নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
‘খবর পাকা লেফটেন্যান্ট স্যার। খাঁড়ির কাছে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপ নোঙর ফেলে আছে। এইমাত্র ওদিক থেকে আসা একটা পণ্যবাহী স্লুপের কাছ থেকে জানা গেছে।’
বোস্প্রিটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন রবার্ট মেইনয়ার্ড। বিষয়টা তাঁর অজানা ছিল না। নেটিভ আমেরিকানদের প্রতি তাঁর তেমন ছুঁৎমার্গ নেই। পিটারের মতো ভীষণ খোলামেলা না হলেও, স্থানীয় উপজাতিদের প্রতি তাঁরও সমবেদনা কাজ করে। ওক্রেকোক খাঁড়িতে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের থাকার খবর তাদেরই মুখ ফেরতা মেইনয়ার্ডের কাছে পৌঁছেছিল। ক্যাপ্টেন ব্র্যান্ড যখন তাঁর বিরাট ফুল রিগ সহ লাইম নৌবহর নিয়ে বাহামা অভিমুখে যাত্রা করেছেন, লেফটেন্যান্ট তখন উত্তর ক্যারোলাইনার উপকূল ঘেঁষে দক্ষিণে। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গ্রিফিনের কথায় মাথা নেড়ে তিনি বললেন, ‘খেয়াল রেখ, আমাদের পাশ কাটিয়ে ওদিকে কোনো বণিকপোত যেন যাওয়ার সুযোগ না পায়। পার্লের আসার সংবাদ ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছে পৌঁছে গেলে, হয়তো তার আর নাগাল পাওয়া যাবে না।’
‘রাখা হচ্ছে স্যার। গত দু-দিন একটা জাহাজকেও ওদিকে যেতে দেওয়া হয়নি।’
‘ভালো। বেশ ভালো।’
বলেই উচ্চস্বরে নির্দেশ দিলেন সমরাধিনায়ক, ‘ফুল স্পিড। মাস্তুলের পতাকা বদলে দাও। শয়তানটা যেন দূর থেকে দেখে ক্রাউনের ফ্ল্যাগশিপকে চিনতে পারে।’
বলেই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গ্রিফিনকে নির্দেশ দিলেন, ‘আমাদের দ্বিতীয় জাহাজেও খবর পাঠাও গ্রিফিন। প্রস্তুত থাকতে বলে দাও ওদের। সময় ঘনিয়ে এসেছে।’
ঘণ্টাখানেক পরেই খাঁড়ির মুখে রিভেঞ্জকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। যেন শান্ত-সুবোধ বালক জলবিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। লেফটেন্যান্ট মেইনয়ার্ডের নির্দেশ মোতাবেক বন্দুকধারীদের একটা দল ডেকের প্রান্তভাগে সার বেঁধে পজিশন নিয়ে বসে রয়েছে। বাকিরা নিচের ডেকে। প্রস্তুত তারাও। পার্লের দুটো জাহাজ দু’দিক থেকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। ধীরে, কিন্তু অবিচলিতভাবে। আরও কিছুটা এগোতেই দূরপাল্লার কামানগুলো গর্জে উঠল। লেফটেন্যান্ট মেইনয়ার্ড বুঝতে পারলেন শান্ত বালকের ঘুম ভেঙেছে। দূরত্বের কারণে গোলাগুলো অর্ধেক পথ এসে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ল।
‘ওরা টের পেয়েছে। জাহাজ নড়ে উঠেছে। দ্রুত কাছাকাছি পৌঁছাতে হবে। আরও দ্রুত।’
বোস্প্রিটের সঙ্গে টান দিয়ে রাখা পালের দড়িটা ধরে সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন লেফটেন্যান্ট। ঘুরে চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন তিনি।
‘সর্বোচ্চ গতিতেই যাচ্ছি স্যার।’
হুইলের পেছন থেকে সাড়া দিল পাইলট। হবে না, এই গতিতে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের ফ্ল্যাগশিপকে পেছনে ফেলা যাবে না। অথচ না গেলে বিপক্ষের কামানের আঘাতে শুরু আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারে।
‘এই তোমরা, জাহাজে ভারী যা কিছু সব জলে ফেলে দাও। ওই পানীয়ের পিপেগুলোকেও। হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন মুর্খের দল? তাড়াতাড়ি।’
ভারী লোহার পেটিকা, শুধু ওয়াইন নয়, খাবার জলের পিপেগুলোকেও জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হলো। শরীর খানিকটা হালকা হতেই সামুদ্রিক শুশুকের মতো ছুটতে শুরু করল লেফটেন্যান্ট মেইনয়ার্ডের জাহাজ।
দ্রুত আগুয়ান জাহাজকে লক্ষ্য আবার ব্রডসাইড ফায়ার করল মাস্টার গানার ফিলিপ মর্টন। একে তো গান ডেকে কামানের সংখ্যার চেয়ে, তাতে গোলা ভরার লোক কম। রিলোডে সময় লাগছে অনেক বেশি। তায় আবার গতির কারণে লক্ষ্য স্থির রাখা দায় হয়ে পড়ছে। তামাকের দলা মুখ থেকে ফেলে বিরক্তি ভরে বলে উঠল সে, ‘চুলোয় যা বেজন্মার দল। এই তোরা ওদিকের কামানগুলোর পেটে গোলা ভর। দ্রুত।’
স্পার ডেকে অনেকদিন পরে জাহাজের হুইল এডওয়ার্ডের হাতে। চেনা শিহরণ খেলে যাচ্ছে তার শরীর জুড়ে। খাঁড়ির মুখ থেকে ডানদিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দিল সে। একটু দূরে জাহাজের ডান প্রান্তে র্যাট লাইন ধরে ঝুলছিল রবার্টস এবং আরও দু’জন। ঝুলন্ত অবস্থাতেই আগুয়ান জাহাজকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। জাহাজ প্রায় পুরোপুরি ডানদিকে ঘুরে যেতেই আক্রমণকারীদের অন্য জাহাজটাকে নাগালে পেয়ে গর্জে উঠল গান ডেকের চার খানা কামান।
‘সাবাস ফিলিপ। ঝাঁঝরা করে দিয়েছ হে।’ সোল্লাশে চিৎকার করে উঠল কারপেন্টার ওয়েন রবার্টস।
.......................................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
.......................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment