অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

এই টুকরো টুকরো মুহূর্তের হাত ধরে ছেলেবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে খুব। কয়েক মুহূর্ত বসে থাকতে ইচ্ছা করে নিজের শৈশবের পাশে। মনে পড়ে বুড়ির ঘর। কাল আমাদের দোল। পোড়া আলুর রসনা। একটু বেশি টক আর ঝালে আওয়াজ ওঠে টাকরায়। আর মনে আসে প্রিয় গান, ‘মন সে রাবণ যো নিকালে, রাম উসকে মন মে হ্যায়’...

অক্টোবর পার করে সেদিন পুরুলিয়াতে এসে নামা হয় আবার ‘একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়/যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে’। এবার আর মলয়দাকে ডাকা হয়নি গাড়ি নিয়ে আসার জন্য। তবু পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে ভোরের বাসে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে, ঠান্ডা হাওয়াটা বশে নিয়ে নেয় মাথা-কপাল সবটাই। কমিউনিটি রেডিয়ো স্টেশন থেকে ফেরার পথে মাথা-ব্যথার অ্যান্টিডোট নিতে দাঁড়াতেই হয় চায়ের দোকানে।

হঠাৎ কোথা থেকে ইমন এসে হাজির। এমনই মাথা ধরেছে, দশ-বারো মিনিটের হাঁটা পথই যেন দশ-বারো মাইল। ফেরেস্তা ইমনের বাইকে উঠে পড়া গেল। বললাম, “আগে একটু বাজারের দিকে চলো তো। কয়েকটা ওষুধ নেওয়ার আছে...”

বাজার যাওয়ার পথে দু’পাশে ছোট ছোট চাষ জমি, নিচু পুকুর, ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। মাটির দেওয়াল। খোলা মাঠের মধ্যে বাৎসরিক যাত্রাপালার জন্য একটা বাঁধানো স্টেজ। হাওয়ার ঝাপটা এড়াতে অনুরোধ, “একটু আস্তে চালিও!” অনুরোধের আর্জি মান্যতা পাওয়ায় ধীরেই উড়ছে দু’চাকা! বাইকের পিছনে খেয়াল করে ডাক দিচ্ছে কেউ কেউ, “আজ আসা হইল্য?” মাথা নেড়ে যাচ্ছি, তখনই ইমন বলল, “এবার একটু ইস্পিড নিই, নাকি?” আর ঠিক তখনই হঠাৎ একটা পুকুরের পাড়ে নেমে যাওয়া ঢালের ঘাস জমিতে ওদের সঙ্গে দেখা। এক ঝাঁক কচিকাঁচা। কিছু একটা কাঠামো তৈরি করেছে নিজেরাই। উপাদান বলতে কাঠ, খড়, নারকোল বা সুপারি পাতা। কাঠামোর আবার মাথা মোট তিনটে! বেশ কোলাহল। কিন্তু উন্নয়ন বা প্রযুক্তির গতিবেগ ছোটদের আনন্দের উ‌ৎসগুলো কবেই বা ধরতে পেরেছে? অগত্যা পুনরায় অনুরোধ করে থামানো গেল বাইক। বাইকের থেকে নেমে আবার কিছুটা হেঁটে গেলাম পিছনের দিকে।

কচিকাচাদের আয়োজনের উপাদানে কমতি হলেও, উ‌‌ৎসাহে ভাটা নেই যদিও। খানিক গল্প করা গেল।

— এটা কী বঠে রে?
— রাবণ!
— সেকি! তা রাবণের বাকি মাথাগুলো ক‌ই?
— ছাড়াইন গ্যাছে।
— হ্যাঁ?
— বাকি মাথা গুলহ্ ঘুচাইন গ্যাছে গ!
— ওহ হো! তা, এটা কী হবে এরপর?
— আগুন দিব! আর পটকা জ্বালাব! ছ’টা বাইজলে চলি আসবে।

কথা বলতে বলতে একবারও চোখ তুলে তাকানোর সময় পায় না তারা। নিজেদের কাজে ব্যস্ত ভীষণ। অনুভব করি, জীবনের এইসব ছোট ছোট আবিষ্কারের মধ্যে অনাবিল আনন্দ আছে। প্রচণ্ড বেঁচে থাকা আছে। আর চারপাশের এই ভীষণ ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা অসহিষ্ণুতার মধ্যেও শিখিয়ে দেওয়া আছে যে, জীবনে আসলে সত্যিই সারল্যের থেকে বেশি আর কিছুরই প্রয়োজন নেই। যেমন, রাবণেরও আর দশটা মাথার প্রয়োজন হচ্ছে না; এই তিনটে মাথাতেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে বেশ।
…..............................................

অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।