প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।
নগরীতে প্রবেশের পর হতেই নগরীর প্রধান মাগগটি নজরে আসছে। তার দুইপাশে তরুশ্রেণী। গগনমার্গে তরুশীর্ষগুলি দুইপাশ হতে পরস্পর লগ্ন হয়ে ছত্তক-ব্যূহ রচনা করেছে।
মহামাগগ বা প্রধান সড়কটি প্রস্তরফলক দ্বারা আবৃত।
ভিক্ষুদল মহামাগগ ধরে অগ্রসর হলেন।
আশ্চর্য! কোনো নগরজন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
প্রভাতকাল।
মাগগপার্শ্বে সম্পদশালীজনেদের গৃহউদ্যান। সুপ্রশস্ত এই উদ্যানকে গৃহবনানীই বলা যায়। প্রথমে সুদৃশ্য পুষ্পবীথিকা, তার পর শ্রেণীবদ্ধ বিবিধ ফলতরু। সেই তরুশাখার মধ্যে দিয়ে প্রস্তর ও ইষ্টকনির্মিত গৃহগুলি দৃশ্যমান। অধিকাংশই প্রাসাদাকার, অলঙ্কৃত। সর্বাগ্রে নজরে আসে গৃহদ্বারের শীর্ষদেশের বিচিত্র ফুলকারী নকশার অলংকরণ এবং গেহদ্বারে দারুতক্ষণের কাজ। বহির্দ্ধারের স্তম্ভগুলিও ফুলকারি নকশায় সজ্জিত। গবাক্ষ ও বাতায়নের সারি।
এই প্রভাতে সেসবই বন্ধ। এতটা প্রভাত তো নয়। বালার্ক দেখা দিয়েছে অনেকক্ষণ!
প্রভাত বলেই কি কোথাও কোনো মানুষজন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না?
এই নিজন নীরবতা তো হিরন্ময় নয়!
ইতোমধ্যেই ভিক্ষুরা একটিমাত্র বস্ত্রখণ্ডে গ্রন্থি দিয়ে প্রস্তুত তাঁদের 'স্কন্ধ-পসিব্বক' থেকে 'ভিক্ষাভাজন' বের করে দক্ষিণহস্তে তা ধারণ করেছেন। কিন্তু যাচনা করার মতো একটি গৃহ, একটি পণ্যাগারের দ্বার বা গবাক্ষ উন্মুক্ত নেই, পথে নেই একটিও জনপ্রাণী!
দীপ্তঙ্কর ও অন্যান্য ভিক্ষুদের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল কিছু একটা গোলমালের গন্ধ পেলেন তাঁরা!
অবশেষে পঞ্চক্ষণ পদচারণার পর পথিপার্শ্বের শ্বেতচম্পকের বৃক্ষ হতে 'দন্ডাঙ্কুশ' দ্বারা পুষ্পচয়নরত এক প্রৌঢ়ার দেখা মিলল।
ভিক্ষুদলকে দেখতে পেয়ে সভয়ে তিনি বললেন— 'তোমরা কোথা থেকে আসছ বাছারা! এই কি পথপরিক্রমার সময়! শিগগির কোথাও, কোনো গৃহে, কোনো মন্দিরে বা উপাসনাগেহে আশ্রয় নাও। তোমরা ভিক্ষুদল নাকি তীর্থঙ্করের দল? তীর্থিক হলে নগরীর উত্তরের খুদ্দনগোপরি সদ্দরানাথে চলে যাও, আর বুদ্ধভিক্ষুদল, হলে পচ্চিমপাকারের বিহারে গিয়ে আছ্রয় নাও!'
একসঙ্গে এতগুলি প্রশ্ন, এতগুলি বাক্যে দীপ্তঙ্কর একটু অসহায় বোধ করলেন। এটুকু বুঝলেন যে, তাঁদের নিরাপত্তা বিষয়ে এই প্রৌঢ়া এতটাই ব্যগ্র যে, আতঙ্কের কারণ বলার পূর্বেই তিনি এই তরুণ-দীপ্র সন্ন্যাসীদলকে কোনোভাবে লুকিয়ে ফেলতে পারলে পারলে বাঁচেন। দীপ্তঙ্কর বিনীত স্বরে বললেন—'মা, আমরা বুদ্ধ-শ্রাবক, বিদেশী সন্ন্যাসী, বহুদূর হতে এই নয়নাভিরাম উদয়নগরী দর্শন করতে এসেছি।'
'মা' ডাকে স্পষ্টই এই চির-জননী আপ্লুত বোধ করলেন— 'হায় রে বাছারা! মা যখন কয়েছ, তখন বলি—এই কি তোমাদের দেশ ঘোরার সোমায়? মোদের সেই উদয়নগর কী আর আছে? হেথায় ছেলে মারতে চায় বাপকে! বাপকে মারার জন্য বাইরের শত্তুরদের ডেকে নিয়ে আসে! হায় রে, হেথায় লুনের দাম ভুলে রক্ষীরা হাত মেলায় সেই কুপুত্তুরের সঙ্গে! কিন্তুক তোমরা আর দেরি কোরো না বাপু। বিহারে-মঠে যেখানে পারো যাও দিকি, আছ্রয় নাও!'
বলেই তিনি দক্ষিণ হস্ত তুলে পশ্চিম দিক নির্দেশ করলেন—সম্ভবত ঐ দিকেই উদয়নগরীবিহার। প্রৌঢ়া আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোথা হতে একটি মুশকো, অভিজাত ও পণ্ডরোবর্ণের অনতিযুবার আবির্ভাব ঘটল। নিশ্চিতভাবেই এই প্রৌঢ়ার ছেলে। সে কোথা থেকে এল তা দীপ্তঙ্করেরা ঠাওর পেলেন না। কিন্তু সে এসেই মায়ের হাত ধরে টান দিল, কর্কশ স্বরে বলল—'আজ যে ঘর হতে বের হতে মানা করা হয়েছে! কাদের সঙ্গে কী কথা বলছ মা! আজ ফুল তোলার দরকার কী! চলো চলো।'
প্রৌঢ়াও চেঁচালেন— 'মানা! কার মানা! কীসের মানা! মানা মানে কী! আমার ঘর হতে আমি বেরুবো, ফুল তুলব, তাতে আবার মানা! মানব কেন সে মানা! আমি কী কাঁড়িমণ ট্যাকা চেয়িচি কারো কাছে, নাকি সিংআসন চেয়িচি!'
মুশকো মায়ের কোনো কথার উত্তর দিল না, তরুবেদীতে রাখা পুষ্প-করণ্ডো তুলে নিয়ে দন্ডাঙ্কুশ ধরা মায়ের দক্ষিণহস্ত সবলে পাকড়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল। শুধু যাবার আগে রোষকশায়িত নেত্রে একবার ভিক্ষুদলের দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলল—'কাজ নেই কম্ম নেই, সক্কালবেলা বাটি হাতে বেরিয়ে পড়েছে!'
মুহূর্তের মধ্যে মুশকো তার মাকে নিয়ে নিকটবর্তী দুটিগৃহের মধ্যবর্তী পথ দিয়ে চক্ষুর অন্তরালে মিলিয়ে গেল।
শুরুতেই এমন অভ্যর্থনায় বিমূঢ় ভিক্ষুদল প্রভাত আলোয়, সাদা চম্পকের ঔজ্জ্বল্যপ্লাবিত নগরপন্থের একপার্শ্বে দাঁড়িয়ে রইলেন।
......................................................
প্রতিযাত্রা
দুর্লভ সূত্রধর
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৪৮০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment