Posts

Showing posts from June, 2022

টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি। মিহির সেনগুপ্ত

Image
সবাই বলে বেলমি পাহাড়ির ঝোরা। তিরতির করে জল বইছে। পাথরের এ খাঁজে ঢুকে ও-খাঁজ থেকে চুঁইয়ে বেরিয়ে সে এক দৃশ্য বটে। আশপাশের জমিন ঢেউ খেলানো টাঁড়। সেই ঢেউ-এর শেষ সীমানা ঝাঁটি জঙ্গল নিয়ে পরেশনাথ পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছোয় ধাপে ধাপে-- সে এক অসামান্য ভূচিত্র, যেন গাঢ় সবুজের ঢেউ। ঐ জমিগুলি চেঁছে ছুলে শত্রুঘনেরা বা অনুরূপ মানুষেরা আবাদ করেছে। সেখানে পাহাড়ের গা বেয়ে বৃষ্টির যে ধারা নামে, তাকে আল বন্দি করে ধানের চাষ হয়।  এই বেলামু টাঁড় গাঁওটি একটি 'ফরেস গাঁও' বটে। এখানে চারদিকেই জঙ্গল আর পাথর। পাথর, পাহাড়, টিলা আর মালভূমির কাঁকড়ওলা উঁচু জমি। এর আশেপাশের ব্যাপ্তিতে আছে 'ফরেস'। শাল শার্জম। শত্রুঘন এবং তাঁর গোষ্ঠীর মানুষদের বড়ো প্রিয় এই মহীরুহ। আকাশছোঁয়া মাথা নিয়ে ছিল তাদের ঘন বসতি। কোম্পানির আমল থেকেই এই মহীরুহদের প্রতি দৃষ্টি পড়ে সাগরপাড়ের কুৎসিত লোভীদের। ফলত শাল, পিয়াল, শিমুল, কেঁদ-এর একদা গহন অরণ্য আজ আর নেই। পাহাড়-টিলার অন্দর-কন্দরের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে স্বাধীন জীবন পাওয়ার জন্য হাহাকার।  টাঁড় পাহাড়ের পদাবলি মিহির সেনগুপ্ত প্রচ্ছদঃ শুভশ্রী দাস অলংকরণঃ পার্থপ্রতিম

ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার

Image
"আব্বাহুজুর বরাবরই আমার দুরের মানুষ। আম্মিজানের কথা ভাবলে একটা দৃশ্যই চোখের সামনে ভেসে ওঠে—তিনি মাথায় পশমি কাম্বাদার পরিয়ে আমাকে শীতের রোদ্দুরে ছেড়ে দিচ্ছেন। জায়গাটা কোথায় মনে নেই। এরপর তো বিদ্রোহী শাহজাদা খুররমের সঙ্গে তিনিই ফেরার হলেন। সঙ্গে আর সব পুত্র কন্যারা, এক আমি ছাড়া। আমার দুধদাঁত পড়ে নতুন দাঁত ওঠা সমস্তই নূরজাহান বেগমের খাসমহলে। তাঁকেই আম্মি ডাকতাম। আসল আম্মি যখন বাদশাবেগমের মুকুট পরে হাতির হাওদায় দুলতে দুলতে আগ্রা আসেন, ততদিনে আমি এগারো বছরের নওল কিশোর। আমাদের জন্য বরাদ্দ আলাদা মহল। ভাইয়ে ভাইয়ে পাশাপাশি পালঙ্কে ঘুমালেও আমরা কেউ কারও দোসর ছিলাম না। আমরা যদিও একই বাবা-মার সন্তান, তবু যেন কুকুর, বিড়াল, শিয়ালের মতো স্বতন্ত্র প্রাণী। আব্বাহুজুরের নজরেও তাই। আমরা যার যার মতো দেয়ালবন্দী হয়ে পড়ি, আম্মির ইন্তেকালের পরেই কি? উঁচু আর পুরু দেয়ালের গায়ে অনিঃশেষ থাবা মারছি, আঁচড় কাটছি—মনে হয় আমার এ রকম পাগলা দশায় বাংলার নিবাস। বাংলার রাজধানী তখন জাহাঙ্গীরনগর। হুমায়ূন বাদশার আমলে ছিল গৌড়। ঘন ঘন মড়কের উপদ্রবে ত্যক্ত হয়ে গৌড় থেকে তাণ্ডায় রাজধানী সরি

ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার

Image
"ঘুম ভেঙে দুঃখ হচ্ছিল, জিন্দা থাকতে কেন দারা শিকোর সঙ্গে আমার মিলন হলো না? একে অন্যকে এমন মধুর ভাষায় সম্ভাষণ? এ তো খোয়াব, ভাইয়ে ভাইয়ে স্পর্শাতীত মোলাকাত। কতকাল আগে আমি দারা শিকোর চেহারা দেখেছি। মরার আগে অর্ধপলিত কেশ-দাড়িতে তিনি কেমন হয়েছিলেন দেখতে? চামড়ায় বয়সের দাগ ছিল বা হাসিতে দমের ঘাটতি? মানুষ মরে গেলে ইহলোকের কেউ থাকে না, পরলোকের বাসিন্দা হয়ে যায়। আজ যদি আনমনে আমি তাঁর কণ্ঠ শুনি, সে দাউদ নবীর মতো মধুর হলেও মনে হবে আমার ভাইয়ের নয়, এ কোনো গায়েবি আওয়াজ। রাত ভোর হতে কত দেরি? আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। রাজমহল পাহাড়ের গায়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত মেঘ, মরা জ্যোৎস্নায় কেমন ভয়াল দেখায়। বাগানের বৃক্ষরাজিও ভূতুড়ে, যেন মৃদু বাতাসে ফিসফিসিয়ে কথা কইছে। সবখানে চাপা স্বর—জিন নয়তো ইনসানের। আমি কি এখনও খোয়াব দেখছি? একবার মনে হলো পাঙ্খাবরদার বা খানসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, রাতের প্রহর কত, প্রসাদের প্রহরীরা কি ঠিকঠাক পাহারা দিচ্ছে? মির্জা জানি বেগ কেল্লায় আছেন না তাঁর নিজস্ব হাবিলিতে ফিরে গেছেন? পশ্চিমাকাশের জ্বলজ্বলে তারাটির মতো আমিও যে আজ রাতে একা। আমার

সুপ্রকাশের পাঁচ বছর

Image
লেগে থাকার পাঁচ বছর। স্বাতন্ত্র্যের পাঁচ বছর। বাঙালির মনন-আভিজাত্যের পাঁচ বছর। সুপ্রকাশের পাশে থাকার জন্য পাঠক, সুপ্রকাশের লেখক, শিল্পী, কর্মী-- সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা সমস্ত বিপণীকে, যাঁদের মাধ্যমে আমাদের বই পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় প্রতিদিন। কৃতজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে বই-সম্পর্কিত গ্রুপগুলির কাছেও। প্রথম দিনের মতো এখনও মতাদর্শনিষ্ঠ সংস্কৃতিকর্মীর দায় পালনই সুপ্রকাশের কাজ। লেগে থাকতে থাকতে বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকার জন্য লেগে থাকা। :)  'গায়ের জোরে নয়, ছন্দের জোরে' --বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত ছন্দটির খোঁজে, ছন্দের সঙ্গে ছন্দ মিলাতে সুপ্রকাশের এই  অভিযাত্রা। এই অভিযাত্রায় পাশে থাকার জন্য সকলের কাছে রইলো ঋণ ও কৃতজ্ঞতা।

