চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে।। অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য।। সুপ্রকাশ।। পাঠপ্রতিক্রিয়া।।

সুপ্রকাশ প্রকাশিত অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্যের বই 'চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে (পরিবেশ সম্পর্কিত আক্রমণ-হত্যা : ইতিহাস-বর্তমান)' পড়ে লিখছেন পিয়াল রায়। আমরা তাঁর অনুমতি নিয়ে নিজেদের টাইমলাইন থেকে শেয়ার করছি।
.....................................................

চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে
(পরিবেশ সম্পর্কিত আক্রমণ-হত্যা : ইতিহাস-বর্তমান) 
অনির্বাণ সিসিফাস ভট্টাচার্য 
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
মুদ্রিত মূল্য : ৩৯০ টাকা

ফেসবুকের জমানা এসে একটা লাভ হয়েছে যে কোনো বইয়ের খবর বেশ চটজলদি পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় সুপ্রকাশের স্টল থেকে অবশেষে বইটি হাতে আসে। 

কেন বিশেষ এই বইটি সংগ্রহের জন্য আমি এতটা উতলা হয়েছিলাম সে প্রসঙ্গে বলতে গেলে বইটির বিষয় অভিনবত্বের কথাই বলতে হয়। আমার পক্ষে বইয়ের বিষয় এত বেশি নতুন ছিল যে পড়ে দেখার লোভ সংবরণ করা সম্ভব হয়নি এবং পড়ার পর বুঝেছি এই সময়ে দাঁড়িয়ে  বইটি পড়া কতখানি জরুরি। এই সময় বলতে আমি বোঝাতে চাইছি গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক এবং বাজার অর্থনৈতিক কারণে যে বিরাট পাওয়ার শিফটিংএর খেলা চলছে তার কথা। বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের কারণে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং ইসরায়েল-হামাস সংঘর্ষ আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এই সংঘাতগুলির সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলমান থাকলেও, স্থায়ী সমাধান এখনও অনিশ্চিত। 
আমেরিকা এখনও পর্যন্ত বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার প্রভাব কিছুটা কমতে দেখা যাচ্ছে , বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে।
মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করলেও রাশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সামরিক ক্ষমতা একে পুরোপুরি দুর্বল হতে দিচ্ছে না। অতি সম্প্রতি আমেরিকা, রাশিয়ার হাত মেলানোয়  বিশ্ব রাজনীতিকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অপরদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিক শক্তি হলেও রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এখনও আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের পর ইউরোপ শক্তিশালী প্রতিরক্ষা নীতি গ্রহণ করছে। জার্মানি ও ফ্রান্স নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে, তবে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও অভিবাসন সংকট তাদের একত্রিত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। আবার চীনও যেভাবে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে তাতে তাকে পরবর্তী সুপার পাওয়ার হওয়া থেকে বিরত করা না-মুমকিন হয়ে উঠছে। মোটের ওপর আপাতত এটুকু অন্তত আন্দাজ করা যাচ্ছে যে ভবিষ্যৎ এককভাবে কোনো একটি দেশের হাতে যাবে না। বরং, মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যেখানে চীন, আমেরিকা, ইউরোপ এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতিই অবলম্বন করা হবে। এখন এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার মতো প্রয়োজনীয় কাজটি করবে কে? 

রীতিমতো গবেষণাধর্মী এই বই। লেখকের বহু বছরের শ্রম নজরে পড়ে যখন দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিবেশকর্মীদের ওপর নেমে আসা বর্বরতার তিনি প্রমানসহ দলিল উপস্থিত করেন। বনভূমি রক্ষার আন্দোলনে জড়িত পরিবেশ কর্মীদের ওপর প্রায়ই হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এই হামলাগুলি প্রায়শই অবৈধ লগিং, খনিজ উত্তোলন এবং কৃষি ব্যবসার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা চালায়। অনেক ক্ষেত্রে, স্থানীয় সরকার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি এই হামলাগুলি প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয় বা এমনকি জড়িত থাকে। ইতিহাস ঘেঁটে বিশেষ কিছু রাষ্ট্র-ভিত্তিক আক্রমণের ইতিহাস ও সাম্প্রতিকতার অন্বেষণ, সেইসমস্ত দেশে যেখানে সরকার নিজে পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর নয়, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা তলানিতে,যেখানে দুর্নীতির লেখচিত্র ক্রমশ ওপরের দিকে, যেখানে আইনের শাসন খুবই সামান্য, বিচারব্যবস্থা ধুঁকছে। পরিবেশ-সচেতনতার ঠাণ্ডা ঘরের ঢক্কানিনাদের ভেতর সেইসমস্ত শরীরগুলো শণাক্ত করেছেন লেখক, যাঁরা এই অসম লড়াইয়ে ভেসে গেছেন। সেখানে আদিবাসী শিশু-তরুণ-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে রেঞ্জার বা বনকর্মী বা নির্ভীক সরকারি আধিকারিক কে নেই? পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাঁদের লড়াই পোচিং, অবৈধ গাছ কাটা বা বালি-উত্তোলন নিয়ে, আক্রমণ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হত্যার শিকার এঁরা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল অতিরিক্ত নির্ভীকতা বা আপসহীনতার জন্য সরকারি পদ বা কাজ হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে চলা। এমনকি রেহাই পান না পরিবেশ-সংক্রান্ত খবরে নিযুক্ত সাংবাদিকেরাও। মেক্সিকোর গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল পুরস্কার বিজয়ী ইসিদ্রো বালদিনেগ্রো সহ একই পরিবারের তিনজনকে যখন বিভিন্ন সময়ে শুধু পরিবেশ সংক্রান্ত লড়াইতেই পৃথিবীর মায়া কাটাতে হয় তখন এর চেয়ে অবাক করা ঘটনা আর কিছু থাকতে পারে বলে মনে হয় না। গোটা বইটিই এমনই নানা তথ্যে সমৃদ্ধ যে খবর আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে এসে পৌঁছয় না কোনোদিন। যে পাঠক পরিবেশ সচেতন তাঁর কাছে বইটি একটি অবশ্যপাঠ্য বই হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি তাঁদেরও পড়তে বলব যাঁরা পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখাটা যে কত জরুরি সেটা বোঝেন অথচ জানেন না এটা করতে গিয়েও কত মানুষ আত্মবলিদান 
দিয়ে চলেছেন অহর্নিশ। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বিশ্ব-উষ্ণায়নের আলোচনায় লেখকের কোনো উৎসাহ যে নেই  এক বিশ্বস্ত দলিল এই বই। 

