অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
মনে পড়ে, ‘ধর্ম’ অর্থাৎ ‘যা ধারণ করে’— বাড়ি ফেরার শেষ লোকাল ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে কপাল থেকে এলোমেলো চুল সরাতে সরাতে কথাটা বলেছিল একজন। পুঞ্চা বাজারে যাওয়া মানেই, চরণপাহাড়ি কালীমন্দির থেকেও ঘুরে আসা একবার। পুঞ্চা থেকে মানবাজার যেতে ডানদিকের একটা রাস্তা দিয়ে ঢুকে গেলেই, চরণপাহাড়ি কালীমন্দির। তার থেকে খানিকটা এগিয়ে গেলেই পুঞ্চা ব্লক হসপিটাল। মন্দিরটা একটা উঁচু টিলা মতো জায়গার উপরে। বেশ কয়েকটা সিঁড়ি পার হয়ে উপরে ওঠার পর মন্দিরের চাতাল। স্নিগ্ধ রূপের মা কালীর মূর্তি মন্দিরের মধ্যে। পাশেই আর একটা আলাদা মন্দিরে স্থাপিত শিবলিঙ্গ। সন্ধেবেলা শাঁখ, কাঁসর, ঘন্টা আর মন্ত্রপাঠের শব্দে জমজমাট মন্দির চত্বর। পুজো হয়ে গেলে, মাথা বাড়িয়ে নিয়ে নেওয়া শান্তির জল। দূরে দাঁড়িয়ে প্রণাম করি আমিও। প্রণাম করতে করতেই দেখি, সহজ-সাধারণ গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন মন্দিরের পুরোহিত ঠাকুর। পরবর্তীকালে দু-একবার গল্পও হয় বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। কথা বলতে বলতেই খানিকটা ঠাহর করা যায় বয়স্ক মানুষটার ভিতরে জেগে থাকা আধুনিক মনটার। একবার জিজ্ঞেসও করে ফেলি, মেয়েদের আঠেরো আর ছেলেদের একুশ বছরের নিচে তো বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ; কিন্তু কেউ যদি মন্দিরে এসে বিয়ে করতে চায়, তখন কী করেন তিনি? খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই উত্তর আসে, “বার্থ সার্টিফিকেট না দেখাতে পারলে বিয়ে দিই না। কিন্তু অনেকে ঝাড়খন্ড চলে যায়।” পুজোর পরে গিয়ে দাঁড়াই মন্দিরের পিছনের দিকটায়। খাড়াই খাদ নেমে গেছে নিচের দিকে। সেখানে দাঁড়িয়েই ভীষণ আশ্চর্যের সেই কথাটা কথা বলেছিল একদিন অঞ্জনদা।
এই মন্দিরটা কীভাবে তৈরি হয়েছিল, জানো সেই গল্পটা?
না তো!
চলো তোমাকে দেখাচ্ছি।
মন্দিরের চাতালে পেতে রাখা একটা ফলকে মন্দির প্রতিষ্ঠাতার নাম। শ্রী জিটি লতিফ। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, “মুসলিম নাকি?” উত্তরে ভেসে আসে মন ভাল করা একটা গল্প।
স্থানীয় পুঞ্চা থানার একসময়কার ওসি ছিলেন মুসলিম এই ভদ্রলোক। জিটি লতিফ। শোনা যায়, একদিন রাতের বেলা স্বপ্নে তাঁকে দেখা দিয়েছিলেন মহামায়া মা কালী স্বয়ং। পরেরদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে তিনি অজান্তেই পৌঁছে যান স্থানীয় একটা ছোট টিলার মাথায়। সম্ভবত সেখানে তখন তাঁবু ফেলেছিল একটা মিলিটারি ক্যাম্প। এবং সেই ক্যাম্পের কুচকাওয়াজ, হইহল্লার মধ্যেই নাকি তিনি সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে দেখতে পেয়েছিলেন একটা কালো পাথরের উপর মহামায়ার পায়ের ছাপ। তখনই খবর দেওয়া হয় আশেপাশের গ্রামের মানুষদেরকে। এসে হাজির হয় সমস্ত জাতেরই মানুষজন, এবং সকলের মিলিত সিদ্ধান্তেই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ওই টিলার উপর।
…..........................................
Comments
Post a Comment