সেকালের সমাজচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা

Image
দীনেন্দ্রকুমার যে পল্লীবাংলাকে দেখেছিলেন, তা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিষাক্ত নিশ্বাসে পুড়ে যাওয়া গ্রাম। যে গ্রামে অভাব, দারিদ্র্য আর বেঁচে থাকার অসংগতি পদে পদে। যে গ্রামে পুরোনো সমাজ ভেঙে গেছে অথচ নতুন সমাজ গড়ে ওঠেনি। তাঁর পর্যবেক্ষণের পরিসরে সমাজ-ইতিহাসের অনেকানেক উপাদান ও উপকরণ ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে কৃষি ও গ্রামভিত্তিক সমাজে বাসকারী একটি বৃহৎ জাতিগত সমাজগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের ইতিহাস—দেশ-কাল-পরিস্থিতির ব্যাখ্যাত্তীর্ণ ভূমিপ্রজ জীবনকথা। সেকালের সমাজচিত্র দীনেন্দ্রকুমার রায় সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা #সুপ্রকাশ

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

Image
"এই মধ্যশরতে প্রান্ত সমতট বঙ্গের এই গ্রামগুলির এক আশ্চর্য নৈশ শোভা হয়। শীতের শেষ মধ্যকাল পর্যন্ত একটা ঘন রহস্যময়তা মানুষের মনে কী গভীর এক মোহবিস্তার করে যেন! শুক্লপক্ষ বা কৃষ্ণপক্ষ নির্বিশেষে, রাত্রির গভীরতা যত বাড়ে, এই শোভা যেন ততই তার রহস্যময়তা বিস্তার করতে থাকে। শরতের শুরুটা এখানে বর্ষারই প্রলম্বিত অধ্যায়। রাঢ়বঙ্গের মতো প্রকৃতিরঙ্গ এখানে দ্রুত সাজ পালটায় না। মধ্যশরতে দু-চারদিন অসম্ভব বর্ষণের পর প্রকৃতি যেন সমতায় আসে। যেন-বা অসম্ভব অভিমানী কোনো মেয়ে দীর্ঘক্ষণ কাঁদাকাটা করে হঠাৎ শান্ততায় স্থায়ী হয়েছে। নদী নালা খালগুলো তখন হঠাৎ তাদের দজ্জালপনা শেষ করে সোজা পথে ধীরগতি হয়। ফুলে-ফুঁসে একে ভাসিয়ে, তাকে ডুবিয়ে, লণ্ডভণ্ড করার বদবুদ্ধি তাদের আর তখন নেই। তখন তাদের আঁচলের পাড়গুলো কেমন যেন আত্মত্যাগে গৈরিক। কারণ অঞ্চলের ওই অংশটুকুর জল তখন বয়ে চলে গেছে। সেখানের ঘাসেরা সব বাদামি বা গৈরিক রঙে রিক্ততার সাজ ধরেছে। জলের এই চলে যাওয়াটাই নদীর আত্মত্যাগ। এরপর থেকেই প্রকৃতির রঙ বদল হতে থাকে। রাতের আকাশ এ সময় গামর হয়ে ওঠা সদ্য যুবতীর চোখের মতো বড় রহস্যময় হয়। দীর্ঘ বর্ষণের পর নির্মল, শান্ত,

সময় ভ্রমণ (দার্জিলিঙঃ পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা)। সৌমিত্র ঘোষ

Image
  নদীর কথা ভাবলেই তিস্তার কথা মনে পড়ে। আর তিস্তার কথা মনে করলেই মনে পড়ে প্রথম তিস্তা দেখার কথা। বাড়ি থেকে দুপুরবেলায় বেরিয়ে কালিম্পঙ যাওয়া হয়েছিল। পাহড়ের ধার দিয়ে খাড়া সরু পথ, ডানদিকে অনেক নীচে নদী, মেঘে কুয়াশায় আচ্ছন্ন অন্ধকার। নীচে তাকাতে ভয় করে। যদি পড়ে যাই? তাহলে কী হবে? সেই থেকে কতদিন চলে গেল, সরু পথ চওড়া হলো, পাহাড় নদী কিছুই আর আগের মতো থাকলো না, কিন্তু তিস্তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলো ভয়, অচ্ছেদ্য বন্ধনে। ফি বছর খাড়া পাহাড়ের গা বেয়ে প্রায় নিয়ম করে নদীতে পড়ে যায় ছোটো-বড়ো গাড়ি, মানুষ। নদী যাদের নেয় তাদের সবাইকে খুঁজে পাওয়া যায় না, বিশেষত বর্ষায়। ডুবুরি নামে, ভেলা নামে, নৌকা নামে, জল তোলপাড় করে ফেলা হয়, তবু পাওয়া যায় না। তিস্তার কথা মনে করলে দ্বিতীয় যে বিষয়টা মনে পড়ে সেটা আটষট্টির বন্যা। তখন পুজোর ছুটি চলছে, আমরা অনেক দূরের চুনারে, একটা পাথুরে টিলার মাথায় একটা ছোটো বাড়ি ভাড়া নিয়ে আছি। তখনও ওইরকম বেড়ানো হতো। অতদূর থেকে এদিকে কী হচ্ছে খবর পাওয়া যেত না, তাও খবরের কাগজ কিংবা রেডিও কিছু একটা মারফত জানা গেল বন্যায় তছনছ হয়ে যাচ্ছে পাহাড়-ছোঁয়া উত্ত

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
একশো কুড়ি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডে আমরা তিনজন। আমি, দাদা, মা। সত্যিই কি তিনজন? নাকি উলটো দিকে বাবাও। যাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ যিনি আমাদের তিন জনেরই দ্রষ্টা। ক্যামেরায় লুক থ্রু করে আছেন। তাঁর দেখায় একটু একটু করে ফুটে উঠছি আমরা। এক নতুন গল্প হয়ে। বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা কল্লোল লাহিড়ী প্রচ্ছদ রূপায়ণ: শোভন সরকার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: মেখলা ভট্টাচার্য মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা #সুপ্রকাশ

ময়ূর সিংহাসন। শাহীন আখতার

Image
মোগল শাহজাদা সুজা পালাচ্ছেন। রাজমহল থেকে টেকনাফের দিকে। এই তাঁর আখেরি সফর। একদিকে তাঁর অন্তরে চলছে হরেক ভাবনা। টানাপোড়েন—ক্ষমতার টানা অর তা থেকে পিছনে যাওযার পরিণতির, শরীরে প্রবাহিত তৈমুরের রক্তের তার আর পালায়নকারী বাস্তবতার, দৌলত আর কিসমতের। তিনি যাচ্ছেন। পেছনে চলছে কাফেলা। বাংলার দীর্ঘ পথজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর পলায়নের স্থায়ী চিহ্ন—সড়কে, স্থাপনায়, মানুষের মুখে তৈরি হয়ে ওঠা গীতে। শাহ সুজার পেছনে চলেছে এক প্রেমিকও। পেশায় কলমচি, আচরণে উভকামী। পথে পথে কত কিসিমের মানুষের সঙ্গেই না তার মোলাকাত—পর্তুগিজ জাহাজের লশকর, শোলক-কাটা জেনানা, মাতাল, হিজড়া-পানের আড়তদার, মক্তবের মিয়াজি। তাদের ধূলিমাখা কাহিনি এসে পৌঁছায় রোহিঙ্গাদের এ সময়ের রক্তাক্ত ইতিহাসে। এ কাহিনি যোগের—রাজাপ্রজা-নির্বিশেষে মানুষের সঙ্গে মানুষের, ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের। শাহীন আখতার লোকগান থেকে বের এনেছেন সামন্তযুগের চাপা পড়া সাধারণ মানুষের কথা। তুলে ধরেছেন মানুষের চিরন্তন কুহকী মন।  ময়ূর সিংহাসন শাহীন আখতার   মুদ্রিত মূল্য: ৩৮০ টাকা  #সুপ্রকাশ

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

Image
"আমাদের শহর আর আমাদের শ্লথ-অলস-মন্থর জীবনে যথেষ্ট 'রহস্য প্রহেলিকা' ছিল না। সেই কারণে শহরের কোনা-কাঞ্চিতেও কোনো ঘটনা ঘটলে তার রেশ কয়েকদিন ধরে প্রাক্-ঊষাকালীন চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সান্ধ্যকালীন তাসের আড্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত হতো। একদা ইংরেজপূর্ব ভারতীয় ইতিহাসে এই শহরের ঊন-গুরুত্ব থাকলেও পরবর্তীকালে বিশেষ বিশেষ ঘটনায় কিছু অব্যবস্থিত প্রতিক্রিয়া বিস্ফারিত হওয়া ছাড়া এখানে রাষ্ট্রীয় কোলাহল প্রবেশ করত কদাচিৎ। তখন পর্যন্ত রাষ্ট্র ছিল আমাদের থেকে অনেকটা দূরের ব্যাপার।  সেই শহরটার চেহারা হঠাৎই যেন বদলে গেল।  আসলে মলিন বাড়ি-ঘরদোর, কোর্ট-কাছারি, দু-চারটি সরকারি অফিস, ঘেয়ো পথ-মাঠ, পথের পাশের জমে থাকা আবর্জনা, খোলা ড্রেন, অলিগলিতে ভ্যাট-ট্যাট, আমাদের রূপেশ্বরী নদীটি--- ইত্যাদি নিয়ে শহরটা একই থাকল। শুধু খেলার মাঠগুলো বেদখল হয়ে গেল; শহরে মানুষজনের পরিমাণ বেড়ে গেল। গলগল করে মানুষের স্রোত এসে মাঠঘাট, রেললাইনের ধার, নদীবাঁধের কিনারা, স্কুল-কলেজ ভরিয়ে ফেলল।  শহরের নিজস্ব মানুষজনও বদলে গেল খানিকটা।  এত মানুষের স্রোত, স্কুল কলেজ বন্ধ-- কেউ আপত্তি করল না। বাজারে টান পড়লো, রাস্তাঘাট নোংরা হলো।

মগ্নপাষাণ। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

Image
"নগরীতে এসে অবধি সুবর্ণ দেখেছে, এখানে বিস্তর গোলযোগ।পাটলিপুত্রের প্রত্যন্ত অন্ধকার পথগুলির কোথায় কার জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করছে, কেউ জানে না। তবু নগরীর জীবনস্রোত বহমান। বিশিষ্ট পথগুলিতে মশাল জ্বলছে। গৃহস্থালির চুল্লীতে এখনও নিয়মিত খাদ্য আরন্ধন হচ্ছে, লোকে পান-ভোজন, নৃত্য-গীতও করছে, কিন্তু তাতে প্রাণের স্ফূরণ নেই। অজ্ঞাত নিয়তির প্রতি কতকটা মরীয়া হয়েই যেন বিপদে উদাসীন নগরবাসী যান্ত্রিক অভ্যাসে তাদের জীবনযাত্রাকে প্রতিনিয়ত ভবিষ্যতের দিকে বহন করে চলেছে। সুবর্ণ তার নাতিক্ষুদ্র জীবনে এই বিশাল নগরীর মতো অত্যাশ্চর্য আর কিছু দেখেনি। আশৈশব গ্রামীণ সত্তায় এমন আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাত্রার কল্পনা করা তার পক্ষে সম্ভবও ছিল না। এ যাবৎ বিশালতা বলতে সুবর্ণ জেনেছে প্রকৃতিদত্ত অদ্রিশিখর ও মহীরুহের উন্নত চূড়াগুলি। মনুষ্যসৃষ্ট নির্মিতিও যে এত বিশালাকায় হয়, এ তার সামান্য বুদ্ধিতে জানা ছিল না। এ নগরীর সব কিছুই বিশাল। বিশাল বিশাল দারুময় অট্টালিকা, তাদের বিশালাকায় স্তম্ভগুলি, স্তম্ভোপরি সুবিশাল খিলান, সুউচ্চ তোরণদ্বার-- সবই সুবর্ণের অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্বকে আরও সংকুচিত করে তোলে। আকারের বিশালতার পরে আছে তাদ

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

Image
"ডুমাটোলার দাদু বলেছিলেন, 'বুঝলে দাদুভাই, এই জীবনটা ছাড়া জীবনে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই।  সবারটা মিলিয়ে তবে আমাদের এক-একটা জীবন। তোমার জমানো খুদকুড়োর মধ্যে দেখবে আছে কত লোকের জীবনের দিনরাত, কতজনের কত গান। সোচো দাদুভাই, ইয়ে কেবল আপকি চিজেঁ নহি হ্যায়---বলতে গেলে তোমারই নয়। তাই আলো-ভালোগুলোকে আগলে রেখো। যেদিন দেখা যাবে খুদকুড়োও নেই, ফুটন্ত ভাতের গন্ধ নেই কোথাও, সেদিন হয়তো এগুলোরই খোঁজ পড়বে। কোনোকিছু অপচয় করো না।"  -- আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর।  প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্যঃ ২৮০ টাকা #সুপ্রকাশ

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
মা দেখছি খুব, খুউব হাসছে। কেন? জানি না। আমি মায়ের পাশে কিশোর কবি সুকান্তের স্টাইলে। দাদা দেখছি তরুণ অপেরার ‘আমি সুভাষ বলছি’র শান্তিগোপালকে নকল করছে। বাবার মুখেও স্মিত হাসি। ছবিটা দেখতে বসে অবাক লাগছে। বাবা কীভাবে অত তাড়াতাড়ি এসে ঠিক পজিশানে বসে পড়েছিল টুক করে। ক্যামেরার ওপাশে কেউ কি ছিল? যার কথায় আমরা হেসে উঠেছিলাম? নাকি অনেক দিন পরে শীতের রাতে ইয়াশিকাকে ফ্রেম করে নিজের জায়গায় রেখে বাবাকে হুড়মুড় করে আসতে দেখে আমরাই হেসে উঠেছিলাম? বাবা নিজেও? জানি না। পেছনে যে চাদরটা টাঙানো হয়েছিল সেটা কি সেই বছরের পুজোর? বালী বাজারের জনতা স্টোর্স থেকে কেনা? হয়তো তাই। ভাঙা পলেস্তারা খসা স্যাঁতসেঁতে পুরনো দেওয়াল ঢাকা পড়তো চাদরে। কেমন যেন স্টুডিও হয়ে উঠতো ঘরটা। ছবি তোলার কোন উৎসব কোনো কালেই ঠিক ছিল না। একটা ইচ্ছে ছিল। মাঝে মাঝেই ইয়াশিকার মধ্যে ফিল্ম পোরা থাকতো। মন ভালো লাগলে। হঠাৎ অবসর এসে গেলে। কিম্বা বাড়িতে একটু পেঁয়াজকলি ভাজা আর নলেন গুড় দিয়ে গরম রুটি খেলে ফুর্তির কম পড়তো না। হরিণঘাটা দুধের মাসিক খাতায় ধার বাড়লেও, দুধ না আসলেও, একটা ব্ল্যাক এ্যান্ড হোয়াইট রিল চলে আসতো ধর্মতলার স্যাভয় থেকে। ইয়াশিকাও নিজ

