Posts

Showing posts from December, 2023

সময় ভ্রমণ।। দার্জিলিং : পাহাড়-সমতলের গল্পগাছা।। সৌমিত্র ঘোষ।।

Image
দোমোহানি জায়গাটা পুরোনো, ইংরেজ আমলে রেল কোম্পানির ঘাঁটি, ইটের পুরোনো বাড়িঘর এখনও দু-একটা দেখতে পাওয়া যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানতেন, দোমোহানি জায়গাটাতে যারা থাকে, তারা সবাই মানুষ নয়, তাদের গা থেকে সন্দেহজনক গন্ধ ছড়ায়। সেই পুরোনো ভূতুড়ে দোমোহানি পুরো ডুবে গিয়েছিল, শোনা যেত, সেখানে শুশুকেরা সাঁতার দিচ্ছে। ঊনসত্তরের গোড়ায় জলপাইগুড়ি গিয়ে দেখি বাড়িতে বাড়িতে বাইরের দেয়ালে পলি জমাট হয়ে আছে তখনও, শহরের বাসিন্দাদের মন থেকে তিস্তার ভয় তখনও শুকোয়নি। সবাই বলছেন, কী করে বাঁধ ভেঙে মুহূর্তে ধেয়ে এসেছিলো পাগলা জল। তিস্তা তো বটেই, এমন-কী করলার মতো নিরীহ শান্ত নদীও ক্ষেপে গিয়েছিল। দেয়ালে পলির দাগ বহুদিন অবধি পড়া যেত। আটষট্টির আগে পঞ্চাশের বন্যা, ভূমিকম্প। আমার বাবা সেসময় কি তার আগে থেকেই এ অঞ্চলের বাসিন্দা, তাঁর কাছ থেকে গল্প শুনতাম কালিম্পঙ যাওয়ার ছোটো রেলগাড়ির। তিস্তার জল ছুঁয়েই প্রায় সে গাড়ির লাইন শিলিগুড়ি থেকে গেইলখোলা অবধি যেতো। গেইলখোলার আগের স্টেশন রিয়াং। মংপু যেতে হলে সেখানে নামতে হতো। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রিয়াং স্টেশনে নেমেছিলেন বারকয়েক, সে গল্প মৈত্রেয়ী দেবীর লেখায় পাওয়া যায়। তার কিছু পরে, দ্

এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

Image
একদেশ থেকে ছিন্নমূলেরা দলে দলে আসতে থাকল, এদেশের প্রান্তিকেরা পাড়াকে পাড়া উজাড় করে যে কোথায় গিয়ে পুনর্বাসন পেল, তার হদিস পেলাম না। যেদিন সন্ধ্যার সময়ের কথা প্রসঙ্গে এতসব কথা এল, সেদিন আমরা, মানে মা, টুনু (আমার স্ত্রী) এবং অন্য ছোটো ভাইবোনদের কেউ কেউ বারান্দায় বসে দেশের বাড়ির গল্প করছিলাম। হঠাৎ কয়েকটি কচি কন্ঠের ছড়া গান কানে এল। হ্যারিকেন হাতে কয়েকটি ছোটো ছোটো প্রায় আধা ন্যাংটা রোগা-ভোগা ছেলে-মেয়ে ছড়া গাইতে গাইতে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তারা গাইছিল— ঘেঁটু চাই ঘেঁটু চাই ঘোষপাড়া, ঘেঁটু আমাদের প্রাণের ঠাকুর। যে দেবে থালা থালা তার হবে সোনার বালা। যে দেবে ঘটি ঘটি তার হবে সোনার বাটি।... ইত্যাদি। একখানা ডালা না কুলোয় যেন কিছু ঘেঁটুফুল (ভাট ফুল), আশেপাশে এক-আধটা পয়সা বা সামান্য কয়েক মুঠো চাল। বাড়ির কিছুটা তফাতে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারের বাড়ি। তাঁর বাড়ির পাশেই এই সব শিশুদের বাসস্থান, যার অধিকাংশই এই ভদ্রলোক দখল করে নিয়েছিলেন। এদেরটা তখনও পারেননি। সম্ভবত এদের অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা জোটেনি। অথবা তাদের এই পাড়া ছেড়ে কোথাও যাবার ইচ্ছে ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী সেই ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক প্রায়শই আমাদের বাড়িতে আসেন।

এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

Image
১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ কি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ হবে। বালুরঘাট থেকে এঘাট-ওঘাট ঘুরে যখন ভদ্রেশ্বর স্টেশনে নামলাম, প্রথমেই মায়ের বৈধব্যাবস্থার ছবিটা মনে ভেসে উঠল, যেমন আগে বলেছি। প্রত্যেক সন্তানের কাছেই মায়ের একটা বিশেষ স্থায়ীরূপ, পাকাপাকি ভাবে থাকে। কখনো তা কল্কা-পাড়ের সাদা শাড়ি পরা, কানে কানপাশা বা কানবালা, নাকে নাকছাবি। কখনও বা হাতে অনন্ত। তাছাড়া, শাখা, নোয়া, পলা তো আছেই এবং গলায় হার। বৈধব্যের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের এই সমুদয় সম্ভার যেন একটা প্রবল হাহাকারের মতো সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে ফুরিয়ে যায়। সেই শূন্যতার মুখোমুখি হঠাৎ কীভাবে গিয়ে দাঁড়াব সেই ভাবনাটা যেন স্টেশন প্ল্যাটফর্মে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ, গোটা রাস্তা এই বিষয়ে আমার যেন কোনো চেতনাই ছিল না। রিক্সা থেকে নেমে গেটের সামনে আমি যেন একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে একটা অদ্ভুত বিকৃত-প্রায় গলায় ডাকলাম—'মা'। আমার গলা শুনে মা মেঝেতে বসা অবস্থা থেকে উঠতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন—উনি বলেছিলেন,—'ওর জন্য আমি যেতে পারছিলাম না। ও আমাকে আটকে রেখেছে।' মায়ের এবং বাবার এইসব

এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

Image
একটা যুগ ছিল। সেটা আলিবর্দি খাঁয়ের আমল। তখন বর্গীর উৎপাত। বৃদ্ধ নবাব প্রায় তরুণের মতো এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে উল্কার বেগে বর্গীদের হামলার মোকাবিলা করছেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর প্রজাদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। তখন রাঢ় থেকে বঙ্গে বাঙালি আশ্রয় নিচ্ছিল। তার পর বহু যুগ গত হয়েছে। ভাগীরথীর পুব পার ধরে তাবৎ গঙ্গাহৃদয় অধিবাসীরা নতুন করে প্রতিষ্ঠা স্থাপন করে ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করে স্থিতিশীলতা লাভ করেছিল। কিন্তু বাঙালি জন্মসূত্রেই উদ্বাস্তু। সেই কোন পাল যুগে তার জন্ম হয়েছিল, তারপর ক্রমে সদ্ধর্ম লুপ্ত হয়ে পরদেশি সেন-বংশীয়রা রাঢ়বঙ্গের সাম্য অভিযাত্রার অভিমুখ বদল করে ব্রাহ্মণ্য অভিযাত্রা অব্যাহত করল। সেই ব্রাহ্মণ্য ভেদাচারের ফলে বাঙালি ক্রমশ ছিন্নমূল হয়ে একবার পুব, আরেকবার পশ্চিমে ছোটাছুটি করতে থাকল। এটা যেন অতঃপর বাঙালির অদৃষ্টলিপিই হয়ে দাঁড়ালো। আমার পরিবারের রাঢ় অঞ্চলে সম্ভাব্য প্রবাস এই উদ্বাস্তুয়ানারই ফল। আমার পূর্বপূরুষ, শুনেছি, রাঢ় অঞ্চলের কোনো এক 'ভূম' রাজ্য ছেড়ে ঢাকা বিক্রমপুরের সুবর্ণগ্রামে বসতি করেছিল। শিখরভূম নামক একটি 'ভূম রাজ্য' সেন বংশীয় রাজাদের অন্য

এপার বড়ো মাঘমাস, ওপার বড়ো কুয়া।। মিহির সেনগুপ্ত।।

Image
তিন কুড়ি বছর পেরিয়ে গেল সেই বাড়িটা ছেড়ে চলে এসেছিলাম। জন্ম থেকে সেই বাড়িটাতে মোটামুটি থেকেছিলাম অনধিক ষোলো বছর। এখনও যদি কেউ জানতে চায়—'আপনার বাড়ি কোথায়?' কিছু না ভেবেই উত্তরটা দিয়ে ফেলি—বাড়ি কেওড়া গ্রামে। থানা ঝালকাঠি, জেলা বরিশাল।' অথচ, এই ঠিকানায় আমার অবস্থান ছিল বছর ষোলোর মাত্র। ষাটের দশকের তৃতীয় বছরে দেশ ছেড়ে এসেছিলাম পশ্চিমবাংলায়। তারপর সে লম্বা কথা। বাড়ি কোথায়, প্রশ্নটার উত্তর দিয়ে যে ঠিকানাটা বলি, কালের চক্রান্তে তা এখন আর তেমনটি নেই। তখনও বাড়িটা কোথায়, এর উত্তর দিতে গিয়ে বলি, যেমন একটু আগে বললাম। কিন্তু যদিও গ্রামটা এবং বাড়িটা এখনও তেমনই পরিচয়ে আছে, লোকে চিনবেও। কিন্তু আসলে এখনকার পরিচয়—গ্রাম কেওড়া, থানা এবং জেলা ঝালকাঠি, বরিশাল বিভাগ, দেশটা বাংলাদেশ। যখন দেশটা জন্মশোধ ছেড়ে চলে এসেছিলাম, তখন ঠিকানা লেখা হতো, শ্রীযুক্ত অমুক, কেয়ার অফ শ্রীযুক্তবাবু অমুকচন্দ্র তমুক। গ্রাম কেওড়া, পোস্ট অফিস কেওড়া, থানা ঝালকাঠি, জেলা বরিশাল, পূর্ব পাকিস্তান। ক্রমশ দেশটার অনেক পরিবর্তন হয়ে এখন নাম হয়েছে বাংলাদেশ অর্থাৎ এখন আর পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তান নয়। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ

ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

Image
গ্রামের প্রান্তে মোসুপের সামনের ছোট্ট মাঠের মধ্যে তখন বিশাল গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে আগুন ও আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কুণ্ডের চারিদিকে প্রায় পনেরো কুড়িটি ছেলেমেয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমাকে পৌঁছে দিয়ে গামরা বিদায় নিল। ছেলেছোকরাদের নাচের আসরে বুজুরুকদের (বৃদ্ধ) থাকতে নেই। এটাও রেওয়াজ। সেদিন চাঁদনি রাত—কিন্তু হিমালয়ের হিমেল জমাট কুয়াশা ভেদ করে সেদিন চাঁদের কেরামতি দেখাবার হিম্মত ছিল না। অস্পষ্ট নিস্তেজ আলোর কুহক বিস্তার করেছিল শুধু—অগ্নিকুণ্ডের আভায় যতটুকু আলো হয়েছিল, তার মধ্যে দেখলাম, আবর মেয়েদের চুল হ্রস্ব করে ছাঁটা—প্রায় ছেলেদের মতো। পরনে বেড় দেওয়া কাপড় হাঁটু পর্যন্ত—ঊর্ধ্ববাস এক একটা হ্রস্ব কাঁচুলি, গলায় মালা। আমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে একটি ছেলে ছড়ার মতো গান গেয়ে উঠল। হাতে তার সন্ন্যাসীদের মতো একটা চিমটা—আর তার মধ্যে লোহার বলয়। গান করছে আর হাত ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তাল দিচ্ছে সেই চিমটায়। সমস্বরে ছেলেমেয়েরা সেই গানের পুনরাবৃত্তি করছে। সকলে হাত ধরে বা কোমর ধরে একে একে সারিবদ্ধ হলো। একটু পিছিয়ে একটু সামনে এগিয়ে তালে তালে নাচতে লাগল আর অগ্নিকুণ্ডের চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল। ওদের নাচের ধরনট

ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

Image
পাহাড়ের কাছে এলে আমার মনের অতল থেকে একটা ভাব ওঠে। মনে হয় এ পাহাড়ে আমার পদচিহ্নই প্রথম পড়বে—মনে হয় অনেক গোপন রহস্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য—যা আমিই প্রথম উদ্‌ঘাটন করব—মনে হয় এর গহন-কন্দরে যে গুপ্তধনের পাহারায় যক্ষের দল শত শত যুগ কাটিয়েছে—তারা যেন আমারই অপেক্ষায় রয়েছে—তাদের যুগ যুগ সঞ্চিত সে সম্পদ, সে ঐশ্বর্য আমার হাতে দেবার অপেক্ষায়— ইয়াজালির ছোট্ট সবুজ একখানি গোলাকার উপত্যকায় দাঁড়িয়ে উত্তরে মালভূমির দিকে তাকিয়ে আমি সেই কথাই ভাবছিলাম। হাওয়া ক্যাম্প থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার উত্তরে ছোট্ট এই উপত্যকাটির গঠন—চ্যাপটা চায়ের ডিশের মতো। অর্ধবৃত্তাকারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে চাষের জমিগুলি সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে উঠে গেছে। একদিক থেকে ছোট্ট পাহাড়ী নদী বয়ে চলেছে রাঙা নদীর দিকে—। এখানে দেখলাম একদল ডাফলাকে, কোমরের ওপর থেকে জানু পর্যন্ত পাকে পাকে জড়ানো বেতের আবরণ—মাথার চুল উঁচু করে বাঁধা। আমার ক্যামেরার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে ছবি তুলতে সাহায্য করল। শুনেছি ঐ মালভূমির উপর সুবনসিঁড়ি ডিভিসনের হেডকোয়ার্টার শহর 'জিরো'। মালভূমির নাম হাপোলি। এই মালভূমি আপাথানীদের আবাসস্থল। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে আমি এক আপাথ

