নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি। কল্লোল লাহিড়ী

গল্পের যেমন একটা ধরাবাঁধা সূত্রপাত থাকে, লোমহর্ষক থাকে বিচিত্র বুনন, একের পর এক ঘটনার পরম্পরায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়; আমার জীবনে তেমন কোনকিছুই ছিল না কোনদিন। কেন ছিল না সেটা নিজেও জানি না। জানলে আশেপাশের অনেক কিছুকেই হয়তো ঠিকমতো আমল দিতে পারতাম। গুছিয়ে নিতে পারতাম একটা না দেখা অচেনা পথকে। কিন্তু সেটা হলো না। একটা অস্থিরতা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালো। যে অস্থিরতায় অধ্যাপক পি আচার্যের বাংলা মানে বইটা আর পড়তে ইচ্ছে করলো না। সম্পাদ্য, উপপাদ্যগুলো পড়ে থাকলো নিজের মতো করে। জীবন বিজ্ঞানের বইতে ধুলো জমা হলো। পাঁচিলের ওপর এক শালিক দেখে মন খারাপ হয়ে রইলো সারাটা দিন। ইচ্ছে হল না বেরিয়ে দু-শালিক খোঁজার। ডেবোনিয়ার থেকে পামেলা বর্দে উঁকি দিলেও শরীর জানান দিল না। সামনের বছর মাধ্যমিক। তার একটা প্রেশার আছে। সারাক্ষণ বাড়িতে পড় পড় শুনতে শুনতে কানের পোকা বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে গালে হয়েছে গুচ্ছের ব্রণ। একটু খুঁটলেই বড় হয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। নাকের পাশ দিয়ে দু-গাল বরাবর যেন মনে হচ্ছে স্তুপ আর ভঙ্গিল পর্বতের সারি। দিপালী কোচিং-এ যাওয়ার আগে জানলার সামনে এসে ডাকে, “কিংশুক...”। আমি যেন মুখ ধুচছি এমন ভান করে গামছা দিয়ে মুখ আড়াল করে দাঁড়াই। তুই যা আমি আসছি। সে মেয়েকি শোনার? কিছুতেই যায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আমার জন্য। তার প্রেমের গল্প, গার্লস স্কুলের গুচ্ছের খবর আমাকে জানানো চাই। না হলে পেটের ভাত হজম হবে না তার। এরই মধ্যে ওই সাত সকালে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কয়েকটা বে-পাড়ার ছেলে এসে চক্কর কেটে যাবে। আড়ে আড়ে দেখবে আমাদের। বিশেষ করে দিপালীকে। কেউ কেউ গান গাইবে “ঘায়েল তু নে মুঝে কর দিয়া”। সাইকেলটা বাইকের মতো চালানোর চেষ্টা করবে। কারো বাড়ির বাগান থেকে গোলাপ চুরী করে রাস্তার ওপর রেখে যাবে। লাল কালিতে চিঠি লিখে বলবে “রক্তে দিলাম প্রেম”। মাছির মতো চারপাশে ভনভন করবে ছেলের দল। তবু এদের কাউকে পছন্দ হবে না দীপালীর। তখন সে তমালের গল্প করতে ব্যস্ত। তমাল আমাদের পাড়াতে নতুন। বছর তিনেক হল এক পেল্লাই সাইজের বাড়ি করে তার বাবা চলে এসেছেন এখানে। আগে তমাল পাড়ার কারও সাথে মিশতো না। ক্লাস টেনে উঠে দুটো ডানা গজিয়েছে তার। আমাদের সাথেই পড়ে। কিন্তু ইংলিশ মিডিয়াম। ধপধপে গায়ের রঙের তমালের আবার কার্তিক ঠাকুরের মতো একটা গোঁফ। সেই গোঁফের তরিজুতে অনেক সময় ব্যয় করে সে দেখলেই বোঝা যায়। ঠোঁটের নীচে ছোট্ট একটা কালো তিল। দিপালীর তাকে খুব পছন্দ। রচনা লেখার সময় কখন তমাল তার হাতের ওপর হাত রেখেছিল। কবে বাড়ি ফেরার পথে চোখ মেরেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে খেলেছিল তার আঙুলগুলো সেসব সে সবিস্তারে আমাকে বলে। এমনকি গতকাল রাতে তমালকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছে সেটাও। রাগে আমার গা জ্বলে। কিন্তু কিছুতেই ওকে বোঝানো যায় না শুধু সে নয় মণিবাবুর কোচিং এর সব মেয়েরাই তমালের পাশে বসার জন্য কম্পিটিশান করে। স্কুলের গেটের সামনে স্টাইল মার্কা সাইকেল নিয়ে দাঁড়ালে গার্লস স্কুলের মেয়েরা ঘুরে ঘুরে তাকায়। এমনকি ওর বাড়ির দোতলার বারান্দায় জাঙ্গিয়া মেলা থাকলেও ঝাড়ি করে। আর ছেলেটাও তেমন। সিলেবাসে মিল নেই। বইয়েও না। তাও কেন একগাদা বাংলা মিডিয়ামের সাথে তোর বসা? আলাদা পড় না। ও যাবে না। এখানে তো ছিপ ফেলতে এসেছে। ভালো নয় কিন্তু। আগে থেকে বলে দিলাম। বেজায় ঠকবি। চোখ বড় বড় করে যত বলি, সাবধান করি, দিপালীর সেইসব কথা কানে ঢোকে না। “ভালোবাসায় ঠকলে শেষ পর্যন্ত কেয়ামত সে কেয়ামত তক তো আছেই”। কেমন উদাস ঘোর লাগা গলায় বলে যায় দীপালী। হন হন করে হাঁটে। তারমধ্যে মণিবাবুর কাছে বাংলা পড়ার টান যতটা না থাকে তার চেয়েও বেশি থাকে তমালের সাইকেল। হ্যাঁ এই মাত্র নজরে পড়েছে তার। মণিবাবুর বাড়ির দেওয়ালে ঠেসান দেওয়া আছে সেই পক্ষীরাজ। তার মানে এসে পড়েছে ছেলেটা। যতক্ষণ না তার পাশে গিয়ে বসবে মেয়েটা ততক্ষণ শান্তি নেই। ওর গায়ের গন্ধ ভালো লাগে দীপালীর। হাতের ওপর হাত। পায়ের আঙুল দিয়ে খেলা। 

নাইনটিন নাইনটি আ লাভ স্টোরি
কল্লোল লাহিড়ী

প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: মেখলা ভট্টাচার্য
মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা
#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।