মল্লভূমের দশাবতার তাস। রামামৃত সিংহ মহাপাত্র

Image
সুপ্রকাশ অঞ্চলচর্চা গ্রন্থমালা ৭ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মল্লরাজাদের রাজত্ব। মল্লবংশের রাজা হাম্বীরের সময় দশাবতার তাসের সৃষ্টি ও খেলার প্রচলন হয়েছিল। সুপ্রকাশ অঞ্চলচর্চা গ্রন্থমালার এই বই দু মলাটে ধরে রাখতে চেয়েছে বিলুপ্তপ্রায় 'মল্লভূমের দশাবতার তাস' শিল্পের ইতিহাসকে। মল্লভূমের দশাবতার তাস রামামৃত সিংহ মহাপাত্র প্রচ্ছদ: তিস্তান মুদ্রিত মূল্য: ২৮০ টাকা #সুপ্রকাশ

বলরামের দোল। সেকালের সমাজচিত্র। দীনেন্দ্রকুমার রায়। সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা

Image
"বলরাম হাড়ী, সুবল চৌধুরী মুচি-- জাত্যাংশে উভয়েই সমাজের একই স্তরের লোক, ইহাও তাহাদের বন্ধুত্ব-বন্ধনের অন্যতম কারণ। সুবল চৌধুরী বলিত, জাতিতে আমি মুচি, এ-জন্য হিন্দুসমাজে আমি অচল, আমরা কুকুরেরও অধম! উচ্চশ্রেণীর হিন্দুর ঘরে কুকুর উঠিলে ঘর অপবিত্র হয় না, কিন্তু আমরা তাহাদের ঘরে উঠিলে ঘর অপবিত্র হয়। তাহাদের রান্নাঘরের তো কথাই নাই, কুকুর তাহাদের রান্নাঘরে প্রবেশ করিলে পাকশালার হাঁড়িকুড়ি ফেলিতে দেখা যায় না, কিন্তু তাহাদের পাকশালার ত্রিসীমানায় আমাদের যাইবারও অধিকার নাই। হিন্দুর ধোপা আমাদের কাপড় কাচে না, নাপিত আমাদের কামায় না। হিন্দু ঘরামি আমাদের ঘর ছাইবে না। এমনকি, হিন্দুর দেবমন্দিরে আমাদের প্রবেশের অধিকার নাই। হিন্দু হইয়াও আমরা-- এই বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুচি উচ্চবর্ণের হিন্দুর অস্পৃশ্য। হিন্দু পূজার দালানে উঠিতে পাইব না, কিন্তু পূজা উপলক্ষে ঢাক-ঢোল বাজাইবার জন্য আমাদের ডাক পড়িবে। আমরা পূজা-বাটিতে ঢাক বাজাইব, কিন্তু উচ্চ-সমাজের হিন্দুর সহিত মিশিয়া পূজা করিতে পাইব না! হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিব, অথচ হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্য হইয়া থাকিব-- এ অত্যাচার অসহ্য। আমার হাতের জল অস্পৃশ্য, হিন্দু আমার ঘরে

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
শুনেছি কোনো একটা বাড়িতে থাকতে থাকতে সেই বাড়িটার মতো হয়ে যায় মানুষগুলো। নাকি বাড়িটা হয়ে যায় মানুষ? তার জানলা, দরজা, কড়িবর্গা, উঠোন, চৌবাচ্চা, জলের কল, লাইটের সুইচ সব যেন শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। বসত করলে মায়া বাড়ে। ছেড়ে গেলে কান্না পায়। এই বাড়িতেই জন্ম হয়েছে আমার। এই বাড়িতে জন্মেছে দাদা। বাবা-মায়ের বিয়ে হয়েছে এই বাড়িতে। ঠাম্মা, মণি, বড়মা, হাঁদা এই বাড়িতেই এক সময়ে কতদিন আগে ওপার থেকে এসে উঠেছিল প্রথমে। শুরু করেছিল আবার নতুন করে সব কিছু। যাদের চারিদিকে ছিল সবজেটে রঙের গ্রাম্য জীবন তারাই দু কামরার স্যাঁৎসেঁতে ঘরে পিলসুজের ওপর প্রদীপ রাখলো। হারানো ছড়ানো দুঃখ গুলোকে জমাট করে রাখলো মনের মাঝে। কাউকে কোনোদিন বোঝার অবকাশ দিল না। ছায়া ছায়া হয়ে একদিন সবাই আবার সরেও গেল যে যার মতো করে। ফাঁকা হয়ে যেতে থাকলো আমাদের চারপাশটা। একদম একলা হয়ে যাওয়ার মতোই। সেই কবেকার একলা হয়ে যাওয়া একটা সংসারকে জড়ো করছি আমরা। ট্রাঙ্কে গোছাচ্ছি। বস্তায় পুরছি। ঝুড়িতে ভরছি। হারিয়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে আমার জন্মস্থান। আমার পুরোনো পাড়া। আমার গায়ে এক তলার বাসার স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ।তখনও আমার জন বার্জার পড়া হয়নি। আমাদের দেখার

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
"শাটারে হাত দিলেই ইয়াশিকা বলে উঠত, ‘ক্লিক ক্লিক’। দাদা বলত, ওটা ক্যামেরার ভাষা, আসলে বলতে চাইছে ঠিক ঠিক।  ইয়াশিকা ঠিক ঠিক করে আমাদের ফ্রেমে ধরত। আর ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলত। আমাদের মধ্য ওই একমাত্র জাপানি। থাকে পাইন কাঠের বাক্সে। বাবা আমাদের দাঁড় করাতো আলোছায়ায়। ধূসর বিকেলের কোনো এক রাস্তায়। হারিয়ে যাওয়া সকালের কোনো এক উঠোনে। উনুনের ধোঁয়ায় চোখ জ্বললে। মিঠাই বরফ টিং টিং করে ঘন্টা বাজিয়ে জানলার সামনে এলে। কারেন্ট অফের অন্ধকারে গল্প বাঁধতো। সেইগুলো বেশ কিছু্টা জানতো ঘুলঘুলিতে বাস করা চড়াই দুটো। তাদের কিচকিচ করতে থাকা ছানা দুটো। শেষ দুপুরে রোদে শুয়ে কুটুস কুটুস ল্যাজ নাড়া মিনিটা। আর অনেকটা জানতো বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা।" গত প্রজন্মের এক ছিন্নমূল পরিবার এপার বঙ্গে এসে মফস্বলে থিতু। এখানে ভাড়া বাড়ি আছে। পাড়া আছে। গঙ্গার ঘাট আছে। আছে হৃদয়ে কাঁটাতারের দাগ নিয়ে জীবনের উদযাপন।  আর? বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা কল্লোল লাহিড়ী প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য প্রচ্ছদ-রূপায়ণঃ শোভন সরকার মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা #সুপ্রকাশ

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
এই যে রাঙা সিঁড়ির ওপর দিব্যি বসে আছে চুপটি করে হাতদুটো সামনের দিকে জড়ো করা। আসন পাতা হয়েছে রাঙা বসবে বলে। এই ছবিটাই কি আমি প্রথম তুলেছিলাম বাবার ইয়াশিকায়? মনে পড়ছে না। তবে এটা বেশ মনে আছে পুজোর সময় ছবি তুলবো বলে যেই না গিয়েছি খুশি হয়েছে রাঙা। একটা নতুন শাড়ি পরবে না? রাঙা বলেছিল “ধুর! শেষকালে ছবির রাঙাকে যদি চিনতে না পারিস তোরা?” সত্যিই তো এই রাঙাকেই দেখে আসছি সেই কবে থেকে। এইরকম আটপৌরে একটা থান। মাথার ওপর দিয়ে ঘোমটা টানা। দাদা ইচ্ছে করে নিজের চশমাটা পরিয়ে দিয়েছিল রাঙাকে। ক্যামেরার পেছনে আমরা যারা ছিলাম সবাই হেসেই কুটিপাটি। এবার একটু গম্ভীর গম্ভীর লাগছে তোমাকে। “আর পা টা? দেখা যাচ্ছে তো? না দেখা গেলে বল ঠিক করে নিই। চন্দন তুলসী দিবি না তোরা?” রাঙার মুখে মিটি মিটি হাসি। কি যে বলো না রাঙা! তাকাও দেখি ক্যামেরার দিকে। শরতের রোদ এসে পড়েছে রাঙার গায়ে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি এমন রোদ যেন এই লেখাটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। গঙ্গার ধারে এই মুহূর্তে সেই না থাকা বাড়িটা যেন আবার হঠাৎ করে ফিরে আসে। মন কেমনের অলি গলি বেয়ে বহুদিন পরে যেন জেগে ওঠে সবাই এক মুহূর্তের জন্য হলেও। বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা কল

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
“এক দেশে এক রাখাল ছিল। খুব গরীব ছিল তারা। সারা দিন মাঠে গরু চড়িয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতো। সকালবেলা মাঠে যাওয়ার সময় শুকনো রুটি নিয়ে যেত। দুপুরবেলায় যখন খুব ক্ষিদে পেত গাছের ছায়ায় বসে শুকনো রুটি আর গুড় খেত। খাওয়ার সময় রোজ ভাবতো যদি এখানে একটা পিঠে গাছ থাকতো বেশ মজা হতো। রোজ গরম গরম পিঠে খেতে পারতাম।” রাখালের পিঠে খাওয়ার গল্পটা একটা ফাঁকা দোতলা বাড়িতে হাওয়ার মতো ঘুরে বেড়াতো। ঠিক দু' কানের ওপর হাত দিলে যেমন শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় তেমন। দিদার ফিসফিসে গলায়, সন্ধ্যের হ্যারিকেনের অল্প আলোয়, শীতের এক লম্বা ছুটিতে আমার সাথে রাখালও এসে ওই বাড়িটায় থাকতো। কিন্তু আমার তো আর রাখালের মতো সাহস নেই। সারাদিন মাঠে মাঠে হইহই করে ঘুরে বেড়ালেও গরু তো চড়াইনা। বাঁশিও বাজাই না। বলতে গেলে পারি না কিছুই। কাজেই একটু একটু ভয় করে আমার। হিসি পেলে সিঁড়ির কোনের জানলা দিয়ে হয়ে যায় ওটা চোখ বন্ধ করে। কিন্তু ঘুম? আমি আরও জড়িয়ে মড়িয়ে লেপ কম্বল আর শীতের চাদরে দিদার গায়ের মধ্যে সিঁধিয়ে থাকি। কারণ আমি জানি গল্পের সূত্র ধরেই আর একটু পরেই তো রাখালের স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়ে একটা মস্তবড় পিঠে গাছ গজিয়ে উঠবে। সেই গাছের ডা

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
দূরে থাকলে বাবা, মা তো চিঠি দেবেই। কিন্তু কজন আর তা রেখে দেয় মনের মণিকোঠায়? প্রতীক্ষা আর উদ্বেগের সেই খতিয়ান পৃথিবীতে সংরক্ষণ হলে এক অন্য মানব সভ্যতার ইতিহাস কি আমরা পড়তে পেতাম না? দেখতে পারতাম না? বাবা যে চিঠিগুলো জমিয়ে রেখে দিয়েছিল সেগুলো আমার কাছে যেন সময়ের এক একটা দলিল। থাকু্ক না সেখানে যতই সংসারের ছেঁদো কথা কিন্তু সেগুলো তো সেই সময়ের কথাও। কোন একটা পরিবারের দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচা। হাতে টাকা নেই, ক্ষেতের ফসল ওঠেনি, কার একটা জ্বর হয়েছে, অনেক দূরে দাদুকে গোরুর গাড়ি চড়ে রোগী দেখতে যেতে হয়েছে, বাছুরটা মারা যাওয়ায় কত ক্ষতি হয়ে গেল, ঠাম্মার ছেলের জন্য উৎকন্ঠা সব নিয়ে এক একটা চিঠি যেন এক একটা মানুষকে নিয়ে শুধু নয় চারপাশের আরও অনেক কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাদের মধ্যে হয়তো আমি অনেককেই চিনি না। কিন্তু চিনতে ইচ্ছে করে সেইকবেকার জমিয়ে রাখা চিঠির সূত্র ধরে।   শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় প্রাণাধিক স্নেহের           বাবা রবি। তোমার পত্র পেলাম। নায়েব মশায়ের কাছে টাকা নেওয়ার অসুবিধে মনে করে তারপদ কাল সুরুলে গিয়ে কালোর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার ঠিক করিয়া আজ কালোর কাছ থেকে ১০০ টাকা নিলাম। কালো তোমার কাছে গেলে

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
আমাদের একশো কুড়ি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের বাড়ির ছোট্ট বারান্দায় একটা লম্বা বেঞ্চির ওপর বসে আছে মা, বড় মণি, ঠাম্মার কোলে দাদা আর হাঁদা। মাত্র কয়েকমাস বয়েস তখন দাদার। শীতের রোদ এসে পড়েছে ওদের ওপর। সবাইকে খুশি খুশি লাগছে। পেছনে যে চাদরটা টাঙানো হয়েছে তার থেকে বেরোচ্ছে অনেক দিন পাট করে আলমারিতে তুলে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধ। বাবা কি সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছিল স্কুল থেকে? নাকি বাড়ি ফিরেই ছবিটা তুলেছিল? অথবা সেদিন ছিল হয়তো ছুটির দিন। উনুনে বসানো ছিল চায়ের কেটলি। সবাই ঘুরে ঘুরে একটু একটু করে চা খাচ্ছিল যে যার ইচ্ছে মতো। তাড়া ছিল না কারোরই। তখনও তো আমি নেই। তারও তিন বছর পর এই বাড়ির ওই বারান্দায়, চেয়ারে, রোদ্দুরে আমার দখল থাকবে। কিন্তু সত্যিই কি নেই আমি তখনও? নিশ্চই আছি। আমার সেই না থাকার গল্প গুলোও যেন হাওয়ায় ঘুরছে সেখানে। ওই রোদটাকে কি আমি দেখিনি কোনদিন? চিনি না বলছো? হাতের ওপর রাখলে দিব্যি তার থেকে শীত শীত গন্ধ বেরোয়। যেমন বেরোয় চৈত্র আর গ্রীষ্মের রোদেও। পাঁচিল থেকে হেলে পড়ে উঠোন আর বারান্দার ঠিক কোনদিকটা কখন সে পড়বে তার একটা হিসেব নিকেশ ছিল। সেইসব জানতো বাড়ির মিনি আর মোটাসোটা হুলোটাও। কে

বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা। কল্লোল লাহিড়ী

Image
সামনে এই মুহূর্তে যে ছবিটা চেয়ে রয়েছে সেটা হয়তো ইটিন্ডের ঘাট। বাবার ইয়াশিকারই ছবি। বয়ে চলেছে ইচ্ছামতী। দাঁড়িয়ে আছে নৌকাগুলো খেয়া পারাপারের অপেক্ষায়। এখান থেকে বাবা তার মায়ের কাছে ওপারে দেখা করতে যেত। আগে যেটা ছিল একটা সংযোগ রেখা এখন সেটাই বিয়োগান্তক করুণ পরিণতি। খানিকটা এই ভূখন্ডের ইতিহাসের মতোই। কেউ হয়তো সত্যিই বলেছিলেন, ‘পার্টিশান ওয়াজ ডিফিকাল্ট টু ফরগেট, বাট ডেনজারাস টু রিমেমবার’।  বাবার ইয়াশিকা ক্যামেরা কল্লোল লাহিড়ী প্রচ্ছদ-পরিকল্পনা ও অলংকরণঃ মেখলা ভট্টাচার্য প্রচ্ছদ রূপায়ণঃ শোভন সরকার মুদ্রিত মূল্য: ৩৩০ টাকা #সুপ্রকাশ