ছায়াবৃতা।। সুনীল সেনশর্মা।।

Image
বমডিলা শহর ছাড়িয়ে কিছু উত্তরে বর্তমান রাস্তা ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোলেই এই গিরিশ্রেণীর মধ্যেকার আর একটি গিরিপথ পাওয়া যায়। এটাই বমডিলা। গিরিশ্রেণী হঠাৎ যেন অবরোধ সরিয়ে নিল এক অপরূপ দৃশ্য দেখাবার জন্য। উত্তরে ঊর্মিমালার মতো গিরিশ্রেণী তুহিন-শুভ্র স্থায়ী বরফের মুকুট পরে প্রভাত সূর্যের প্রতিফলিত আলোয় ঝকমক্ করছে। যেন বীচি-বিক্ষোভিত সফেন সমুদ্র রামচন্দ্রের অদৃশ্য নির্দেশে চঞ্চলতা ত্যাগ করে মুহূর্তের মধ্যে স্থাণুরূপ নিল। আর সেই থেকে এমনি করেই শোভা পাচ্ছে। এই গিরিশ্রেণীর মুখ্য শৃঙ্গ গৌরীচেন। কিন্তু এর আগে সোজা নীচের দিকে তাকালে আর এক দৃশ্য। দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের ঢালে ঘন সবুজের সমারোহ, এত সবুজ যে দূর থেকে ঘন কালো প্রতিভাত হয়। থরে থরে সাজানো পাইন, ওক গাছের সারির মধ্যে রডোডেনড্রনের সারি। ঘন কৃষ্ণ বনরাজির মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তবর্ণের রডোডেনড্রন যেন কৃষ্ণা পাহাড়ী-কন্যার ঘন কৃষ্ণ কেশরাজিতে করবীর শোভা। সাহিত্য এবং উপমা আমার আসে না, কিন্তু ভাষার দৈন্য অনুভব করি যখন এমন মহান, বিশাল এবং রকমারি বাহারি দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে যাই, বর্ণনা করার ভাষার অভাবে। এ এক অন্য জগৎ, যার সঙ্গে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা মেলে না,

যাত্রাগানে মতিলাল রায় ও তাঁহার সম্প্রদায়।। হংসনারায়ন ভট্টাচার্য।।

Image
যখন কলকাতার রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয়ের জমজমাটি চলছে আর মফস্বলে তার অনুকরণে এখানে ওখানে গীতাভিনয়ের প্রচেষ্টা ক্ষীণভাবে দেখা দিচ্ছে, তখন যাত্রাগানে যুগান্তর এনে দিয়েছিলেন মতিলাল রায়। তিনি গানের সঙ্গে কথকতা জুড়ে দিয়ে এবং ভাঁড়ামি বর্জন করে গীতাভিনয়ের সুর উচ্চগ্রামে বেঁধে দিলেন। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ, বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগ মতিলাল রায়ের যাত্রা হচ্ছে শুনলে উদ্বেলিত হয়ে উঠত। যাত্রার দল করে মতিলাল রায় যতটা আভিজাত্য ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন, এমন কোনো নট-নাট্যকার তো দূরের কথা, কোনো কবি-সাহিত্যিক-পণ্ডিত পাননি এ দেশে।  ................................................................... 'যাত্রাগানে মতিলাল রায় ও তাঁহার সম্প্রদায়' প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশের যাত্রাগানের বিবর্তনের অনুপুঙ্খ ইতিহাস। কীর্তন, কবিগানের লড়াই, পাঁচালি, বিদ্যাসুন্দর যাত্রা, কালুয়া-ভুলুয়ার নাচ থেকে যাত্রাগান হয়ে থিয়েট্রিক্যাল অপেরা, থিয়েটারে উত্তরণ-যাত্রাপথের যে বিচিত্র আখ্যান, বিপুল পরিশ্রমে বঙ্গদেশের বিনোদন জগতের সেই ইতিহাস তুলে এনেছেন হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য।  . . . যাত্রাগানে মতিলাল রায় ও তাঁহার সম্প্রদায় হংসনারায়ণ ভট্টা

বাঙালির শিকার স্মৃতি।। সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস।।

Image
গত বছরের মতো এবারও অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম থেকেই বাঘের উপদ্রব শুরু হয়। সাতখানা গ্রামের লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। জাফরনগরের বীর আসরে নেমেছেন। আজ হিজুলী, কাল হালালপুর, তার পরের দিন জাফরনগর, প্রত্যহই গো হত্যার সংবাদ আসতে থাকে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বীরের অভিযান হয় শুরু। প্রত্যহই খোরাকের জন্য চাই একটা আস্ত গরু আর তাছাড়া জলযোগের জন্য দেশী কুকুর, ছাগল ও ভেড়া প্রায়ই প্রয়োজন হয়। স্থানীয় শিকারী মহলে সাড়া জাগে। কেউ জানোয়ার চলা পথের উপর মাচা বাঁধলেন, কেউ মরী'র উপর বসে রাত কাটালেন, কেউবা লোক দিয়ে জঙ্গল ঘিরিয়ে বন পেটালেন; কিন্তু সবই বিফল হল। জাফরনগরের বীর যে বিভীষণের পরমায়ু নিয়ে এসেছে, ওকে মারে কে? সংবাদটা মহাকুমা হতে সদরে গেল এবং সেখান থেকে গেল কলকাতা শহর পর্য্যন্ত। এবার কলকাতা হতে মোটর বোঝাই হয়ে শিকারীর আমদানী হতে লাগলো; কিন্তু ফল কিছু হল না। টিফিন কেরিয়ার খালি করে ক্লান্ত দেহে ফিরে যেতে লাগলো। সংবাদ পেয়ে আমেরিকান সৈনিকের দল এসে তাঁবু গাড়লেন জাফরনগরের বনের কিনারে। উজ্জ্বল তাদের স্বাস্থ্য, লোভনীয় তাদের পরিচ্ছদ, আর সকলের হাতেই একটা করে দামী মানুষ মারা রাইফেল। গ্রামে গ্রামে সাড়া জাগে। এবার বাঘ ম

