সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত
"বেরাম বেড়ে অগাধ পানি, তার নাই কিনারা তরণী পারে।" ফকিরের গানটি এখন চলমান ট্রলারে আমার মাথার মধ্যে যেন আরও বেশি সুরেলা এবং অর্থবহ মনে হচ্ছে। ফকির আরও গেয়েছিলেনঃ "নোনা জলে ভাসাইলি রে তোর সোনার বজরাখান।/ এ তরী জীর্ণ হবে কে সামলাবে, ডাকবে যদিন হড়পা বান।" এখন যে নদী দিয়ে আমার সোনার বজরাখানা ভেসে চলেছে, অনেক রক্ত, অশ্রু, ঘামে তার জল তো নোনা বটেই।
হুলারহাট পেরিয়ে এসেছি। ডডডড আওয়াজ করে আমার সাধের বজরাখানা চলেছে। সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের শেষ ঘাটের দিকে। ট্রলারকে বজরা বলায় দোষ নেই। শব্দটির মধ্যে যতই বাঙালি বাবুয়ানির উনিশ শতকীয় নস্টালজিয়া থাকুক, তার ঔরসদাতা ইংরেজি বার্জ শব্দটি। কিন্তু হায়, বাংলাদেশে কি এখন আর একটিও বজরা আছে? তা সে যাকগে, যার নাম বজরা, সে-ই মোটরযুক্ত হলে বার্জ হয়। নামে কী আসে যায়। তা সোনার বজরা আমার এখন নোনাজল কেটে পাড়ি দিচ্ছে কচানদীর বুক চিরে। নামে কী আসে যায়। কাল শরৎ, সময় ঊষা। কচার দু পাশের দৃশ্য এবং সামনে নদী, আকাশ আর হালকা কুয়াশার আস্তরণ মাখামাখি দেখে কাব্যি করে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার মধ্যে দেখো, আবার বালার্ক বিচ্ছুরণের বর্ণালী। ঋক মন্ত্রের কবিরা হলে দিব্য বর্ণনা দিতেন--- শারদী ঊষা, প্রভাতের অরুণ কিরণে ভীতাত্রস্তা কুরবীর ন্যায় অপসৃয়মাণা। বৈদিক ভাষার গাম্ভীর্যে তা নিশ্চয় আরও কাব্যময় শোনাত। কচার দুপাশে বিস্তৃতি হেতু, নিকট নয়, তথাচ দৃশ্যমান বৃক্ষেরা আবাল্য পরিচিত, তাই ভালোবাসার সামগ্রী। অসম্ভব সব স্বপ্ন তাদের পাতায় মাখানো রয়েছে। শিশিরের সাথে তা টুপটুপ করে খসে পড়ছে। সেইসব গাছেরা ফিসফিস করে এখন আমাকে ডেকে বলছে--- কেডা যাও? নাওহান লাগাও মোর শেহড়ে। দু দণ্ড জিরাইয়া যাও। নদী এইসব স্বপ্নসম্ভব কথা পৌঁছে দেয় আমার কানে।
এইসব দৃশ্য দেখে, গন্ধ মেখেই তো আমরা ডাঙরটি হয়েছি। আর এই বিশাল বিস্তার শস্যক্ষেতের প্রান্ত আকাশের সাথে নির্লজ্জ ঢলাঢলিতে মেলামেশা করে বলে না আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা তা নিয়ে আদিরস কাব্যি করেন।
ভুলা অর্থাৎ কাশঝাড়ে, বা হোগলা, পাইত্রার ঝোপে যখন বাতাস আউলঝাউল করে--- তখন আমাদের আউল, বাউল, দরবেশে ফকিরেরা গান বান্ধেন ধোঁয়াটে ভাষায়, যাতে অ্যাও হয়, অও হয়। শুইন্যা লহেন, শুইন্যা লয়েন, মোর দেহান্তের পর এইসব আর ক্যাও শুনাইবে না।
--- আয় আহা আহা আহারে
নিদয়া যৈবন বিদি ক্যানো দিলা আমারে
(আহা) নিষ্করুণ ভাদ্দর আশ্বিন মাস বড় ভারী
খালের ধারে নদীর চরে মেনউয়া মাছের সারি।
আহা মেনউয়া মাছের সারি।
মেনী চায় মেনউয়ার দিকে মেনীর পরাণ কান্দে।
তাই না দেইখ্যা মেনউয়া দ্যাহ গভীর গত্তে হান্দে।
আহারে নিদয়া বিদি পরাণ জ্বলাইয়া যায়
হদের মইদ্যে মেনউয়া খালি ফাক্কুৎ চায়।
হোগলা বনে হুলাহুলি করে পুরাল বাও
পিরিত করবা যদি মেনউয়া হদের বাইরে আও।
পুবালিয়া বাও জানে হোগলা ভুলার রীত।
তুমি ক্যান জান না মেনউয়া মেনীর পিরিত।
আয় আহা আহা আহারে।
এখন এইসব পদবন্ধ বা শব্দের যদি টীকা দিতে হয়, তবে তা বড় পণ্ডিতি কাঁটায় কন্টকিত হবে। আমি পণ্ডিত নই। আমি একন কালীগঙ্গায় ভাসমান এক কাষ্ঠবাঙাল, যে বহুকাল কলকাতায় প্রবাসী থেকে, কপালজোরে আপন সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের পথে। দ্যাশের পথ য্যারে কয়। আবার আমার এ দ্যাশ, যে সে দ্যাশ নয়। এ্যার নাম বরিশাল, বাকেরগঞ্জ, বাকলা, চন্দ্রদ্বীপ।
সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম
মিহির সেনগুপ্ত
প্রচ্ছদ: তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য: ৪৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment