নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা। শতঞ্জীব রাহা

"বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নদীয়া জেলায় নাট্যচর্চার প্রসার নিঃসন্দেহে মঞ্চের গণতন্ত্রীকরণের অভিজ্ঞান। যদিও এই শতাব্দীর প্রথম কয়েকটি দশকে ধনীগৃহের অঙ্গনে মঞ্চ বেঁধে নাট্যাভিনয় হতো, তথাপি একে বাবু থিয়েটার বলা যায় না। যুবকদের অভিনয়ে ধনীদের পৃষ্ঠপোষণা ও অর্থসাহায্যও ছিল (যেমনঃ রানাঘাটের পালচৌধুরী, মেহেরপুরে জমিদার মুখোপাধ্যায়রা, মেহেরপুরের মল্লিকরা, চাকদহ-তাতলার অমূল্য ও কালীপদ ঘোষালরা, চাকদহ-গোরাপাড়ার লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, চাকদহ যশড়ার মিত্র পরিবার, কৃষ্ণনগরের রায়বাড়ি বা দাক্ষী পরিবার, চাকদহ কেউটিয়ার জমিদার সতীশচন্দ্র নন্দী প্রমুখ। জমিদার ছাড়াও ছিল শান্তিপুরের বনেদী পরিবারগুলির অর্থ ও পৃষ্ঠপোষণা, চাকদহের ব্যবসায়ী নৈমুদ্দিন চৌধুরী বা ফকির মহম্মদের অর্থসাহায্য ইত্যাদি)। তবু এ ছিল শখের থিয়েটার, সেকালের ভাষায় অ্যামেচার। ক্রমেই শখের থিয়েটার বড়বাড়ির অঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে মন্দিরতলায়, বারোয়ারি প্রাঙ্গণে, স্কুল কিংবা ক্লাবের মাঠে। ক্রমেই সাধারণজন এক অর্থে বঙ্গরঙ্গমঞ্চের গণতন্ত্রীকরণের শরিক হয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন অভিনেতা ও কলাকুশলীদের। দর্শকদের পক্ষ থেকে কলাকুশলীদের পুরস্কৃত করার রেওয়াজ ছিল( যেমনঃ রামপদ মুখোপাধ্যায় শান্তিপুরে পাণ্ডবগৌরব নাটকে অভিনয় করে রৌপ্যপদক, শান্তিপুেরর ঘনশ্যাম ঘোষ কৃষ্ণনগ গোলাপট্টিতে বিজয়বসন্ত নাটকে এবং বীরনগরে কালীচক্র নাটকে অভিনয় করে আংটি পুরস্কার পান। প্রকাশ্যে এরকম সম্মান নাট্যকর্মীদের উৎসাহ বিবর্ধনে সহায়ক হয়েছিল।
তৎকালে নাট্যচর্চায় সামিল হয়েছিলেন নানান পেশা ও বৃত্তিজীবী মানুষ। তথাকথিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক বা বিত্তশালী অভিজাতদের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণনগরের ধীবর কিংবা শান্তিপুরের তন্তুবায়দের মতো শ্রমজীবী মানুষ কর্মক্লান্ত দিনের শ্রান্তি অপনোদনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন যাত্রা ও নাটককেই। সন্ধ্যার পর থেকেই এঁরা মহড়ার জন্য সমবেত হতেন-- উচ্চকণ্ঠের মহলা ও আবহবাদ্যের ধ্বনি সন্ধ্যা ও রাত্রির নৈঃশব্দ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ত সমগ্র পল্লীর বুকে।
জেলার নাট্যচর্চার প্রধান সমস্যা ছিল স্থায়ী মঞ্চের। এই সময়কালের মধ্যেই কৃষ্ণনগর টাউন হল তৈরী হয়ে গেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকুই বা ছিল ! মঞ্চ বেঁধে অভিনয় করতে গিয়ে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়ে যেত মঞ্চনির্মাণেই। কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ের অনুসরণে মায়াত্মক বা বাস্তবাত্মক মঞ্চসজ্জাই প্রচলিত ছিল। ফলে জেলার দলগুলি প্রযুক্তি প্রয়োগের সমস্যায় ভুগত। যেমনঃ সেকালে না ছিল মাইক, না ছিল পর্যাপ্ত আলো। দর্শকের দিকে পেছন ফিরে সংলাপ উচ্চারণ করা যেত না। কণ্ঠ ছিল অভিনেতার সম্পদ। স্বরের ক্ষমতার ওপর চরিত্র পাওয়া বহুলাংশে নির্ভর করত। স্বর প্রক্ষেপণের কৌশল জানা ছিল তখনকার অভিনেতাদের।
আলোর ব্যবস্থার সিংহভাগ জুড়ে ছিল কেরোসিন ল্যাম্প বা হ্যাচাকের আলো, তার সঙ্গে ডেলাইট, বড়জোর কার্বাইড গ্যাসের ফুটল্যাম্প। এসবের অভাবে আড়াইসেরি তেলধরা রেড়ির তেলের মাটির প্রদীপ। এটুকু আলোর ব্যবস্থা যাঁরা করতে পারতেন না, তাঁরা দিনের আলোতেই অভিনয় করতেন। এরই মধ্যে কেউ কেউ কেরোসিনের টিন কেটে গ্যাসের বাতি দিয়ে সৃজনশীল আলোকসম্পাত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন(যেমন কৃষ্ণনগরের অভিনেতা ও নাট্যকার তারাপদ রায়)।

মফস্বলের অন্যত্র যেমন, নদীয়াতেই তেমনই বিরাট অভাব ছিল অভিনেত্রীর। অর্থাৎ স্ত্রীচরিত্রে মহিলার অভিনয়। এ শতকের চারের দশক পর্যন্ত নারীচরিত্রে পুরুষেরা ছিলেন নিরঙ্কুশ। বহু অভিনেতার স্ত্রীচরিত্রে অভিনয় করে দারুন নাম করেছিলেন। সামাজিক বাধা, লোকনিন্দার ভয়ে খুব বেশি হলে 'হায়ার করা' মহিলাদের মধ্যেই অভিনয় ব্যাপারটি সীমাবদ্ধ ছিল। শান্তিপুরে আঙুরবালার অভিনয়ের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। শোনা যায়ঃ আঙুরবালা বিবাহসূত্রে ছিলেন শান্তিপুরে দ্বিজকুমার ভট্টের পত্নী। অভিনয়-জীবন বেছে নেওয়ায় স্বামীর ঘর-করা তাঁর হয়ে ওঠেনি। একবার শ্যামকিশোর ভট্টাচার্যের বাড়িতে অভিনয় করতে এলে আঙুরবালাকে জানানো হয় যে, কয়েকদিন পূর্বে তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। সেদিন তিনি আর অভিনয় না করে বৈধব্য গ্রহণ করেন।
অবশ্য আমাদের আলোচ্য সময়কালের শেষদিকে জেলায় মেয়েদের নিয়েই নাট্য বা যাত্রাদল তৈরী হয় অথবা শুধু বাড়ির বা পাড়ার মেয়েরাই নাট্যাভিনয় করেন-- অন্যদিকে পুরুষের সঙ্গে যৌথ অভিনয়েও অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত হতে থাকে।"

'নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা' থেকে।

নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা
শতঞ্জীব রাহা

প্রচ্ছদ: তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য: ৩৫০ টাকা

#সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা ১।। সম্পাদনা : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।।

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

সময় ভ্রমণ।। সৌমিত্র ঘোষ।।