বাঙালির শিকার স্মৃতি।। সম্পাদনা : গৌরব বিশ্বাস।।

Image
জঙ্গলের ডাকবাংলোয় রাত্রি প্রায় ন'টার সময় দরজা ধাক্কানো শুনে ঠাকুমার ঝুলির রূপকথার সেই কথাটা মনে এল, এত রাত্রে কে ডাকাডাকি করে? কিন্তু প্রথম ধাক্কায় আমি সাড়া দিই নি। পর পর দু'রাত জেগে শিকারে গিয়ে শরীর ক্লান্ত, কাজেই তৃতীয় রাত্রি পুরো বিশ্রাম নেব ঠিক করেছি। স্থানীয় শিকার-সঙ্গী রফি এসেছিল হাঁকোয়ার প্ল্যান করতে, আমি তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে সাড়ে আটটার মধ্যে নৈশভোজন শেষ করে লেপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। একে শীতকাল, তার ওপর দু'রাত্রি ঘুম নেই, কাজেই বিছানায় গা-টা এলিয়ে দিতে সারা শরীরে একটা আরামের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। শিয়রে রাখা হ্যারিকেনের মৃদু আলোতে রিডার্স ডাইজেস্টের একটা গল্প পড়ছি, আর নিদ্রাদেবীর আরাধনা করছি। তখন কি আর কেউ ডাকলে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভগবান বিরূপ, দরজায় আর একবার ধাক্কা পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে ডাক, 'শিকারী সাহেব হো।' বিরক্ত হলাম, কিন্তু উঠতেই হল। দরজা খুলে দেখি বারান্দায় দু'টো লোক। একজন বেশ লম্বা, আর একজন বেঁটে। তাদের হাতে হ্যারিকেন, গায়ে পুরোনো কোট, আর তার ওপর নাক আর চোখ দু'টো খোলা রেখে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত চাদর জড়ানো। আমাকে দেখে লম্বা লোকটি হ্যারিক

হাফ প্যাডেলের কাল।। অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

Image
সুপ্রকাশ প্রকাশিত অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর বই 'হাফ প্যাডেলের কাল' পড়ে লিখেছেন অর্ণব বসু। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। ........................................ আমরা যারা নিতান্ত মফস্বলের ছেলে মেয়ে, আমাদের সকলেরই একটা হাফ প্যাডেলের কাল ছিল! রঙচটা, ভেঙে যাওয়া সাইকেল জানে সে সব আত্মগোপনকথা। চোখে তখন একটু একটু করে রোদের আলো ফুটছে, আমরা দেখছি দুহাজার সাল পেরিয়ে আসা বিশ্বের রঙরূপ কীভাবে পালটে যাচ্ছে কালের সীমায়! নব্বই দশকের মালেনা সিনেমা দেখে মনে হয়েছিল, এই তো আমাদের জীবন, 'সাইকেলচারীর আত্মকথা', দু চাকায় বিশ্বভ্রমণ!  ছোটো ছোটো মফস্বল একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ছে শহরের দিকে! লড়ঝড়ে সাইকেলের দিন ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে, কংক্রীটের স্বভাব বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে আমাদের কমিউনিকেশনের পদ্ধতি, এমন একটা অদ্ভুত সময়ে আমরা বড় হচ্ছিলাম। অর্থাৎ দুহাজার সাল পরবর্তী।  বড় হওয়া বলতে দীর্ঘ বালকজীবন পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ। কিন্তু কেমন ছিল ষাট বছর আগে দুর্গাপুরের আধা গ্রাম আধা শহরে কোনো একজন বালকের ক্রমশ বড় হওয়ার জীবন! পাড়া আর গাঁয়ের মধ্যে আজকাল প্রকৃতিগত তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।

রহু চন্ডালের হাড়।। অভিজিৎ সেন।।

Image
রমজানের নির্দেশে জামির লড়াই করে। পেটে খোরাক জোটে না সবদিন। তরমুজের খেতে কাজ করতো হয় বলে গঞ্জের ঘাটে কুলির কাজে যেতে পারে না। লুবিনির সামান্য রোজগারের উপর নির্ভর করে থাকতে হয়।     তারপর সেইসব জালিতে ফল আসে, ফল ক্রমশ বড়ো হয়। নতুন জালি আসে, ভ্রমর আর মৌমাছি সারা খেতে উড়ে বেড়ায়, প্রজাপতি লতার উপর দোল খায়। তারপর ফলের রঙ সাদা থেকে হালকা সবুজ হয়, তারপরে গাঢ় সবুজ, তারপরে ক্রমে কালো রঙের বৃহৎ আকারের তরমুজ খড়ের বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকে।     এসব দেখে রমজানের মতো জামিরের কলিজা ঠান্ডা হয়, খিদের পোকা আর পেটের ভেতর মোচড় মারে না, অথবা মোচড় মারলেও, আর তেমন করে মালুম হয় না জামিরের।     তারপর চৈত্রের শেষে যখন তরমুজ হাটে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়, তখন তরমুজ খেতের আসল দুশমনেরা এসে হাজির হয়। এরা ধসা রোগ বা কাটাপোকার থেকেও ভয়ঙ্কর। এদের বাগ মানানোর কোনও উপায় রমজানের জানা নেই।     এরা সব শহর ও আশপাশের বাবুঘরের জোয়ান ছেলে। দূরের থেকে তাদের আসতে দেখে রমজান বলে, পতিবার ভাবি আর তরমুজের চাষে যাব না, এতো উৎপাত আর সহ্য হয় না। কিন্তু মন যে মানে না। এতো পরিশ্রমের ফসল, দেখো, এখন কেমন নিজে

