নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল বেমক্কা। যুদ্ধটা হয়েছিল পুঁজিপতিদের সাথে শ্রমজীবিদের। কৃষকদের। মজুরদের। না খেতে পাওয়া, কাজ হারানো, ঘর ছাড়া মানুষদের। হাতুড়ি ও কাস্তের ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়েছিল প্রাচীন অচলায়তন। “হেঁইয়ো হো...হেঁইয়ো হো...ঝড় ভাঙা ঘর কত বলিষ্ঠ বাহু ওঠাবে”। কাতারে কাতারে মানুষ চলেছিল রাস্তা দিয়ে। তাদের চোখে দিন বদলের স্বপ্ন। কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, দুবেলা দুমুঠো খেতে পাওয়ার অধিকার নিয়ে তারা রাস্তায় হাঁটছিল। এইসব সাদা-কালো ছবির চলমান দৃশ্যমালা সরে যাচ্ছিল দেওয়ালের ওপর থেকে। দিনের বেলা বন্ধ ঘরের মধ্যেটা কেমন যেন ভ্যাপসা হয়ে উঠছিল গরমে। ফিল্মের প্রজেক্টারের আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছিল হলঘরের মধ্যে কালো কালো মানুষের মাথা। কেউ কেউ তার মধ্যে খুক খুক করে কাশছিল। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছিল কারও কারও নাক ডাকার শব্দও। বাকিরা সবাই প্রায় তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল সাদা দেওয়ালে। চলমান ছবির দিকে। প্রজেক্টারের ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল মন্টু। কিরকির শব্দ করে মেশিনের ওপরের গোল চাকতিটা থেকে ফিল্মের লম্বা স্ট্রিপ নীচের গোল চাকতিটায় গুটিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক যেমন লাটিমে সুতো গোটায় তেমন। এর আগে এতো কাছ থেকে মন্টু ফিল্মের প্রজেক্টার দেখেনি। সিনেমা হলের অন্ধকারে বসলে তার চোখ চলে যেত বারবার পেছনের দেওয়ালটায়। ওখানে ছোট ছোট ঘুলঘুলির মতো জায়গা থেকে আলো পড়তো শাদা পর্দায়। সেই আলো কি করে এমন অদ্ভুত ক্যারিশমা তৈরী করতো মন্টু ভেবে পেতো না। আলোর যে এক রহস্যময় মায়া মুগ্ধতা আছে সে তখন থেকে বুঝতে পারে। বিজ্ঞান স্যার চন্ডী বাবুর কথা সে অবিশ্বাস করেনি। সিনেমা আসলেই নাকি চোখের ভুল। মিথ্যে। পর্দায় কোন কিছুই নড়ে না। চোখের সামনে থেকে সরে যায় শুধু স্থির চিত্রের সারি। যা হয় সবটাই আমাদের মাথায়। “ব্রেনটা একটা জটিল যন্ত্র বুঝলি কিনা। কখনও মিথ্যেটাকে সত্যি করে দেখায়। সত্যিটা মিথ্যে। এক অদ্ভুত ইলিউশান তৈরী করে”। মিথ্যেকে সত্যি দেখানো ব্রেনটাকে নিয়ে তাই মন্টু ভাবতে চায় না মোটেই। ইচ্ছে করে না তার। ততক্ষণে জীবনে প্রথম দেখা ফিল্মের প্রজেক্টারে জড়িয়ে গেছে মনটা। তার গোল চাকতিটার মতোই যেন ধীরে ধীরে ঘুরে চলেছে চিন্তা ভাবনা। আর সেই ঘূর্ণায়মান আলোর রাশির মধ্যে দিয়ে শাদা দেওয়ালের গায়ে ঝিরঝিরে বরফ বৃষ্টিতে ততক্ষণে সবে উঠে দাঁড়িয়েছেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। সামনের সমবেত জনগণের দিকে তাঁর দৃষ্টি। একটা বক্তৃতা শুরুর আশ্চর্য মুহূর্ত। প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ। সূচিত হবে শ্রেনীহীন শোষণহীন সমাজ। সবার পাতে জুটবে খাবার। পরনে থাকবে বস্ত্র। মাথার ওপরে থাকবে আচ্ছাদন। থাকবে শিক্ষা ও কাজের অধিকার। গুরু গম্ভীর ভাষ্য ও গণ সঙ্গীতের কোরাসে চারিদিকের মহল যখন গমগম করছে। দর্শকদের পলক পর্যন্ত পড়ছে না। নাক ডাকছিল যে সেও উঠে বসেছে চোখ বড় বড় করে। হুপেন কাশির মতো কাশছিল যে সেও মুখে রুমাল গুঁজেছে। এমন এক মহান গুরুগম্ভীর পরিবেশে সূচীভেদ্য অন্ধকারের মাঝে হল ঘরের দরজাটা একটু ফাঁক হলো। ঘরের মধ্যে আলো ঢুকলো এক পশলা। যারা এতক্ষণ তন্ময় হয়ে দেওয়ালের ওপরে পড়া আলোর কারসাজিতে ছবি দেখছিল তারা বিরক্ত হয়ে ঘুরে তাকালো। কিন্তু চোখ ধাঁধানো আলোয় তেমন ভাবে দেখতে পেলো না কিছুই। দরজার সামনে একটা স্যিলুট অবয়ব ছাড়া। বিশু দরজাটুকু ফাঁক করে ঘরের ওই অন্ধকারে কাউকে ঠাহর করতে না পেরেই হাঁকলো “মন্টু...।” দুটো চাকতিতে গোটানো রিলটা হঠাৎই মাঝপথে ছিঁড়ে গেল। প্রজেক্টারের ল্যাম্পের আলোর সামনে ছিঁড়ে যাওয়া ফিল্মের স্ট্রিপে কেমন যেন ঝুলে রইলেন আধপোড়া হয়ে লেলিন। দেওয়ালে সেই ছবিটা সিপিয়া টোন হয়ে ঢেউয়ের মতো ভাসতে থাকলো। সমবেত জনতার দিকে তর্জনী তুলে বলতে চাইছেন তিনি কিছু। হুটহাট করে দরজা জানলা খুললে ফিকে হয়ে যেতে থাকলো দেওয়ালের ছবিটা। ফিকে হয়ে যেতে থাকলেন কমরেড লেনিন। 

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।