মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন। সম্পাদনা: সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

কেমন ছিল ষাটের দশকে পূর্ববঙ্গের বরিশালে, চাখার কলেজে মেয়েদের প্রথম হোস্টেল? লিখেছেন চাখার কলেজের প্রথম মহিলা ছাত্রী সন্ধ্যা রায় সেনগুপ্ত। সেই লেখার একটু অংশ রইলো -- 
..................................................
সালটা ১৯৬২। সময়টা পুজোর পর। সম্ভবত অক্টোবরের শেষ কিংবা নভেম্বরের শুরু। আমি তখন দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। পুজোর ছুটির আগে পর্যন্ত আমরা, অর্থাৎ আমি ও আমার ছোড়দি অঞ্জলি আমাদের কলেজের কাছে এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে ক্লাস করেছি। কিন্তু তা একেবারেই অনিয়মিত। এই অনিয়মিত ক্লাস আমাদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে খুবই অসুবিধা করছিল। এই অনিয়মিত ক্লাসের কারণ নানাবিধ। কলেজ থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব বারো থেকে চোদ্দ মাইল। আমাদের বাড়ি এবং আমাদের কলেজ গ্রামেই অবস্থিত। যাতায়াত ব্যবস্থা জলপথে নৌকার সাহায্যে, নয়তো পায়ে হেঁটে। হাঁটা পথ মানে হলো ফসলের জমির আলপথ কিংবা নদীপাড়ের পথ। বর্ষাকালে কেবলমাত্র নৌকার সাহায্যেই যাতায়াত করা যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আমাদের বাড়ি ও তদনীস্তন পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার দক্ষিণ অংশে ঝালকাঠি থানার অন্তর্গত রুনসী গ্রামে। আর কলেজটি অবস্থিত বরিশাল জেলার বানারীপাড়া থানার চাখারে। বরিশাল সম্বন্ধে একটা কহাবৎ আছে ধান-নদী-খাল—এই তিন নিয়ে বরিশাল।
আমাদের কলেজে সহশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। সহ-শিক্ষা চালু হয় ১৯৬১ সালে। প্রথম ছাত্রী আমি। আমার সঙ্গেই আমার দিদিও ভর্তি হয়। আর ভর্তি হয় দুজন মুসলিম ছাত্রী আহমেদী সুলতানা এবং পারভিন ফেরদৌসী। আহমেদী চাখারেরই মেয়ে। কিন্তু পারভিনের বাড়ি স্বরূপকাঠি থানায়, যা কলেজ থেকে বেশ দূরে। আহমেদী স্থানীয় মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ক্লাস করা হতো না একা বলে। এভাবেই বাড়িতে পড়ে আমাদের একাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। রেজাল্ট হয়েছিল মোটামুটি।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬২-তে একাদশ শ্রেণীতে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রী আমাদেরই মতো বাড়িতে বসে পড়ে পরীক্ষা দেবে—এমত ভাবনা নিয়ে কলেজে ভর্তি হলো। এই সময় কলেজের অধ্যক্ষ মোহামদম এনায়েত করিম সাহেব ছাত্রীরা যাতে নিয়মিত ক্লাস করে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট হন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তৈরি হয় হিন্দু ছাত্রীদের জন্য হিন্দু হোস্টেল চাখার সংলগ্ন খলিসাকোটায় এবং মুসলিম ছাত্রীদের জন্য মুসলিম হোস্টেল চাখারে। এই হিন্দু হোস্টেলের প্রথম ছাত্রী আমি এবং আমার দিদি অঞ্জলি। ছাত্রদের জন্য হিন্দু হোস্টেল এবং মুসলিম হোস্টেল আগে থেকেই ছিল। যেহেতু সহ-শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, তাই ছাত্রীদের জন্য কোনো হোস্টেলই ছিল না। দ্বাদশ শ্রেণীর একেবারে শেষের দিকে আমরা হোস্টেলে থাকতে শুরু করলাম। হোস্টেলটি একটি সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের পরিত্যক্ত বাড়িতে তৈরি হলো। স্থানীয় লোকেরা এই বাড়িটিকে বলত 'পূর্বের বাড়ি'। সম্ভবত দেশভাগের সময় এই পরিবারের লোকেরা তাঁদের বাড়ি-ঘর কলেজ কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। এ-বিষয়ে এর থেকে বেশি তথ্য আমার জানা নেই। বাড়িটি বেশ বড়ো। বাড়ির পশ্চিম অংশে আমাদের হোস্টেল। সামনে উঁচু পাঁচিল। পাঁচিলের দরজা বেশ প্রশস্ত এবং মজবুত তিনটি তালার অনুশাসনে আবদ্ধ। সম্ভবত মেয়েদের হোস্টেল বলে এরকম ব্যবস্থা। প্রধান দরজা পেরিয়ে একটি বড়ো উঠান। না, উঠান না বলে ফুলের বাগান বলাই সঙ্গত। তারপর লম্বা টানা সিঁড়ি। সিঁড়ি পেরিয়ে একটি লম্বা টানা ঘর। উত্তর দক্ষিণে টানা। ছ-খানা খাট। প্রত্যেকটা খাটের সঙ্গে একটা করে ডেস্ক। আবার খাটের মাথার দিকে দু-সারি রড লাগানো। বুঝতে পারছিলাম এই রডগুলিতে আমাদের জামাকাপড় রাখতে পারব। টানা ঘরটা পেরিয়ে গেলে দরজা দিয়ে ঢুকলে পরে তিনটি বড়ো বড়ো ঘর। প্রত্যেকটি ঘরে চারখানা করে খাট-ডেস্ক ইত্যাদি। খাটের মাথার দিকে তেমনি রড লাগানো। তারপর আবার একটা বারান্দা। বারান্দায় তিনটি দরজা তালা লাগানো। সেই বারান্দা পেরিয়ে আবার একটা বাগান। সবজি বাগান। লাউ, কুমড়ো, বেগুন ইত্যাদি। এই বাগানের পূর্ব উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে তিনজন অধ্যাপক থাকেন সপরিবারে। আমরা আমাদের যে-কোনো প্রয়োজনে তাঁদের কাছে যেতে পারি এ মতোই নির্দেশ ছিল আমাদের। আমাদের হোস্টেল কম্পাউন্ডে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে বেশ খানিকটা জায়গা বাঁধানো। তারই দক্ষিণ পাশে খাবার ঘর এবং সংলগ্ন রান্নাঘর। রান্নাঘরের পূর্বদিকে বেশ খানিকটা জায়গা টিন দিয়ে ঘেরা। বেশ উঁচু করে টিন দেওয়া। ভেতর দিকে ঢুকেই একটা টিউবয়েল। তারপর আরও খানিকটা ঢুকে স্নানের ঘর পায়খানা ইত্যাদি। তবে মেয়েদের হোস্টেল সংলগ্ন পুরো জায়গাটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। অর্থাৎ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার কোনো খামতি নেই। কম্পাউন্ডে ঢুকে যে উঠোনটা ফুলে ফুলে সাজানো থাকত সেই উঠোনের ঠিক ডান দিকে একটা জলাশয়। ঠিক পুকুরও নয় আবার নালাও নয়। বেশ প্রশস্ত এটা লম্বাটে জলাশয়। সেখানে কোনো ঘাট বা এমন কিছু নেই।
হোস্টেল কম্পাউন্ড থেকে বেরিয়ে একটা রাস্তা গিয়ে পশ্চিমে বড়ো রাস্তায় মিশেছে। বড়ো রাস্তাটা উত্তর ও দক্ষিণ দিক বরাবর। দুটো দিকই খলিসাকোটা গ্রামের মধ্যেই। হোস্টেলের রাস্তাটা যেখানে বড়ো রাস্তার সঙ্গে মিশেছে তার পশ্চিমদিকে ছিল দীঘির মতো বড়ো পুকুর। সেই পুকুরের রাস্তা সংলগ্ন কোণের দিকে বেশ খানিকটা অংশ উঁচু টিনের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ভিতরে একটি প্রশস্ত বাঁধানো ঘাট। খাটের সিঁড়ি অনেকটা পুকুরের মধ্যে নেমে গেছে। বেশ ক'জন একসঙ্গে স্থান করা যায়। আমাদের নির্দেশ ছিল একসঙ্গে চার পাঁচজন না হলে আমরা স্নান করতে যেতে পারব না। তাহলে ভিতরে টিউবয়েলের জলে স্নান করতে হবে।
আমরা আবাসিক যারা ছিলাম পুকুরে স্নান করতেই অভ্যস্ত এবং স্বচ্ছন্দ ছিলাম। আমরা তো সবাই গ্রামে বড়ো হয়েছি, আমাদের অভ্যাসগুলোও তেমনি গ্রামীণ পরিবেশেই স্বাভাবিক থাকত।
হোস্টেলের রাস্তাঘাট দুপাশে বড়ো বড়ো গাছ। বকুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া প্রভৃতি। গ্রীষ্মকালে বকুল ফুলের আস্তরণে রাস্তাটা ঢাকা থাকত। আর বসন্তকালে কৃষ্ণচূড়া যেন পুরো এলাকাটা রাঙিয়ে দিত।

আবাসিক জীবনের দুই পর্ব
(চাখার ও ঢাকা)
..................................
সন্ধ্যা রায় সেনগুপ্ত

মেস হোস্টেল ঘটিত এ বাঙালি জীবন
সম্পাদনা: সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বিতীয় সংস্করণ
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ৫৯০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।