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
বাবা নিরু বিশ্বাস তাকে নিজেদের দলের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল। বাবা পরম্পরার কথা বলত। বংশ পরাম্পরায় দলকে ধরে রাখা, চালিয়ে নিয়ে যাওয়া। নিরু বিশ্বাসের পর ছেলে রাফায়েল বিশ্বাস দল ধরে রেখেছে। কিন্তু তারপর? সব শূন্য। রাফায়েল ঘর বাঁধেনি। আর বাঁধবে কবে? বয়স গড়িয়ে বিকেল হয়ে গিয়েছে। যাদবেরও ছেলে নেই যে, তাকে শিখিয়ে কাঁধে দল তুলে দেবে। তার মেয়ে। বড় হয়ে যাবে একদিন। বিয়ে হয়ে যাবে। অন্য সংসারে চলে যাবে। তার হাতে দল দেওয়া মানে কি পরম্পরা রক্ষা করা? জানে না রাফায়েল। তার শ্বশুরবাড়ি যদি মেনে না নেয়? বরং তাকে গানের স্কুলে পাঠালেই ভালো হয়। গান শিখে নিজের মতো গাইতে পারবে। রাফায়েল চলে গেলেও নিরু বিশ্বাসের দলও শেষ হয়ে যাবে। শুধু লোকের মুখে মুখে থাকবে। তারপর একদিন ভুলেও যাবে। মনটা বিষন্ন হয়ে যায় রাফায়েলের। এই বিষন্নতা নিয়েই সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বাড়ির কাছে আসতেই শুনতে পায় হারমোনিয়ামের সুর। অপটু হাতে বাজাচ্ছে কেউ। আরও কাছে, দরজায় দাঁড়িয়ে সে শুনল, যাদবের মেয়ে রুমকি গাইছে কচি কন্ঠে। কিন্তু হারমোনিয়াম? সে চুপিচুপি বাড়ির ভিতর ঢুকল। জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, খাটের উপর হারমোনিয়াম। তার গানের খাতাগুলো পাশে রাখা। তার

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
সব কিছু ঠিকঠাক মিটে গেছে। এমনকী চল্লিশ দিনের কাজও হয়ে গেল। কোথাও কিছু অনিয়ম হয়নি। যাদবের আত্মার শান্তির জন্য গির্জায় মীসা বা যজ্ঞ উৎসর্গ করা হয়েছে। রেবেকার ইচ্ছানুসারে দুপুরে প্রার্থনা সভায় যোগদানকারীদের মাংস-ভাতও খাওয়ানো হয়েছে। রাফায়েল নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নেমন্তন্ন করে এসেছে। যারা কবর দিতে গিয়েছিল, বাড়িতে এসে শেষ দেখা করে গিয়েছে, তা ছাড়াও যারা আসতে পারেনি, তাদের দু-চারজনকেও বলা হয়েছিল। গির্জার পালক পুরোহিত মানে বড় ফাদার চল্লিশ দিনের উপাসনা করেন। মহিলা সমিতির মায়েরা গান প্রার্থনা করে। স্মৃতিচারণও করল কেউ কেউ। রাফায়েলকে বলতে বলা হয়েছিল, বলতে পারল কোথায়? দু-চার কথা বলার পরেই তো সে কেঁদে ফেলল। হয় না, পারা যায় না। যতই হাঁড়ি ভিন্ন করে নিক না কেন, সে তো মায়ের পেটের ভাই। খরচও হলো বিস্তর। সবটাই রাফায়েলকে সামলাতে হয়েছে। জমানো টাকার অনেকটাই খরচ হয়ে গেল। সে হাসে নিজের মনে। খরচ! টাকা জমানো! জমাতে হয়, তাই জমায়। সে মরে গেলে কে নেবে টাকা পয়সা? কে ভোগ করবে এই ঘরবাড়ি? নতুন চিন্তা ছেয়ে গেল তার মাথায়। সত্যিই তো, এতদিন ভাবেনি, আর তো কেউ রইল না, এই একরত্তি মেয়েটা ছাড়া। ওর লেখাপড়া আছে। রেবেকারও খরচ-খরচা আছে

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে রাখা আছে। সাগর এসে বসল, ব্যাগ থেকে ম্যান্ডোলিন বের করে গলায় ঝুলিয়ে নিল। টুংটাং আওয়াজ তুলে বলল, আগে একটা তুলসি দাসীর গান হয়ে যাক। অনেকদিন শুনিনি। হাসে তুলসি, আপনার গান শোনার জন্যেই বসে আছি। আমার গান না হয় পরে হবে খন। দরজার কাছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল বোষ্টমী। ওভাবেই বলল, গা না তুলসি। উনি যখন বলছেন। — হ্যাঁ, গাও, উনার গান তো আছেই। —সুরেন গোঁসাইও দোহার হলো বোষ্টমীর। —কী গাই বলতো! চিন্তিত মনে হলো তুলসিকে। কলকাতার মান্যিগন্যি গাইয়ে, তার সামনে তো আর যে সে গান গাওয়া যায় না। মুশকিল আসান করল সাগর বোস। বলল, পদাবলির একটু অংশ গাও, তাতেই হবে। তোমার গান শুনলে এনার্জি পাবো। হাসে তুলসি। আড় চোখে চেয়ে বলে, মরি আর কী। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে গান ধরল তুলসি— এক কর্ণ বলে আমি কৃষ্ণ নাম শুনিব আরেক কর্ণ বলে আমি বধির হয়ে রব। ও নাম, শুনবো না শুনবো না। নিলাজ বধূর নাম আমি শুনবো না, শুনবো না—আ— আ— শেষের লাইন দুটি তুলসির সঙ্গে সকলে ধরল। সাগর, সুরেন গোঁসাই, গোঁসাইমা সকলেই এখন দোহার। রাফায়েল প্রথমটা বুঝে নিল। পরের  অংশে সেও গলা মেলাল। সাগর মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে উৎসাহ দিল। গান থামতেই সাগর বলে উঠল। বলেছ

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
—মাসি, ঘরে আছো নাকি? নারীকণ্ঠে ডাক শুনেই চোখ মেলল রাফায়েল। দেখল এক যুবতী উঠোনে দাঁড়িয়ে। বয়স মনে হচ্ছে ছাব্বিশ-সাতাশের এপার-ওপারে। মেদহীন হালকা শরীর। লালপাড় বাসন্তী রঙা শাড়ি পরে আছে। গলায় কণ্ঠী। কপালে তিলকের কিছুটা অংশ বোঝা যাচ্ছে, বাকিটা জল আর কাপড়ের ঘষায় উঠে গেছে। ডাক শুনে বোষ্টমী ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তামাক ঘষা দাঁতে হাসি ছড়িয়ে বলল, আরে তুলসি, কবে এলি! —কাল রাতে মাসি। তিন-চারটে বায়না ছিল। আর ভাল্লাগে না। এবার কদিন বিশ্রাম নেবো ভাবছি। আসছে সপ্তাহে আবার কাটোয়ার যেতে হবে। বড়ো আসর আছে। —তা ভালো। বলি, দিনমান যে খেটে মরছ, তা কার জন্যি, নিজের জন্যি একটু ভাব। হাসে তুলসি। দাওয়ায় পা দিতে দিতে বলে, সবই আমার কৃষ্ণমাধবের জন্যি গো। তিনি যেমনি ছোটান তেমনি ছুটি। না হলি, আমার এমন কী আছে যে, লোকে আমার গান শোনার জন্য হামলে পড়বে। কথা বলতে বলতেই চোখ পড়ল রাফায়েলের দিকে। সেও বিস্মিত চোখে তাকিয়ে ছিল তুলসির দিকে। ভাবছিল এই কি সেই কীর্তনীয়া, যার কথা বলেছিল সুরেন গোঁসাই? তুলসির মুখে হাসি, চোখে বিস্ময়। সে গোঁসাইমার দিকে চোখ ফিরিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে, এটা কে গো মাসি? এ যে নদের নিমাই গো। —আর বলিস নে বাপু। এক রাতে তোদের গ

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
  বাইরে উঠোনে যখন মহড়া চলে, ঘরের ভিতর নিরুর চোখে জলে ধারা বয়। পাশে রাখা গামছা দিয়ে মোছে। খুব খুশি হয় সে। কানে আসে রাফায়েলের কণ্ঠ। কতদিন আগের গান, কোথা থেকে যেন পেয়েছিল সে। এখন রাফায়েল গাইছে। বড়দিনের সময় বায়না আছে। এ গান সে গাইবে। নিরু মন দিয়ে শোনে ঠিক ঠিক গাইছে সে। দরদ ঝরিয়ে দিচ্ছে। রাফায়েলের সঙ্গে সে নিজেও নিঃশব্দে গেয়ে চলেছে— উড়াও বিজয় পতাকা জয় যিশু বলে, (আদি) মহোল্লাসে, হেসে, হেসে, সকলে মিলে। বৈৎলেহেমের আকাশে ধর্মসূর্য উঠেছে (তাঁর) জ্যোতির প্রভায় জাগ্রত হয় জ্যোতিষী দলে। পরমপিতা প্রেমময়, পাঠাবেন প্রিয় তনয়, (হবে) মহাশান্তি প্রেমপ্রীতি জগতের তরে। স্বর্গদূতে মিলে গায়, ধন্য ধন্য দয়াময়, (এসো) দূতের সাথে প্রেমে মেতে গাই সকলে। যিশু প্রেম অবতার, যিশু প্রেমে পারাবার (এস) দলাদলি সকল ভূমি শ্রী যিশু বলে, ধন্য ঈশ-নন্দন, পাপ-তাপ-হরণ, (বল) ধন্য যিশু ধন্য যিশু দুই বাহু তুলে। এ গান কি পিতর মল্লিকের কাছ থেকে পেয়েছিল নিরু, নাকি অন্য কোথাও থেকে? হতে পারে কোনও ধর্মসভা থেকে। সে তো বুধবারের সভা বা সেবক সমিতির সভাতেও দল নিয়ে গিয়েছে কতবার। কত বছর ধরে গেয়েছে সে। এখন রাফায়েল গাইছে। এটাই তো পরম্পরা। কার গান খাত

কীর্তনীয়া।। সমরেন্দ্র মণ্ডল।।

Image
সুরেন গোঁসাইয়ের ঘর ছেড়ে তুলসির ঘরে এসে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। এক কামরার বড় ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, পাকা পায়খানা। সবই সে করেছে কীর্তন গেয়ে। ঘরের ভিতর দামি খাট, বিছানা। জমিটুকু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেই ঘেরা পাঁচিলের একদিকে ইটের ভিতের উপর টালির ছাউনির বেড়ার ঘর। এটাই ওর মহড়ার জায়গা। তুলসি ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল। রাফায়েল দেখে, আর ভাবে এটা তো কোনও বোষ্টমীর আশ্রম নয়, এত সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, বাহ্, বাড়িটাতো বেশ! —তোমার পছন্দ নতুন গোঁসাই? এ বাড়ি মনে করলে তোমারও হতে পারে। —আমার হবে কেন? ওর থুতনিতে হাত ছুঁইয়ে তুলসি উত্তর দেয়, এখন তো আর তুমি-আমি ভিন্ন নই। কানে মন্তর পাওনি তো কী হয়েছে? কণ্ঠী বদল নাই বা করলাম, মন বদল করতে কতক্ষণ! রাফায়েল ওর হেঁয়ালি ঠিক বুঝল না। সে চুপ করেই রইল। ঘরে উঠে তুলসি বলল, তুমি স্নান সেরে নাও, নতুন গোঁসাই। দেখ নতুন কাপড় আছে পরে নিও। রাফায়েল উত্তর দেয়, সকালে তো স্নান করে নিয়েছি। —ও। তা হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় পালটে ফেল। সেই শুরু। তারপর থেকে তুলসি ওকে নিজের মতো করেই ভেবে নিয়েছে। দিনের বেলায় বারান্দায় বিছানা করে দিয়েছে। অনেকদিন পর সন্ধ্যেবেলায় জলখাবার! তা

মোগলমারির সখি।। ভাস্কর দাস।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

Image
সুপ্রকাশ প্রকাশিত ভাস্কর দাসের বই 'মোগলমারির  সখি' পড়ে লিখেছেন দিবাকর দাস। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি। . . সখিসোনার আড্ডায় _______________ বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক, ছবি তুলিয়ে, বাচিক শিল্পী, ভ্রামনিক ও সেই সংক্রান্ত লেখায় সিদ্ধহস্ত ভাস্কর দাস (Bhaskar Das ) যখন “মোগলমারির সখি” নিয়ে লেখা বইয়ের কথা ফেসবুকে জানান, আগ্রহ বাড়ে।  সদ্য প্রকাশিত এই বইটি সংগ্রহ করে প্রথমেই আটকে পড়ি এর নির্মাণ সৌকর্যে। প্রচ্ছদের সবুজ অশ্বত্থ চারাটি যেন এক অযুত সম্ভাবনার ঈঙ্গিত….   আমার মতে মোগলমারির সখি এক নিশ্বাসে পড়ার বই না। ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষায় উত্তর লেখার মানে বুকও না। কোনো নীতিমালা শোনাতে তার আগ্রহ নেই। তবে খনন আছে। সময়ের পারত সরিয়ে দেখাতে চাওয়ার আগ্রহ আছে। এই বই সেই সব পাঠকের জন্য যারা এক গল্প আড্ডায় রাত কাবার করতে পারে। তারাই জানে আড্ডার গতি বহু বিভক্ত। মাঝে মাঝে সিগারেটের কাউন্টার বা ফেলে দেওয়া বিড়ির পোঙা আবার ধরিয়ে আড্ডার যুগ যুগ জিও করা পাব্লিকের জন্য এই ছোট্ট বই। আড্ডা যেমন কোনো সিদ্ধান্তে আসে না, সে উপসংহার রহিত। এই ‘শশীসেনার’ কাহিনিও অমিত সম্ভাবনার কথা বল