অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।
অসুর সম্প্রদায়ের কথা আগে ইতিউতি কানে এসেছিল বটে। কিন্তু এই অঞ্চলে যে এঁরা এত বড় একটা প্রতিবিপ্লব করে ফেলেছেন প্রায়, সেটা না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব হত। বেশ কয়েক দিনের চেষ্টায় খুঁজে পাওয়া গেল এই সম্পূর্ণ আয়োজনের যিনি মূল হোতা, সেই অজিত প্রসাদ হেমব্রমকে। পুরুলিয়ারই মানুষ, তাই মঞ্জুরকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে ফোন করতে বললাম একটুও দেরি না করে। উদ্দেশ্য, এখানে যদি উনি এই মুহূর্তে থাকেন, তাহলে কবে, কখন আর কোথায় গেলে একটু কথা বলা যাবে অজিত প্রসাদের সঙ্গে, সেটা জানতে চাওয়া। সময় পাওয়া গেল তার দু-তিন দিন পরেই। মঞ্জুরের বাইকে আমি আর মিতনদা সওয়ারি হয়ে রওয়ানা দেওয়া গেল কাশীপুরের দিকে।
বেশ কয়েকবার ফোন করে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেখা হল যে মানুষটার সঙ্গে, তার একটা চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল। দেখেই মনে হয়, কোনও অসুস্থতা আছে গভীর। অজিত প্রসাদ হেমব্রম যে তাঁর এই বিকল্প উদযাপন প্রচারের জন্য বেশ দৌড়াদৌড়ি করছেন, সেটা অবশ্য ইতিমধ্যেই জানতে পেরেছি তার আগেই বেশ কয়েকটা রিপোর্ট দেখে। ডাক এসেছে এমনকি জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি থেকেও। এবং সেই সঙ্গেই চলছে বেশ কিছু বই লেখার কাজ। খানিকটা অবাক হয়েই দেখলাম, বইগুলো মূলত মৌলবাদের বিরুদ্ধে আর সেগুলো প্রান্তিক সংস্কৃতির কথা সামনে আনার কথাই বলেছে যতটা সম্ভব ভয়ডরহীন ভাবে।
দুর্গাপুজোর বেশ কিছুদিন পরের সময়টা। আকাশে মেঘ তাও। মেঘলা বলেই, সন্ধেটাও যেন নেমে আসে খানিক তাড়াহুড়ো করেই। একটা দোতলা বাড়ির ছাদে পেতে দেওয়া চাটাইয়ের উপর বসে অজিত প্রসাদ হেমব্রম শোনাতে শুরু করেন একটা না-জানা ইতিহাস। সে ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু গবেষণার দায় তো এই পরিসরে নেই। বরং মিথোলজি যদি একটা মুদ্রা হয়, তবে তার উল্টোদিকের গল্পটা শোনাই উদ্দেশ্য একমাত্র।
গল্পের সেই উৎসবের নাম, ‘দশানি’। নামেই উৎসব, কিন্তু জাঁকজমক নেই একটুকু। নেই রংবাহারি প্রকাশ কোনও। বরং থাকার বলতে শুধুই বিষাদের মূর্চ্ছনা। বিষাদ, কারণ একসময় নিজেদের দেশ-ঘর-মাটি ছেড়ে বিতাড়িত হবার যন্ত্রণা তো নিদারুণ। বিষাদ, কারণ একসময় ঈশ্বরের মতো প্রবল পরাক্রমী ও প্রজাবৎসল রাজ্যপ্রধানকে শেষ করে দেওয়ার জন্য তথাকথিত ‘সভ্য’ মানুষদের শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর স্মরণেই প্রান্তিক মানুষদের এই শোকের পরব। রুখা মাটিতে বৃষ্টির গন্ধ এসে পড়লে, বুকের জমানো মেঘে এক বিষাদসিন্ধু-যাপন।
…..............................................
Comments
Post a Comment