নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।

পূর্বে ফ্লোরিডা। আটলান্টিকের পথে পশ্চিমে এগিয়ে গেলে কিউবা। কর্কটক্রান্তি রেখার ওপরে যেন এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা মেলে ওপারে মেলে দিয়েছে। প্রায় সাতশোর কাছাকাছি ছোটো-বড়ো দ্বীপ নিয়ে এই বাহামা দ্বীপপুঞ্জ। অগণিত প্রবাল প্রাচীর ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে। নিউ প্রভিডেন্স বাহামার প্রাণকেন্দ্র। শুধু এটুকু বললে ভুল হবে। জলদস্যুদের স্বর্গরাজ্য। চওড়া এবং গভীর প্রণালীতে অবস্থিত বন্দরে একশো জাহাজ আশ্রয় নিতে পারে। অসংখ্য দ্বীপ, সামুদ্রিক কীটে গড়া বাঁধ, পাথুরে কিংবা বালির জেগে ওঠা স্থলভাগ। পাইরেটিং-এর জন্য আদর্শ। ইউরোপ থেকে বিনিময়ের সামগ্রী নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকা। সেখান থেকে ক্রীতদাস বোঝাই করে উত্তর আমেরিকা উপনিবেশে পৌঁছে দেওয়া। বিভিন্ন প্রদেশে উৎপন্ন কৃষিজ ফসল আবার জাহাজে ভরে চলে যায় ইউরোপে বাজারে। আটলান্টিকের এই ত্রিমুখী বাণিজ্য ব্যবস্থার একেবারে মাঝামাঝি বাহামা। ক্রীতদাস থাকুক কিংবা তামাক, তুলো অথবা চিনি, লুঠ করার মতো জাহাজের অভাব নেই। সকলকেই যেতে হয় বাহামার কাছ দিয়ে। এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার ফরাসি উপনিবেশগামী কিছু জাহাজেরও এই একটাই পথ। আর পথ জুড়ে রয়েছে সামুদ্রিক লুঠেরাদের কালো পতাকার আতঙ্ক। তাদের উৎপাত থেকে 

বণিকপোতগুলোকে বাঁচাতে ব্রিটিশ ক্রাউনকে নিতান্ত বাধ্য হয়েই রাজকীয় পাহারার বন্দোবস্ত করতে হয়েছে। ম্যান অন ওয়ার।
নিউ প্রভিডেন্স বেশ ঘন বসতিপূর্ণ। গ্র্যান্টস টাউন, বেইন টাউন, ফক্স হিল, ওল্ড ফোর্ড বে। শেষোক্তটি জলদস্যু দমন এবং প্ল্যানটেশনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল। কোনোটাই সে অর্থে সফল হয়নি। নিউ প্রভিডেন্সের বাকি বসতিগুলোর থেকে চার্লস টাউন স্বতন্ত্র। সমুদ্র ঘেঁষা শহর।
এখান থেকে আটলান্টিকের নীল বুকের স্পন্দন ধরা পড়ে। কাঠের জেটিখানা উপকূল ছেড়ে সরলরেখার মতো টানা। জেটিতে দাঁড়িয়ে দূর সমুদ্রের দিকে চেয়ে ছিল এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড টিচ্। জেটির অনতিদূরে নোঙর ফেলেছে কতগুলো ছোটোবড়ো জাহাজ। তাদের মাঝে ‘রেঞ্জার’কেও দেখতে পাচ্ছে সে। সাদা হেরিংগাল পাখিদের ঝাঁক জলের ওপরে বিরামহীন চক্কর কেটে চলেছে। মাঝে মাঝে কী মনে করে তারা ধেয়ে আসছে ডাঙার দিকে। গাল পাখিদের মতো একরাশ চিন্তা এডওয়ার্ডের মনের আকাশে অবিরত ঘুরে চলেছে। মাত্র তিনদিন আগেই তারা চার্লস টাউনের শহুরে আমোদ থেকে দূরে ছিল। কেপ দ্বীপের কাছে শিকারের খোঁজে ভেসে বেড়াচ্ছিল গোটা দল। গ্রীষ্মের এই প্রখর দিনগুলোতে বেশিদিন উপকূল ছেড়ে থাকা যায় না। শিকার না পেলে, আর কিছু না হোক পানীয় জলের টানে ডাঙায় তরী ভেরাতেই হয়। শিকার পেলে অবশ্য আরও কিছুদিন ভেসে বেড়ানোর রসদ মিলে যায়। 

এডওয়ার্ডদের মন্দ কপাল। শিকার জোটেনি। রসদ ফুরিয়ে আসছিল দ্রুত। কোয়ার্টার মাস্টার ক্রিস্টোফার বেগতিক বুঝে জাহাজগুলোতে রেশনিং চালু করে দিয়েছিল। মাপা জল। সল্ট পর্কের মজুত শেষ, তাই শুকনো রুটি। এল্-এর ব্যারেলগুলোও প্রায় তলানিতে। গত দু’মাসে শিকার বলতে দুটো ছোটো টার্টার আর একটা ব্রিগেনন্টিন। প্রথম দুটো থেকে কয়েকটা রামের পিপে আর ময়দার বস্তা পাওয়া গিয়েছিল। তাদের কাছ থেকেই পেছনের ব্রিগেনন্টিনের খবর মিলেছিল। গোল্ড কোস্ট থেকে আসছে। ক্রীতদাস বোঝাই। ‘মোটা দাঁও’ ভেবে উল্লসিত হয়ে উঠেছিল দলের সকলে। আমেরিকা উপনিবেশে কালো চামড়ার দাসদের চাহিদা উর্ধ্বমুখী। দামও। খোলা বাজারে দাস প্রতি পনেরো থেকে ষোলো পাউন্ড। তবে এডওয়ার্ডরা লুঠের বাকি সব পণ্যের মতো এক্ষেত্রেও কম দর পায়। একশো ক্রীতদাস মানে হাজারের কাছাকাছি রোজগার। এক কোয়ার্টার পাবে ক্যাপ্টেন আর কোয়ার্টার মাস্টার। তার পরেও যা অবশেষ থাকবে, ভাগ করলে অঙ্কটা খুব কম নয়।

চারটে স্লুপের চেয়ে রেঞ্জার সামান্য এগিয়ে। মাঝারি মাপের স্কোয়ার রিগ। সেই জাহাজেই ছিলেন দলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড। ক্যারিবিয়ান সমুদ্রের ত্রাস। ক্যাপ্টেন হিসেবে মানুষটা বাকিদের থেকে যোজন এগিয়ে। নেভিগেশনের দক্ষতা, অকুতোভয়তা, ধৈর্য কিংবা সঠিক সময়ের অনুমান ক্ষমতা যাকে এডওয়ার্ডরা বলে ট্রিগার টাইমিং, সবদিকে ঈর্ষণীয়। চারটে স্লুপ সমতে একটা স্কোয়ার রিগ এবং শ-দেড়েক দস্যুদের এত বড়ো দলকে নিয়ন্ত্রণ করা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন পেরেছেন।

এডওয়ার্ডের সমুদ্রজীবন শুরু হয়েছে সেই পনেরো বছর বয়স থেকে। প্রথমদিকে জাহাজের ডেক পরিষ্কার, ভাঁড়ার সামলানোর মতো নিরামিষ কাজ করত। তারপর সময়ের নিয়মে তার হাতেও উঠে এসেছিল ধারালো ইস্পাতের ফলা। কাটলেস। শত্রুর কম রক্ত ঝরায়নি সে। নিজেও শরীরে আঘাত বহন করেছে। তারপর উঠেও দাঁড়িয়েছে বিক্রমে। এই সুবিস্তৃত আটলান্টিকের বুকে সে জীবনের সুদীর্ঘ আঠেরোটা বছর সঁপে দিয়েছে। বদলেছে কাজ। পালটেছে জাহাজ। খুব কাছ থেকে দেখেছে অনেক ক্যাপ্টেনকে। বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ড অন্য ধাতুতে গড়া। স্বতন্ত্র। তাঁর মতো দ্বিতীয় কাউকে দেখেনি। মানুষটার একটাই দোষ— স্বদেশপ্রীতি। শুধুমাত্র মাস্তুলে ইউনিয়ন জ্যাক দেখে হাতের মুঠোয় আসা শিকার ছেড়ে দিয়েছেন! ঠিক যেমনটা প্রাইভেটিররা করত। অথচ রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পরে লেটার অব মার্ক দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। গত প্রায় একশো বছর যাবৎ যাদের আইন সঙ্গতভাবে নিয়োগ করা হয়েছিল, এমনকি লুঠের ভাগেও আপত্তি ছিল না, তারাই হয়ে গেল দস্যু! প্রাইভেটিরস থেকে পাইরেটস। তারা কীভাবে বাঁচবে, কী করবে, সে সব নিয়ে দেশের নীতি নির্ধারকরা এতটুকু ভাবিত ছিল না। সস্তা পানপাত্রের মতো ব্যবহার করে গেছে। তারপর প্রয়োজন মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে। যে দেশ তাদেরকে সহজেই ভুলে গেছে, সেই দেশের প্রতি তারাই বা অযথা প্রেম দেখাতে যাবে কেন? স্পেন কিংবা ফরাসি বণিকপোতের সঙ্গে ইউনিয়ন জ্যাককে আলাদা করবে কেন? মাস্তুলের নিশান দেখে শিকার করা তাদের কাজ নয়। আ প্রে ইস আ প্রে। সামুদ্রিক লুঠেরাদের একটা কথা সর্বাগ্রে মাথায় গেঁথে নিতে হয়। নো প্রে, নো পে। শিকার না পেলে বেঁচে থাকাটাই দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। তখন দিনের পর দিন এক মগ পানীয়ের জন্য হাহাকার করে মরো। আধপেটা খেয়েও জাহাজ সামলাও। পাল ফেল, পাল তোল।

....................................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
....................................

প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত

মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।