বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

শুনেছি কোনো একটা বাড়িতে থাকতে থাকতে সেই বাড়িটার মতো হয়ে যায় মানুষগুলো। নাকি বাড়িটা হয়ে যায় মানুষ? তার জানলা, দরজা, কড়িবর্গা, উঠোন, চৌবাচ্চা, জলের কল, লাইটের সুইচ সব যেন শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। বসত করলে মায়া বাড়ে। ছেড়ে গেলে কান্না পায়। এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছে আমার। এই বাড়িতে জন্মেছে দাদা। বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছে এই বাড়িতে। ঠাম্মা, মণি, বড়মা, হাঁদা এই বাড়িতেই এক সময়ে কতদিন আগে ওপার থেকে এসে উঠেছিল প্রথমে। শুরু করেছিল আবার নতুন করে সব কিছু। যাদের চারিদিকে ছিল সবজেটে রঙের গ্রাম্য জীবন তারাই দু কামরার স্যাঁৎসেঁতে ঘরে পিলসুজের ওপর প্রদীপ রাখলো। হারানো ছড়ানো দুঃখ গুলোকে জমাট করে রাখলো মনের মাঝে। কাউকে কোনোদিন বোঝার অবকাশ দিল না। ছায়া ছায়া হয়ে একদিন সবাই আবার সরেও গেল যে যার মতো করে। ফাঁকা হয়ে যেতে থাকলো আমাদের চারপাশটা। একদম একলা হয়ে যাওয়ার মতোই। সেই কবেকার একলা হয়ে যাওয়া একটা সংসারকে জড়ো করছি আমরা। ট্রাঙ্কে গোছাচ্ছি। বস্তায় পুরছি। ঝুড়িতে ভরছি। হারিয়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে আমার জন্মস্থান। আমার পুরোনো পাড়া। আমার গায়ে এক তলার বাসার স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ।তখনও আমার জন বার্জার পড়া হয়নি। আমাদের দেখার রকমফেরগুলো অন্যরকম ছিল। গান গেয়ে যারা ছাদ পিটোতো, আর পঞ্চমীর চাঁদ যখন সহজপাঠের ভেতর দিয়ে বাঁশ বাগানে উঠতো তখন আমাদের বর্ণপরিচয়ের সবে শুরু। চন্দননগরের পুজোর লাইট ছিল আমাদের কাছে তখন রাশিয়ার প্রান্তরে লাল ফৌজের যুদ্ধে বরফ পড়ার ভ্রম। বছরে একবার পয়লা বোশেখের বাজার করতে বেরিয়ে কারেন্ট অফের গলে যাওয়া আইসক্রিম ছিল স্বর্গ দেখার মতো পুণ্য অর্জনের ফল। সিদ্ধার্থ ঘোষ তখনও ‘বাঙালির ফটোগ্রাফি চর্চা’ লেখেননি। বোর্ন এ্যান্ড শেফার্ডের ফটোগ্রাফির লাইব্রেরি সমস্ত ইতিহাস বিলোপ করে পুড়ে যায়নি তখনও। অতীত তাকিয়ে ছিল বর্তমানের দিকে। আর বর্তমান তাকিয়ে ছিল ভবিষ্যতে। কিন্তু ভবিষ্যৎ মনে হয় তখন আর কারও দিকে তাকানোর অবকাশ পায়নি। তার তাড়া ছিল বড্ড।

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ-পরিকল্পনাঃ মেখলা ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ-রূপায়ণঃ শোভন সরকার

মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।