানারকমের বিচিত্র কর্মকান্ডের তপস্যা তার নিজের বাড়িটাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে। তার থেকে বেশি খুব একটা সে বেরোতে পারে না। একমাত্র স্কুল যাওয়া বা টুকিটাকি কাজ ছাড়া। আমাদের মতো টইটই করে পাড়া বেড়ানোর পার্টি সে নয়। 

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা 
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।