অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

“শ্রীমন্তিদি, সেরেঞ হুই কানা?” গান গাইবে একটা, শ্রীমন্তিদি? বাণিজ্যিক নিউজ মিডিয়ার দেওয়া তথ্য অন্য সত্যের কথা বললেও, শ্রীমন্তিদি, শ্রীমন্তি হেমব্রম, এই বাংলার প্রথম মহিলা আদিবাসী রেডিয়ো সঞ্চালক, মানে আর.জে, হেসে ওঠে অমলিন। তাও একটু ভিড়ের থেকে আলাদা হওয়া দরকার। গান শেষ। জুতো পরে বাইরে বেরোতে দেখেই, আকাশ কিছু বলতে আসছে। হাত নেড়ে এখন নয় বলেই হেঁটে যাচ্ছি মাঠের দিকে তারপর। পদ্ম-শালুক ফুটে থাকা পুকুরটার পাশ দিয়ে হাঁটছি। ঝাঁকড়া দুটো আমগাছ যেখানে মাথা ঘসছে, তার নিচ দিয়ে হাঁটছি। বোল ধরে গেছে গাছে। নেশা নেশা গন্ধ। আর সেটা পেরিয়ে গেলেই পাথর খোদানো চেহারাগুলো ফুটবল পেটাচ্ছে দিগন্তহীন মাঠটায়। মাঠের আগে থেকে ডান দিক নিয়ে নিই। আরেকটা পুকুরের পাশ দিয়ে একটু হেঁটে গেলেই সেই জঙ্গলটা! আহা, উপরে-নিচে ফুটে থাকা, ঝরে পড়া লালের সঙ্গে মিশে গেছে নির্বিকার খয়েরি রুক্ষতা।

ওই অপার্থিব সৌন্দর্যে ঢুকি না। বরং খানিকটা পা চালিয়ে এগিয়ে যাই মাঠের ধারের দিকে। মাঠটা শেষ যেখানে, সেখান থেকে নিচের দিকে খাড়াই একটা ঢাল। ঢালটা শেষ হতেই, ছড়িয়ে থাকা ধান ক্ষেত। ফসল কাটা হয়ে গেছে সব। ফ্যাকাশে খড়ের গোড়া ছড়িয়ে সারা মাঠ জুড়ে। এবার বর্ষার আগে আর চাষবাস হবে না কোনও। তবুও কোন উৎসবের প্রতীক্ষা বাতাসে? কদিন পরেই তো ‘বাহা পরব’। ফুলের উৎসব! দুপুরের গরমের হলকা কেটে গিয়ে বাতাসে কেমন একটা শিরশিরে ভাব। কাছেই কোথাও কোকিল ডাকছে একটা। কেন কী জানি, ‘মা নিষাদ’ মনে পড়ে হঠাৎ। এই সব মনে পড়ারা, একলা হলেই ধরাতে বলে সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে, মাঠের ধারে পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসি। তারপরে সামনে তাকাতেই, হঠাৎ একটা ম্যাজিক। চিরন্তন একটা ছবি। ফসল কেটে নেওয়ার পরে মাঠের আলের উপর দাঁড়িয়ে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। নিবিষ্ট মনে চেয়ে আছেন ক্ষেতের দিকে। আর পুরো দৃশ্যটার ব্যাকগ্রাউন্ডে সার সার পলাশের গাছ। আসলে যেন আগত সন্তানের জন্য প্রতীক্ষা। কিংবা সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে ভবিষ্যতের ভাবনায় আকুল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে ফিরে যাওয়া ওই হাল্কা সবুজ ঘাসের আলপথ ধরে। একটা অনন্ত লং শট। শেষ আলোটুকু মুছে যাওয়ার ঠিক আগে, একটা অনন্ত ফ্রেম আউট।

এই সকল দৃশ্য কি আমরা লিখে উঠতে পারি কোনোদিন? ক্যামেরার লেন্সও যেন অসহায় হয়ে পড়ে ভীষণ। আর বহুদিন পর গ্যালারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে সেই সব লালের ছিটা শুধু মনে করিয়ে দিয়ে যায় বারবার, স্মৃতি লিখতে গিয়ে বারংবার কী ভীষণ কী ভীষণ কী ভীষণ ভুলে যাওয়াদের কথা লিখে ফেলছি আমরা শুধুই!
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম।। মিহির সেনগুপ্ত।। সুপ্রকাশ।।