নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
লম্বা ঘাসে ঢেকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল খোলা জমির মাঝে মাঝে, দর্পভরে দাঁড়িয়ে আছে কোপাক গাছগুলো। এমন অহংকার তাদের মানায়। প্রকাণ্ড গুঁড়ি এবং উচ্চতায় ডালপালারা যেন হাত বাড়িয়ে আকাশকে ছুঁতে চাইছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা লাল পাপড়ির ফুল কোপাক গাছগুলোকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে। সেই গাছেদের পুরুষ্টু শেকড়ে হেলান দিয়ে বসে আছে ছোটো দলটা। দলের তিনজন পুরুষের মাঝে একমাত্র মেয়েটা বেমানান। কিছুক্ষণ আগে পেছনের ঘন জঙ্গল পেরিয়ে এসেছে তারা। হয়তো এখনই তাদের চলা থামানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না, বাধ্য হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে অঝোরে। বিকেলের দিকে এমন বৃষ্টি এখানে নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই নামে। তবু যে দুটো দিন তারা জঙ্গলের পথে ছিল, অসুবিধা হয়নি। জঙ্গলের মোটা গুঁড়ির গাছগুলো একে অপরের প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন ভীষণ আত্মীয়তা তাদের মধ্যে! ডালপালাগুলো মিলেমিশে গিয়ে এমন ছাউনি তৈরি করে যে চারপাশ দিনের বেলাতেও ছায়া ছায়া লাগে। আলোর মতো বৃষ্টির ফোঁটারাও সহজে ঢুকতে পারে না। পাতাদের অনুমতি নিয়ে তবে মাটি ভেজায়। কিন্তু জঙ্গল ছাড়িয়ে এই খোলা ঘাস জমিতে বৃষ্টিকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। বেশিক্ষণ হবে না, কিন্তু ততক্ষণ পেরেক ঠোকার মতো গায়ে বিঁধবে। দলটা তাই কোপাক গাছের পাতার আড়াল নিয়েছে। ভিজছে, তবে সেই তীক্ষ্ণতা থেকে রেহাই পাওয়া গেছে অন্তত। ওদের মধ্যে একটু আলাদা বসে আছে ছেলেটা আর মেয়েটা। হাবভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা বাকিদের থেকে আলাদা। একটু বেশি ঘনিষ্ঠ। দুজনের মধ্যে মতান্তর হয়েছে। প্রেমিক যুগলের মধ্যে যেমনটা হয়। ছেলেটা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে বোঝানোর। অবুঝ মেয়ে শুনবে না। বাকি দু’জন সামান্য দূরে বসে তাদের বিবাদ উপভোগ করছে। যেন বিতর্কে ছেদ টানতেই মেয়েটা তীব্র শ্লেষে বলে উঠল, ‘নাই মে সে এমিও। আমি বুঝতে পারছি না। মাগাভা, তুই কি ভয় পাচ্ছিস? তাহলে গ্রামে ফিরে যা। এতদূর এসে ভাইয়ের একটা খোঁজ না নিয়ে আমি ফিরব না। কিছুতেই না।’
সামনের দিগন্তে তাকিয়ে নীরব রইল ছেলেটা। মাগাভা। মুখে না বললেও তার অভিমানে আঘাত লেগেছে। ভয়ের সঙ্গে এওয়া মানুষদের নিত্য সহবাস। রোজকার ব্যবহারে যেমন প্রিয় জিনিসটি আকর্ষণ হারায়, ভয়ও তেমনই।
‘বেনিনের বাঁকে পা ফেল দেখে, সাবধানে
এখানে আসে খুব কম, তবে যায় বহুজনে।’
বুড়োদাদার মুখে শোনা ছড়ার কথাগুলো মনে পড়ে গেল মাগাভার। কথাগুলো সামান্য ওলোটপালোট করে বেনিন থেকে গুয়েনা, মালি, নোটসে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বালির ঢেউ খেলে যাওয়া মরুভূমির মতো মুখের চামড়া আরও কতকটা কুঁচকে, খয়েরি রঙের মাড়ি বের করে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বুড়োদাদা ছড়াটা বলত। বলার সময় গলার শুকিয়ে যাওয়া চামড়া ঠেলে ফুলে উঠত নীলচে শিরা। মাথার সাদা শনের মতন গোছা চুলগুলো মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ত। মাগাভার তখন মনে হতো, তার বুড়োদাদা আদতে ভুডু জেভিসো। বজ্র এবং বিচারের দেবতা। বুড়োদাদার কথাগুলো মনে করে সে শেষবার মেয়েটাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘এমি কিই সে ওজো। আমি ভীতু নই আফ্রেয়া। কিন্তু বেনিনের উপকূল নিরাপদ নয়। ইয়োঙ্গা হারিয়ে গেছে। আর এখানে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা ফিরে আসে না আফ্রেয়া।’