মগ্নপাষাণ। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

Image
"কাকন্দ জানে, কুমার বড় অস্থির হয়েছিলেন কিছুদিন যাবৎ। ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমুৎপীড়নে মাণবিকা আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়েছিল। কিন্তু কুমারের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। পরাজয়ের গ্লানি কুমারের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করেছিল। এই সময় এক গুপ্তচর এসে জানাল, অবন্তীর আগে আর কুমারের অগ্রসর হওয়ার উপায় নেই। সম্রাটের আদেশে মগধের সকল পথ অবরোধ করে সেনাসমাবেশ করা হয়েছে। কুমার যেন রাজধানীতে প্রবেশ না করেন। কুমার ও কাকন্দ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। কাকন্দ বললেন, হঠাৎ কেন এই ব্যাবস্থা বুঝতে পারছি না। কুমারেরও ললাটে ভ্রূকুটির কুঞ্চন। তিনিও সম্ভবত এ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। অন্যমনস্ক ভাবে বাঁশিটি নিয়ে গিয়ে বসলেন টিলার উপরে। শুরু হলো আত্মবিস্মৃত সুরবিস্তারে কোনো অজামার অন্বেষণ। অবন্তীকার আকাশে পুনরায় সৌদামিনী হেসে উঠলেন, গুরুগম্ভীর মেঘডম্বরে আর একবার কম্পিত হলো চরাচর। তীব্র হাওয়ার স্বননে বাঁশির সুর আর শোনা যায় না। ঘনঘোর অম্বুজভারে সারা আকাশ সমাচ্ছন্ন হলেও পশ্চিম দিকের মেঘের একফালি কিনারায় রৌদ্রকর বিচ্ছুরিত হয়ে আশেপাশের ধূসর প্রেক্ষাপটে রচনা করেছে এক অপার্থিব জ্যোতির্বলয়। কুমার বাঁশরি থামিয়

নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা। শতঞ্জীব রাহা

Image
“নদীয়া জেলার গণনাট্য আন্দোলন দেখা দেয় মোটামুটিভাবে পঞ্চাশের দশকে। ষাটের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় দেড় দশক ধরে গণনাট্য আন্দোলন এই জেলায় তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৫২ সাল নাগাদ নদীয়ায় গণনাট্যের শাখাগুলি বাস্তবত দেখা দিলেও তারও কয়েক বছর আগে থেকেই নদীয়ার কিছু নাট্যকর্মী গণনাট্যের মূল ধারাটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে যোগাযোগের মুখ্য ছিলেন প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক প্রমোদরঞ্জন সেনগুপ্ত। এছাড়া যতদূর জানা যায় তৎকালে স্বনামধন্য সুধী প্রধান কলকাতার বেগবান ধারাটির সঙ্গে নদীয়ার প্রগতিপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মীদের যোগাযোগে সহায়তা করতেন। এই সময়কালে উল্লেখযোগ্য ঘটনাঃ কলকাতা থেকে কৃষণনগরে গণনাট্যের আগমন ও বিসর্জন নাটকের অভিনয়। দেবনাথ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে নাটকটি অভিনীত হয়। পরিচালনা করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। অভিনয় করতে এসেছিলেন উৎপল দত্ত, শোভা সেন, কালী বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। লোকারণ্যময় সেই নাট্যাভিনয় কৃষ্ণনগরের তরুণ সংস্কৃতিকর্মীদের আলোড়িত করেছিল। নদীয়া জেলার গণনাট্য আন্দোলনের ধারা ও প্রকৃতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই জেলায় গণনাট্য আন্দোলনের শুরু স্বাধীনতা সম্পর্কে মোহভঙ্গের প্

নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা। শতঞ্জীব রাহা

Image
"বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে নদীয়া জেলায় নাট্যচর্চার প্রসার নিঃসন্দেহে মঞ্চের গণতন্ত্রীকরণের অভিজ্ঞান। যদিও এই শতাব্দীর প্রথম কয়েকটি দশকে ধনীগৃহের অঙ্গনে মঞ্চ বেঁধে নাট্যাভিনয় হতো, তথাপি একে বাবু থিয়েটার বলা যায় না। যুবকদের অভিনয়ে ধনীদের পৃষ্ঠপোষণা ও অর্থসাহায্যও ছিল (যেমনঃ রানাঘাটের পালচৌধুরী, মেহেরপুরে জমিদার মুখোপাধ্যায়রা, মেহেরপুরের মল্লিকরা, চাকদহ-তাতলার অমূল্য ও কালীপদ ঘোষালরা, চাকদহ-গোরাপাড়ার লাবণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, চাকদহ যশড়ার মিত্র পরিবার, কৃষ্ণনগরের রায়বাড়ি বা দাক্ষী পরিবার, চাকদহ কেউটিয়ার জমিদার সতীশচন্দ্র নন্দী প্রমুখ। জমিদার ছাড়াও ছিল শান্তিপুরের বনেদী পরিবারগুলির অর্থ ও পৃষ্ঠপোষণা, চাকদহের ব্যবসায়ী নৈমুদ্দিন চৌধুরী বা ফকির মহম্মদের অর্থসাহায্য ইত্যাদি)। তবু এ ছিল শখের থিয়েটার, সেকালের ভাষায় অ্যামেচার। ক্রমেই শখের থিয়েটার বড়বাড়ির অঙ্গন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে মন্দিরতলায়, বারোয়ারি প্রাঙ্গণে, স্কুল কিংবা ক্লাবের মাঠে। ক্রমেই সাধারণজন এক অর্থে বঙ্গরঙ্গমঞ্চের গণতন্ত্রীকরণের শরিক হয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন অভিনেতা ও কলাকুশলীদের। দর্শকদের পক্ষ থেকে কলাকুশলীদের পুরস্কৃত করার

নদীয়া জেলার নাট্যচর্চা। শতঞ্জীব রাহা

Image
"নদীয়ার নাট্যচর্চার ইতিবৃত্তের সূচনা প্রত্যক্ষত ঘটেছে চৈতন্যদেবের আমল থেকে। সেই সময়ের ইতিবৃত্তের সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মনৈতিক আন্দোলনের আভ্যন্তরীণ ও অন্তর্লীন সত্য়। সুতরাং নদীয়ার নাট্যচর্চার প্রাক্-ইতিহাসপটে প্রবেশের আগে আমাদের পেরোতে হবে নাটকীয় লোকবৃত্তের বেশ কয়েকটি জোন। চৈতন্যদেব মুখ্যত ধর্মান্দোলন পরিচালনা করলেও তাঁর সাধনা ও পদক্ষেপের ভিতরের দিকে বহুলাংশে যে সমাজনীতি নিহিত ছিল, তা আমরা সবাই জানি। তদানীন্তনকালের সমাজকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্যই শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছিল-- সকল চৈতন্যজীবনীকারই এ কথা লিখতে গিয়ে গর্ববোধ করেছেন। 'সমাজ', 'সংকট' ইত্যাদি শব্দের এখানে প্রাযৌক্তিক অর্থ আছে। মধ্যযুগের সমাজ ধর্মনিয়ন্ত্রিত বলেই তার আর্থসামাজিক সংকট বিচারের ক্ষেত্রেও ধর্মের নিরিখটি এসে পড়ে। সুতরাং চৈতন্যদেবের যাবতীয় কর্মপরিকল্পনার উৎসের সমস্ত উপাদানই ধর্মের সমীপবর্তী। চৈতন্যের ভক্তি আন্দোলনের কেন্দ্রে আছে সামূহিক প্রচার সংগঠিত করা। ভক্তির আধারে নগর-সংকীর্তন এবং সম্মিলিত নামকীর্তনের ব্যাপক প্রচলন চৈতন্যদেবের প্রচার-আন্দোলনের সাফল্য সূচিত করে। নবদ্বীপল

সমর ভট্টাচার্য রচনা সংগ্রহ। সম্পাদনাঃ শতঞ্জীব রাহা

Image
“নগেন পাটনি নৌকোর কাছি খুলে দাঁড় হাতে গলুইয়ে বসে কারও উদ্দেশ্যে প্রণাম করে যাত্রা শুরু করল। এখন বর্ষাকাল হলেও বর্ষার শেষপর্ব। গমনের সময় উপস্থিত। শরৎ আসছে আসছে ভাব। নদীর দু-কূলে সাদা বকের ডানার মতন কাশফুলের ইশারা। তারই মধ্যে ধূসর আকাশে ফকিরি আলখাল্লার মতো সবুজ-নীল তালি। আওলা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশময়। কখনও-বা বৃষ্টি হতে হতে চলে যাচ্ছে। কখনও-বা নদীর এপারে বৃষ্টি, ওপার শুষ্ক। অংশু অবাক হয়ে দেখে। স্রোতের পক্ষে নৌকা তরতরিয়ে ছুটছে। হাওয়াটা পক্ষে বলে ছৈ-এর ওপর বাঁশের দণ্ডে পাল টাঙিয়েছে নগেন পাটনি। হাওয়া পেয়ে পাল ফুলে উঠেছে। নৌকো ছুটছে পক্ষীরাজের মতন। দু-গলুইয়ে দুজন পাটনি হাল ধরে স্থির বসা। পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। নদীর দু-কূল দু-রকম। এক কূল উঁচু পাউরি, অন্যকূল সমান্তরাল। এখন জলময়। অন্য সময় অংশু দেখেছে হা-হা করা বিস্তীর্ণ বালুচর। পাউরির ফাঁকফোকরে মাছ-শিকারী পাখপাখালির বাসা– মাছরাঙা, শঙ্খচিলের ওড়াউড়ি।” সমর ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন অবিভক্ত নদীয়ার মেহেরপুরে। অনতি-বাল্যকালেই তাঁদের পরিবার এপার বঙ্গে চলে এলেও সমর তাঁর সত্তা-বিজড়িত মেহেরপুরের অপরিণত স্মৃতি আজীবন বহন করেছেন। উচ্ছিন্ন নিরুপায়তায় ছেড়ে আসা

মগ্নপাষাণ। সূর্যনাথ ভট্টাচার্য

Image
আড়াই হাজার বছর আগে মগধের রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে দশ ক্রোশ দূরে, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গদেশ যেখানে এসে একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে, তারই নিকটবর্তী অরণ্যসংকুল পার্বত্যভূমির বন্ধুরতায় এক বিশাল জলাশয় ঘিরে একটা ছোট্ট গ্রাম লুকিয়ে ছিল। গ্রামের নাম তিন্দারি। সুগম না হলেও, বনে ঢাকা তিনটি পায়ে চলা পথে তিন রাজ্যের সঙ্গে এই গ্রামের সংযোগ ছিল। কিন্তু তিন রাজ্যের সংযোগকারী অন্যান্য সুগম রাজপথগুলি থেকে এই ক্ষুদ্র জনপদটি একরকম অদৃশ্যই থাকত। চারপাশের অসমান টিলাগুলো এই গ্রাম ও জলাশয়কে এক সুরক্ষাবেষ্টনীর মতো প্রচ্ছন্ন রেখেছিল। কীভাবে সেই তিন্দারি গ্রাম জড়িয়ে গেল মগধের সিংহাসনের সঙ্গে ? মৌর্যসম্রাট বিন্দুসারের মৃত্যু পরবর্তী রহস্যাবৃত বছরগুলোতে কীভাবে সিংহাসনকে কেন্দ্র করে রচিত হলো বহুমাত্রিক সমীকরণ ? এই প্রেক্ষিতেই ঐতিহাসিক আখ্যান, ‘মগ্নপাষাণ’। মগ্নপাষাণ সূর্যনাথ ভট্টাচার্য প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী মুদ্রিত মূল্য: ৩৬৬ টাকা #সুপ্রকাশ

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

Image
📖📖📖📖📖📖 "সব মানুষের থাকে বোধহয় এক সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। ঋতুকালের কোনো এক নির্দিষ্ট আবর্তে সেই মোকামের কথা তাঁর স্মরণ হয়। কেউ তা বোধ করে বর্ষায়, কেউ শরতে বা শীতে, কারোর বা অন্য ঋতুতে। একসময় রাজারা এই ঋতুকালে দিগ্বিজয়ে বেরোতেন। এখন আমাদের মতো গেরস্তেরা যায় বেড়াতে। আমি ভাটিকুমার, আমার বোধ যেন-বা বাঁধা আছে শরতে। তাই ঘাসের ডগায় শিশির পড়লে আমার প্রাণ আনচান করতে শুরু করে। তখন বাক্স বাঁধার হুটোপুটি। কিন্তু বহু স্থানে গিয়ে থুয়ে দেখেছি প্রাণের মধ্যে ওই হায় হায় ভাবটি থেকেই যায়। এই ভেজা শিশিরভেজা ঘাসের উপর কাকে যেন চেয়েছিলাম! কৌশানির বিজন বাসে, রানিক্ষেতের শৈলাবাসে, কংখালের গঙ্গাকিনারে গিয়েও মনে হয়েছে, না, এ ঠিক নয়। অবশেষে তার সন্ধান পাই কালীগঙ্গার পারের এক হিজল-কাশ-হোগল-নলখাগড়ার ঝোপে। আর সেই হলো কাল। এখন ঘাসে শিশির পড়লেই পা চঞ্চল। এই আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। একদা এখান থেকেই দেহতরী ভাসিয়েছিলাম গোনে, তাই এখন উজানযাত্রায় যাই সিদ্ধিগঞ্জের মোকামে। কালীগঙ্গার শেষ ঘাট আমার সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। হোগল, কাশ, নলখাগড়ার ঝোপের মধ্যে থাকে আবার এক মুখ। সে মুখের কোনো বাস্তব অবয়ব নেই, আ

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

Image
📖📖📖📖📖📖📖📖📖 "হোটেলের বাইরে পা দিতেই কালীগঙ্গার সেই আলোকস্তম্ভ চোখে পড়ে। ফকির বলেন-- মোগো কচার চক্ষু। চারদিকেই এখন অন্ধকার। শুধু তার মাঝখানে ওই আলোকস্তম্ভটি ঘুরে ঘুরে নদীর উপর তার রোশনি ফেলে যাচ্ছে। আকাশেও এখন নক্ষত্র। পূর্বে সামান্য আভা, পথ জনহীন। যেখানে সারা দিনমান হাজার লোকেরা কলোচ্ছ্বাস, সেখানে এই নির্জনতা বড়ো বিষণ্ণতা আনে।.. ঘাটে এসে সবাই জেটির উপর বসি। সামনে কালীগঙ্গা। পূর্বমুখী আমরা, ডাইনে দূরে আলোকস্তম্ভ, বাঁয়ে নদীর আঁতুরঘরের রাস্তা ঘন অন্ধকারে সম্পূর্ণই দৃষ্টির আড়াল, অথচ তার অস্তিত্বের ঘোষণা, আমাদের সামনে সামান্য উজ্জ্বল আলোয় দ্রুত ধাবমান কচুরিপানার অনন্ত মিছিলে সম্যক প্রতিভাত। আবার আলোকস্তম্ভের পর থেকে নদীর গতিপথ সেই একই দুর্ভেদ্য অজ্ঞেয় অন্ধকারে ঢাকা। আমরা শুধুমাত্র সামনের সামান্য উজ্জ্বল অংশের মিছিলটুকু দেখি, বাকিটা অনুভবে বুঝতে চাই। যেটুকু দেখি সেইটুকুই অনুভব-- সেটুকুই কার্যকারণের সূত্র এবং যুক্তি সিদ্ধান্তের একমাত্র উপকরণ। সেখানে যাঁরা অনুভবের গ্রাহক তাঁরা তাঁদের তত্ত্ব গড়েন এবং তা গানে, কথায়, ভাবের আদান-প্রদানে বিশ্বাসের জগতে স্থাপন করেন। আর যাঁর

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম। মিহির সেনগুপ্ত

Image
"বেরাম বেড়ে অগাধ পানি, তার নাই কিনারা তরণী পারে।" ফকিরের গানটি এখন চলমান ট্রলারে আমার মাথার মধ্যে যেন আরও বেশি সুরেলা এবং অর্থবহ মনে হচ্ছে। ফকির আরও গেয়েছিলেনঃ "নোনা জলে ভাসাইলি রে তোর সোনার বজরাখান।/ এ তরী জীর্ণ হবে কে সামলাবে, ডাকবে যদিন হড়পা বান।" এখন যে নদী দিয়ে আমার সোনার বজরাখানা ভেসে চলেছে, অনেক রক্ত, অশ্রু, ঘামে তার জল তো নোনা বটেই। হুলারহাট পেরিয়ে এসেছি। ডডডড আওয়াজ করে আমার সাধের বজরাখানা চলেছে। সিদ্ধিগঞ্জের মোকামের শেষ ঘাটের দিকে। ট্রলারকে বজরা বলায় দোষ নেই। শব্দটির মধ্যে যতই বাঙালি বাবুয়ানির উনিশ শতকীয় নস্টালজিয়া থাকুক, তার ঔরসদাতা ইংরেজি বার্জ শব্দটি। কিন্তু হায়, বাংলাদেশে কি এখন আর একটিও বজরা আছে? তা সে যাকগে, যার নাম বজরা, সে-ই মোটরযুক্ত হলে বার্জ হয়। নামে কী আসে যায়। তা সোনার বজরা আমার এখন নোনাজল কেটে পাড়ি দিচ্ছে কচানদীর বুক চিরে। নামে কী আসে যায়। কাল শরৎ, সময় ঊষা। কচার দু পাশের দৃশ্য এবং সামনে নদী, আকাশ আর হালকা কুয়াশার আস্তরণ মাখামাখি দেখে কাব্যি করে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার মধ্যে দেখো, আবার বালার্ক বিচ্ছুরণের বর্ণালী। ঋক মন্ত্রের

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

Image
আদতে উত্তর রাঢ়ের গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলের বাসিন্দা হলেও বাবার কাজেরর সূত্রে কিছুকালের জন্য পরিবারটিকে থাকতে হয়েছিল শুকনো আবহাওয়ার পাথুরে গরমের লালমাটির দেশে। কিন্তু সেখানেও জ্বর-জ্বারি ছিল সাধারণ অনুষঙ্গ। সাত-আটদিন জ্বর। সকালে জ্বর কমে যায়, সকালের অরুচির জলখাবার খেয়ে জ্বরীয় পিপাসায় আকণ্ঠ জল খাওয়ার পরই আবার কম্প দিয়ে জ্বর। বাবা সকালের বেরোবার আগে মাকে বা দিদিদের কাউকে নির্দেশনা দিয়ে যান। সারাদিন লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে। ঘন্টায় ঘন্টায় থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে মা লিখে রাখেন একটা কাগজে। মাঝখানে একবার মাথা-ধোওয়া , তীব্র আপত্তি ও কান্নাসহ সাবু-বার্লি গলার্ধকরণ। মাঝে মাঝে দিদিদের কেউ এসে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যায়, দিদিরা স্কুল-কলেজে চলে গেলে মা। ওষুধ বলতে দরিদ্রের শিশি-ঝাঁকানো জল, সাদা সাদা মিষ্টি বড়ি বা পুরিয়া-বন্দি সাদা পাউডার। সেই ওষুধেই জ্বর বাড়া-কমা, সাতদিন বা দশদিনের তীব্র জ্বরের পরও কোনোরকম দুর্বলতা বা শরীরী লক্ষণ না-রেখেই জ্বরের অবসান। যেদিন স্নান ও ভাতের অনুমতি পাওয়া যেত, সেদিন বুকের ভেতরে অন্তর্গত উৎসবের নৃত্য-- আজ ভাত খাওয়ার দিন। সে ভাত তো যে-সে ভাত নয়, জ্বরমুক্ত ভি আই পি-র

আহাম্মকের খুদকুড়ো। দুর্লভ সূত্রধর

Image
📕 ক্ষয়িষ্ণু শীত-সকাল আর তেল-হলুদে স্নান।📕 আমাদের শহরে তখন সরস্বতী পুজোর খুব জাঁক ছিল। সব দেবদেবীর মধ্যে সরস্বতীই ছিলেন ছেলেমেয়েদের নিজস্ব ব্যাপার, যাকে বলে এজমালি এলাকা। বারোয়ারি বা পাড়ার পুজোর বদলে স্কুল-কলেজ ছাড়া মুখ্যত তিনি ক্লাবে ক্লাবে পূজিতা হতেন। শহরের ক্লাবগুলি কী সব নাম ছিল। সেসব নামের মধ্যে আমাদের শহরটির সংস্কৃতির সৌরভ পাওয়া যেত— পূর্বপথ, আলোকলতা, সুবর্ণরেখা, কচি-কিশলয়, সখা-সংসদ, বীরপুরুষ, শিশিরবিন্দু, থাক, রূপবান, রূপারোপ, কোমলগান্ধার, সৃজনসাধী, রূপরাজ, উদয়াচল, ঝিলম, রূপায়ণ, রজনীগন্ধা, পূর্ব-বলাকা, শ্যামসজনি—ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব ছাড়া বালক সংঘ, কিশোর সংঘ, সবুজ সংঘ, তরুণ সংঘ, আমরা কজন, আমরা সবাই, বিদ্যুৎ সংঘ, সেভেন বা নাইন বুলেটস্, সেভেন স্টার—এসব তো ছিল। অলিতে-গলিতে গণ্ডায়-গণ্ডায়! ভালো করে লক্ষ্য করতে বোঝা যায়—সে-সময় সরস্বতী পুজোয় ত্রিস্তর ক্লাব ব্যবস্থা চালু ছিল। প্রথম স্তরে ছিল বড়োদের ক্লাব, তার পরের বয়ঃস্তর বা সদ্য যুবকদের ক্লাব, বাকি সব কচিকাঁচাদের ক্লাব। নিজের নিজের স্কুল-কলেজ লাইব্রেরি ছাড়াও আমরা প্রত্যেকেই পাড়ায় বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোনো-না কোন