বইয়ের ভাষা অত্যন্ত সহজ। আমার মতো সামান্য পাঠকেরও বুঝতে অসুবিধে হয় না এর অন্তর্গত নির্যাস। অথেনটিক তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ার কারণে প্রতিটি বর্ণনাই সত্যের আধার হয়ে উঠেছে। বিশনোই-গণহত্যা, কম্বোডিয়া -থাইল্যান্ড, মায়ানমার-ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, আফ্রিকা,নাইজিরিয়া, মেক্সিকো সর্বত্রই দেখি রক্তহীম করে দেওয়া সব ঘটনা। 'ইউনাইটেড নেশনস ডিক্লেরেশন অন দ্য রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস' এর ১০ নম্বর ধারার প্রকাশ্য অবমাননায় আদিবাসী -রাষ্ট্র সংঘর্ষ বা তার রেশ ধরে তাদের ওপর নেমে আসা আক্রমন ও হত্যা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। যেহেতু 'পশুসুলভ' আদিবাসীদের ভেতর 'উন্নয়ন' ঘটিয়ে তাঁদের বাইরের পৃথিবীর মূল 'মনুষ্যস্রোতে' মিশিয়ে দেওয়ার হিতকর প্রচেষ্টাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য সেহেতু নির্বিচারে এঁদের ওপর আক্রমণ তথা হত্যার অস্ত্র শানানো কোন যুক্তিতে মেনে নেওয়া চলে? অথচ রাষ্ট্র এসব ব্যাপারে আশ্চর্য উদাসীন। জল, মাটি, বৃক্ষই  যাদের বড় করে তুলেছে তাদেরই কিনা ঘর বাঁচাতে লড়তে হচ্ছে! ব্রাজিলের উইলসন পিনেইরো, চিকো মেন্ডিস কিংবা ফিলিপিন্সের বাঁধ-বিরোধী বুটবুট আদিবাসী পরিবেশকর্মী ম্যাকলিং ডুলাগ একাধিক পরিবেশ সংক্রান্ত হত্যার সাক্ষী হয়ে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। 

বিশেষভাবে যা বলার তা হল বইতে ব্যবহৃত ছবিগুলো। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাওয়া মানুষের বুক যে কত চওড়া হতে পারে, কত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে পারে তাদের চোয়াল ছবিগুলো না দেখলে জানা যেত না। ছবিগুলো তাই জরুরি ছিল। যেমন ধরা যাক মেক্সিকোর টমাস রোহো, ইরমা গ্যালিন্দো ব্যারিওজ, ইসিদ্রো বালদেনেগ্রো,গুয়াতেমালার মেরিলিন টোপাসিও, পরিবেশকর্মী সিস্টার ডরোথি স্ট্যাং, আরি উরু এউ ওয়াউ ওয়াউ অথবা লুইজ আলবার্তো আরাউজো কত নাম করবো? প্রত্যেকের চোখেই এক অনিবর্চনীয় আলোর ফুটে ওঠার সাক্ষী এই ছবিগুলো। 

বইয়ের প্রচ্ছদ ভাবনা চমৎকার। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা আজকের শিশু। আমাদেরই দায়িত্ব ওদের জন্য এক নিরাপদ, নিরুপদ্রব পৃথিবী রেখে যাওয়া। যেখানে বেমক্কা লোপাট হয়ে যায় না মেহগনি -রেডউড, নদীর বয়ে চলা স্বর, মানুষ, চারপেয়ে। বরং বেঁচে থাকার ভিতর আক্রমণ ও হত্যা বলে পৃথিবীতে কিছু থাকবে না এমন পৃথিবী আমরা ওদের উপহার দিতে পারি। যে বিষয়টা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হল শিরোনামে 'পথ' শব্দকে বিশেষ ভাবে লাল রঙে দেখানো। এ রঙ রক্তের রঙ, এ রঙ হত্যার রঙ। আবার এ রঙ বিদ্রোহেরও রঙ, বিপ্লবেরও রঙ। আমরা এর বিকল্প রঙ খুঁজে নিতে চাই। 'পথ' যেন আর কখনই রক্ত রঞ্জিত না হয়। বইটির প্রকাশক 'সুপ্রকাশ' পাবলিশারকে ধন্যবাদ এমন অসামান্য বই উপহার দেওয়ার জন্য৷ এর ঝকঝকে উপস্থাপন পাঠককে মুগ্ধ করবে সন্দেহ নেই। পরিশেষে একটা কথা বলার যে, 'চেতনার পথ জুড়ে শুয়ে আছে' যে সমস্ত মানুষের বলিদানে সমৃদ্ধ তাঁদের শক্তিতে নতুন করে বেঁচে উঠুক এক নির্মল পৃথিবী। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ অনেক কঠিন অজানাকে পাঠকের সামনে পাঠযোগ্য করে সহজসরল ভাষায় পরিবেশন করার জন্য।

          

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।