লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।
লেটারপ্রেসের এই অনিবার্য পরাজয় কিংবা নতুন প্রযুক্তির এই জয়—এবং নতুন ক্ষেত্রিয়-পুঁজির এই আস্ফালন কোনো অদূর ভবিষ্যতে মানব-অধ্যুষিত সভ্যতার পরাজয় বলে গণ্য হবে কিনা, এই দ্রুত পরিবর্তন ভালো কি মন্দ, উচিত কি অনুচিত—ভারত তথা প্রাচ্যের ঘাতসহ ঐতিহ্যের সঙ্গে একঝোঁকা, বেতালা এই পরিবর্তন আদৌ মানানসই কিনা—তা ভাববার জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত দেওয়ার লোকের অভাব তো নেই। কিন্তু নতুন প্রযুক্তি, অনাবশ্যক দ্রুতির সঙ্গে শুধুমাত্র 'পুঞ্জি আর প্রবঞ্চনা'র জন্য বাহ্যত অকারণে প্রযুক্তির নিত্যি হাল-হকিকৎ বদলে ফেলায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাঁদের নিয়ে বলবার লোক কমে যাওয়াটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের।
আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বুঝতে পেরেই দুঃখ ঝেড়ে ফেলতে পেরেছিল ছোড়দি। স্ক্রিন-প্রিন্টিংয়ের মতো ডেস্কটপও শিখে নিয়েছিল ছোড়দি। শুধু একটাই আক্ষেপ ছিল তার—সুবলবাবু, অমর প্রধান, বিমলবাবু, পঞ্চাদা, ভূপালবাবুরা বোধহয় চিরতরে হারিয়ে গেলেন। হারিয়ে গেল প্রেস থেকে প্রেসে সকাল-সন্ধ্যায় কত কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের সমাবেশ, পত্র-পত্রিকা-বই-ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার চেষ্টায় সংশ্লিষ্টজনেদের অন্তহীন শ্রমের, আকুতির উষ্ণ-কম্পনের দিনলিপি। হারিয়ে গেল মত ও পথের দ্বন্দ্বে সংক্ষুব্ধ সাহিত্যকর্মীদের তর্ক-বিতর্ক, বিরোধ-সহমতের স্পন্দিত ঊর্মি-তরঙ্গে উত্তাল অস্থির সময়ের কথা, হারিয়ে গেল কত মহার্ঘ সন্ধ্যা, কত আবেগী মুহূর্তের বিরল লিপিমালা।
'কম্পোজিটর' শব্দটি অবশ্য পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেল না।
নতুন যন্ত্র-নামের আড়ালে বা ডেস্কটপ অপারেটরের বেশে সে সংখ্যালঘু হয়ে আত্মরক্ষা করল সিসার চলমান টাইপের বদলে বোতাম-টেপা অক্ষরের বিন্যাসে—যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার অন্তরালে একদল বিচিত্রকর্মা মানুষের প্রতিটি কর্মদিবসের রোমহর্ষক অভিযান-স্পন্দিত অন্তরাত্মা বহুলাংশে অচিরকালের মধ্যেই সমাধিত হলো।
এর অনিবার্যতা যতটা সত্যি এটাও ততটাই সত্যি যে, পুরোনো কালের প্রতি ইতিহাসের এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক, উদাসীন অবহেলা এবং অকৃতজ্ঞতা আছে। এবং তার ফলে মানবিক বিপর্যয়ও ইতিহাসের পর্ব-পর্বান্তরে আমাদের যাপনে বিষণ্ণতার স্পর্শ রেখে গেছে।
তবু লেটার প্রিন্টিংপ্রেসের সেই দিনগুলি—কবিতা করে একদা যাকে বলা যেত 'নির্জনতার আনন্দে মোড়ানো' আধো-আলোকিত চৈতন্যময় অক্ষরের জগৎ—'সময়ের ঘন কুয়াশায় ঢাকা' অন্তর্জীবনের সেই দূরবর্তী, সুবাসিত নিঃসঙ্গতার আনন্দ—এসব তো মিথ্যে হয়ে যায় না।
আমাদের বড়ো জ্যাঠামশাই ছিলেন সেই অন্তর্জীবনের নিঃসঙ্গপ্রায় পথিক। আর্থিক অসম্পন্নতা যাঁর আত্মবোধের সুরক্ষাবলয় ভেদ করতে পারেনি, সম্মান আর লাঞ্ছনাকে তিনি একই সঙ্গে অতিক্রম করেছিলেন। তাঁর সেই ইতিহাসসম্ভব কথাটাও তেমনি মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না।
কেননা ইতিহাসের দৃষ্টিতে এটাও সত্যি যে, আপাত বৈভবের হাতছানিতেও কাঙাল হরিনাথের নাতিপুতিরা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, পৃথিবী নামক এই গ্রহটিরই কোথাও-না-কোথাও তারা অন্যতর অঙ্গীকারে জেগে আছে।
...................................................
লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা
অনন্ত জানা
....................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : ২৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment