অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

কিন্তু আরও একটু গভীরে যেতে হবে। গভীরে যাওয়া মানে, পৌঁছাতে চাওয়া উৎসবের দর্শনটার কাছাকাছি। খোঁজ পাওয়া গেল ‘মিলন আখড়া’র। যেতে হবে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরের গ্রামে। গ্রামের নাম, জামবাদ। ‘মিলন আখড়া’র প্রাণপুরুষ প্রৌঢ় সৃষ্টিধর মাহাতো। মানভূমের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলো প্রাণপণে ধরে রাখতে চাইছেন তারা। সৃষ্টিধর বাবুকে একজন স্কলার বললেও, কমই বলা হয় বরং একটু।

শাল গাছ দিয়ে ঘেরা জংলা মতো একটা জায়গায় বসে কতক্ষণ যে কথা হয়েই চলে, হিসেব থাকে না কোনও। মাঝে একবার রেকর্ডারের ব্যাটারিও বদলাতে হলে, সেই সুযোগে ঢলতে শুরু করা বিকেলের আলোর দিকে তাকান বয়স্ক মানুষটা। শালগাছে ঘেরা একটা জায়গা। আচমকা অন্যমনস্কতা পেয়ে বসে। ছড়া কাটতে শুরু করেন তিনি। ছড়া কেটে কেটে বুঝিয়ে দিতে থাকেন, সত্ত্বঃ তমঃ আর রজঃ গুণের সামঞ্জস্য। বুঝিয়ে দিতে থাকেন ‘মাঝের পথ’ ধরে চলা আসলে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ‘এক সড়পে দু সড়পে তিন সড়পে লোক চলে / আমার টুসু মাঝে চলে, বিন বাতাসে গা দোলে’। এতই সূক্ষ্ম, নমনীয় দেবীর চরিত্র! জিজ্ঞেস করি আবার, এখানকার সব উৎসব বা পরবই তো ধানকাটার সময় মেনেই হয়। এটাও সেরকম কোনও কারণে কি? উত্তর দিলেন কেটে কেটে।

“মকরের দিনে টুসুর ভাসান হয়। কারণ, সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর একটা যোগ আছে। সূর্য এবং পৃথিবীর মিলন না হলে, কোনো শস্য হবে না। এই মকরের দিন থেকে সূর্য দক্ষিণায়নে চলে যায়; মানে মকররেখা ছেড়ে চলে যায় কর্কটক্রান্তিতে। আমাদের এই এলাকাতে যত লৌকিক উৎসব আছে, সবই ফসল তোলা আর ফসল কাটা, এগুলোকে সামনে রেখেই হয়। টুসুটাও সেরকম আমন ধান ঘরে তোলার উৎসব। কিন্তু এখানে বড় ব্যাপার হল, বীজ থেকে যে অঙ্কুর হয় সেটা তো এমনি এমনি হবে না। তার জন্য জল লাগবে, মাটি লাগবে, তাপ লাগবে, বাতাস লাগবে। সেই জন্যই ক্ষিতি অপ তেজ মরুৎ ব্যোম— এর সম্মিলিত শক্তিতে বীজ থেকে অঙ্কুর হওয়া, অঙ্কুর থেকে চারাগাছ হওয়া, চারাগাছ থেকে বৃক্ষ হওয়া বা বৃক্ষের থেকে ফল-ফুল হওয়া। এই যে সৃজনীশক্তি, সেটাই হল আমাদের টুসুর মাহাত্ম্য।”

এই ভীষণ প্রত্যন্ত একটা এলাকাতে, এত প্রৌঢ় একজন মানুষের থেকে এইরকম বিজ্ঞানমুখী উত্তর যে পাওয়া যেতে পারে, ভাবনাতে আনাই রূপকথার মতো অমূলক। ব্যাপারটা সত্যিই আশাতীত। বারবার মনে পড়ায় যেন সেই রায়বাবুর ‘আগন্তুক’কেই। মনমোহন মিত্র। কীভাবে চিনেছি আমরা আদিম সভ্যতাকে? “আসল জিনিসই তো বাদ। সায়েন্স!”

…...................................................

অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।