কথাটা ভুল নয়। বেনিনের উপকূল এখন ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট। সেই হাটে মানুষের যোগান দিতে নাইজার নদী অববাহিকা জুড়ে অবাধে চলছে চুরি এবং ছিনতাই। বাচ্চা-জোয়ান, নারী-পুরুষ, কোনো বাছবিচার নেই। গত দশ-বারো বছরে কত চেনা মুখ নিখোঁজ হয়ে যেতে দেখেছে মাগাভা! আশেপাশের এলাকা থেকে কত হাহাকার কানে এসেছে! সেসব দেখতে দেখতে এবং শুনতে শুনতে মাগাভার বেড়ে ওঠা। তার কথায় নিরুত্তাপ রইল মেয়েটা। কিছুক্ষণ নীরব রইল দু’জনেই। তারপর নিজের অবস্থান থেকে না সরে সে বলল, ‘বিনু। দুঃখিত মাগাভা। আমি জানি তোর ওপরে অনেকে নির্ভর করে আছে। মা, ভাইবোনেরা ছাড়াও গোটা গ্রাম তাদের হবু সর্দারের ভরসায় দিন কাটায়। তোকে দোষ দেওয়া আমার ভুল। কিন্তু ইয়োঙ্গা? সে শুধু আমার ভাই নয়। ছোটো থেকে কোলেপিঠে বড়ো করেছি তাকে। একটা চেষ্টা না করে আমি থামব না। তুই ফিরে যা। আমি দোষ দেব না তোকে।’
দূর অনন্তে নিজের দৃষ্টি মেলে রাখল মাগাভা। আফ্রেয়া বড়ো জেদি। তাকে নিজের পথ থেকে ঘোরানো সহজ নয়। একটু পরে সে নিজের প্রিয়তমার দিকে নজর ফেরাল। তামাটে কোঁকড়ানো চুল এই ক’দিনে আরও রুক্ষ হয়ে উঠেছে। চোখের কোলে অনিদ্রার ছাপ স্পষ্ট। তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া। হয়তো তারা বলতে চাইছে কিছু। পারছে না। মাগাভা বিমুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আফ্রেয়ার জন্যই সে বিপজ্জনক বেনিন উপকূলের এত কাছাকাছি এসেছে। মানুষধরা শয়তানগুলোর পিছু নিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে এতটা দূরে। তাদের হাত থেকে ইয়োঙ্গা এবং বাকিদের উদ্ধার করা কঠিন জেনেও ছুটেছে। মেয়েটাকে যে সে বড়ো ভালোবাসে। জোৎস্না মাখানো মুখ। টানা ভ্রূর নিচে টলটলে চোখজোড়া। দৃষ্টি মেলালে মাগাভার মনে হয়, সে বুঝি ভোলটা নদীতে সাঁতার কাটছে। ছিপছিপে টানটান কৃষ্ণবর্ণা শরীরে যৌবনের সদম্ভ উপস্থিতি। আফ্রেয়ারা একই সঙ্গে নোটসে ছেড়ে এসেছিল। ঘর বেঁধেছিল পাশাপাশি। পিঠোপিঠি বড়ো হয়েছে দু’জনায়। আগামী পূর্ণিমায় ভুডু মাউয়ুর সামনে তাদের এক হয়ে যাওয়ার কথা। ভালোবাসার মানুষ তাই এই বিপদসংকুল বেনিনের পথে একা বেরিয়ে পড়ুক মাগাভা চায়নি, কিন্তু তাকে আটকেও রাখতে পারেনি। মনের অবশিষ্ট দ্বিধাটুকু মুছে ফেলে সে বলল, ‘তা যে হয় না আফ্রেয়া। আমরা সকলেই ফিরে যাব। একসঙ্গে। তবে ইয়োঙ্গার একটা খোঁজ পাওয়ার পর।’
আফ্রেয়া মাথা নিচু করল। যেন উত্তরটা তার প্রত্যাশিতই ছিল। কিংবা একটু আগে নিছক অভিমানে যে আচরণ করেছে, তার জন্য অনুতপ্ত বোধহয়। ময়লা লেগে থাকা কালো নখপ্রান্ত দিয়ে কোপাক গাছের পুরু শেকড়ে দাগ ফেলছিল আফ্রেয়া। বিতর্কের এমন অবসান সম্ভবত দলের বাকি দু’জন আশা করেনি। ভেবেছিল মাগাভা ঠিক বুঝিয়েসুঝিয়ে জেদি মেয়েটাকে রাজি করাবে। এখানে, এই ঘাসবনে, আজকের মতো বিশ্রাম নিয়ে ফেরার পথ ধরবে সকলে। সেই মতো ঝোলা থেকে মিষ্টি আলু আর সবুজ বিন বের করে সাজিয়ে রাখছিল। তাপানো ভাতে তার সঙ্গে দুটো তেজপাতা, লাল শুকনো লঙ্কা আর জায়ফল ফেলে দিলে স্বাদ খোলতাই হয়। ঝোলায় অবশ্য স্বাদ খুলবার সেসব উপকরণ নেই। গ্রাম ছাড়ার সময় শুধু বইবার মতো চাল, আলুই নিতে পেরেছিল। পথে জমি থেকে বিন। উনুন ধরানোর সম্ভাবনা নেই দেখে বাকি দুই সঙ্গীর একজন বলে উঠল, ‘আর কত ছুটবি মাগাভা? ইয়োঙ্গাকে ফিরে পাওয়া যাবে না সে তো তুইও জানিস। তাহলে আর কেন?’
মাগাভা প্রত্যুত্তরে হাসল। ছুটেই তো চলেছিল তারা। সেই ছোটোবেলা থেকে। এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তরে। প্রাণের দায়ে। নতুন রাজা টোগবে গোকোলির ত্রাস যেন পিছু ছাড়তে চাইছিল না এওয়া মানুষদের! রাজার সৈন্যরা শুধু লুঠ করেই তৃপ্ত হয়নি, ছেলের সামনে খুবলে খেয়েছে তার মাকে। মেয়ের সামনে গুঁড়িয়ে দিয়েছে তার বাবার করোটি। নিঃসম্বল, নিঃসহায় মানুষের চোখের জল আর রক্তে বান ডেকেছিল নোটসে অঞ্চলে। পরিত্রাণের একটাই উপায়—পালাও। নিজের বসত, স্মৃতি, মায়া ফেলে পালাও। যেভাবে হোক। যেদিকে হোক। পেছনে শ্বদন্ত বের করে তাড়া করেছিল টোগবে গোকোলির সৈন্যরা। সামনে অনিশ্চিত অদেখা ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যতের পথে ছুটতে গিয়ে কতজন মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। বাবা, মা, ভাইবোনদের সঙ্গে ছোটো ছোটো পা ফেলে মাগাভাও ছুটে চলেছিল। একটানা। নিরন্তর। বিরামহীন সেই ছোটা। যতদিন পর্যন্ত না বসত করার জন্য নিশ্চিত নিরাপদ ঠাঁই জোটে। সব শুরুর একটা শেষ তো থাকেই। মাগাভাদেরও দীর্ঘ, ক্লান্তিকর দৌড় শেষ হয়েছিল ভোলটা নদীর কাছে এসে। লম্বা লম্বা গিনি ঘাসে ঢাকা সবুজের পসরা প্রকৃতি বুঝি তাদের জন্যই সাজিয়ে রেখেছিল! আরও যারা নিজেদের দেশ ছেড়েছিল, তাদের অনেকেরই দৌড় মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। কারোর টোগবে গোকোলির সৈন্যদের হাতে সাধের প্রাণ খুইয়ে, কারোর বা পথের ধকলে। মাগাভা, আফ্রেয়াদের মতো বাকিরা, যারা লড়াই ছাড়েনি, ভোলটা নদীর পাশের ঘাসজমি সাফসুতরো করে ঘর বেঁধেছিল। অবশেষে বুক ভরে দু’দণ্ড শান্তির শ্বাস নিয়েছিল সকলে।
‘ক্লান্ত হয়ে পড়েছিস বুঝি?’
গায়েরার দিকে ইচ্ছে করেই কথাটা ছুঁড়ে দিল মাগাভা। ছেলেটার জান শক্ত। মনও। সহজে দমতে চায় না। গায়েরার হয়ে জবাব দিল তার পাশের জন, ‘ক্লান্তির কথা নয় মাগাভা। কিন্তু অকারণ এই ছোটাছুটি। দাস বন্দরের কথা সবাই জানে। আফ্রেয়াও। সাদা চামড়াদের হাতে একবার পড়ে কেউ ফিরে এসেছে?’
একই কথা বলত মাগাভার বুড়োদাদা। মাথার ওপরে নিশ্চিন্ত ছাউনি থাকা সত্ত্বেও মাথা নেড়ে শুধু সেই একঘেয়ে কথা আউরে যেত দিন রাত, ‘বেনিনের বাঁকে পা ফেল সাবধানে। এখানে সাগর পারের সাদা চামড়ার মানুষগুলো আসা যাওয়া করে। ব্যবসা করতে আসে ওরা। মানুষের ব্যবসা।’
.....................................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
.....................................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment