সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

📖📖📖📖📖📖📖📖📖
"হোটেলের বাইরে পা দিতেই কালীগঙ্গার সেই আলোকস্তম্ভ চোখে পড়ে। ফকির বলেন-- মোগো কচার চক্ষু। চারদিকেই এখন অন্ধকার। শুধু তার মাঝখানে ওই আলোকস্তম্ভটি ঘুরে ঘুরে নদীর উপর তার রোশনি ফেলে যাচ্ছে। আকাশেও এখন নক্ষত্র। পূর্বে সামান্য আভা, পথ জনহীন। যেখানে সারা দিনমান হাজার লোকেরা কলোচ্ছ্বাস, সেখানে এই নির্জনতা বড়ো বিষণ্ণতা আনে।..
ঘাটে এসে সবাই জেটির উপর বসি। সামনে কালীগঙ্গা। পূর্বমুখী আমরা, ডাইনে দূরে আলোকস্তম্ভ, বাঁয়ে নদীর আঁতুরঘরের রাস্তা ঘন অন্ধকারে সম্পূর্ণই দৃষ্টির আড়াল, অথচ তার অস্তিত্বের ঘোষণা, আমাদের সামনে সামান্য উজ্জ্বল আলোয় দ্রুত ধাবমান কচুরিপানার অনন্ত মিছিলে সম্যক প্রতিভাত। আবার আলোকস্তম্ভের পর থেকে নদীর গতিপথ সেই একই দুর্ভেদ্য অজ্ঞেয় অন্ধকারে ঢাকা। আমরা শুধুমাত্র সামনের সামান্য উজ্জ্বল অংশের মিছিলটুকু দেখি, বাকিটা অনুভবে বুঝতে চাই। যেটুকু দেখি সেইটুকুই অনুভব-- সেটুকুই কার্যকারণের সূত্র এবং যুক্তি সিদ্ধান্তের একমাত্র উপকরণ। সেখানে যাঁরা অনুভবের গ্রাহক তাঁরা তাঁদের তত্ত্ব গড়েন এবং তা গানে, কথায়, ভাবের আদান-প্রদানে বিশ্বাসের জগতে স্থাপন করেন। আর যাঁরা যুক্তি, তর্ক এবং কার্যকারণে তাকে ধরতে চান, তাঁরা নেতি নেতি বলে হুতাশ করেন। এখন এই নদীর বিশাল বিস্তারকে অনুভবে ধরব, কী কার্যকারণে-- বুঝি না। বস্তুত এখন এই প্রদোষ সময়ে, যখন সমগ্র চরাচর সুপ্ত, কোনো কোলাহল নেই, কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, তখন যেন অনুভবই তীব্র হয়ে ওঠে। মন বিচার করতে চায় না, বিশ্বাস করতে চায়। সে বিশ্বাস কীসের ওপর বিশ্বাস, জানি না, তবে তা যুক্তি বা ন্যায়সূত্রের জটিলতায় না গিয়ে সাধারণের, সহজ বিশ্বাসের সরল পথেই যেন বেশি সাবলীল। তখন এই ফকিরদেরই মতো বলতে সাধ হয়--
মানুষরতন, কর তারে যতন-- যাহা তোমার প্রাণে চায়।

📖📖📖📖📖
কচুরিপানা এক আশ্চর্য উদ্ভিদ। অমর, শেষ নেই তার। ভেসে যাওয়া অনন্ত কচুরিপানার স্তূপে এই আলো-আঁধারিতে যেন ভেসে যায় অনন্ত মুখ। সে মুখ মানুষ-মানুষীর। তার মধ্যে যেমন বকুলের মুখ দেখি, তেমনি তার ধর্ষকের মুখ। যেমন সশস্ত্রের মুখ, তেমনি নিরস্ত্রের, সেই স্রোতে ভাসমান। আমাদের চারিদিকের অন্ধকার পরিমণ্ডল ক্রমশ আলোয় উদ্ভাস পেতে থাকে। সেই আলো-আঁধারিতে নিজেদেরকেও একসময় যেন ভেসে যাওয়া কচুরিপানা বলে বোধ হয়। একসময় আমাদের সেই মৌন প্রেক্ষণের নিথরতা ভঙ্গ হয়। তখন সূর্য উঠতে থাকে। কচার পূর্বদিগন্ত লাল। দোতরাং-এ ফকির বাঙ্ময় হন--

বেরাম বেড়ে অগাধ পানি
তার নাই কিনারা তরণী পারে..."

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
মিহির সেনগুপ্ত

চিত্র-ঋণঃ সুমনা চৌধুরী

মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।