অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

এদিকে গরম পড়তেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় ছো-পার্টির। পুরুলিয়া মানেই যে ‘ছো লাচ’ বা ছৌ নাচ, সেটা বেশ খানিকটা সত্যিও বটে। ছৌ নাচের পালা বসে সাধারণত গরমকালের মাসগুলোতেই। সন্ধের পর জ্বলে ওঠে হলুদ বিজলি বাতির জ্যোৎস্না। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজ করার পর ক্লান্ত হা-হদ্দ মানুষগুলো মেতে ওঠে মহিষাসুরমর্দিনী পালা, কার্তিকেয় পালা বা শিব-পার্বতীর পালায়। মাথা নিচে পা উপরে করে লাফিয়ে ঘুরে গেলে শূন্যে, বোঝা যায় যুদ্ধ পৌঁছেছে চরমে! যেন ব্রহ্মান্ডও কেঁপে ওঠে তারপর শূন্য থেকে নেমে আসা তাদের স্পর্শ পেলে মাটি। ভাবি, এভাবেই কি আরোপিত হয় দেবত্ব? সহজ-সরল মানুষগুলোর ভিতর থেকে আদ্যন্ত শিল্পী প্রকৃতিটা বেরিয়ে এলেই কি ঈশ্বর স্বয়ং এসে বসেন তাদের পাশে?

কোন মেঘ কখন যে ডানা পাঠায়, তার খোঁজ করতে করতেই এরমধ্যে হঠাৎ রাতের দিকে মঞ্জুরের ফোন। দশটা পেরিয়ে গেছে। ওই সময় এখানকার কারোর থেকে ফোন পাওয়া একটু আশ্চর্যই বটে! ফোন ধরতেই চিরাচরিত মঞ্জুর, “কী হে, রাতে আইসব্যে নাকি?”

  • কোথায় আসবো?

  • আমাদের দামোদরপুর। বিশাল ছো-লাচ পালা হে আজ। সারা রাতভর। আসবে বলো তো যায়ে নিয়ে আসব।

  • আরে, যাব না মানে? কখন থেকে শুরু?

  • বারোটা। আমি সাড়ে এগারোটা নাগাদ যাব তবে...

ভগবানদার দিয়ে যাওয়া খাবার তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে যায় সেদিন। সাড়ে এগারোটার সময় মঞ্জুর ফোন করলে, অগত্যা পাওয়া যায় কাঙ্খিত সেই ডানা। খানিকক্ষণের উড়ান শেষে, যেখানে পৌঁছানো হয় শেষমেষ, সে দৃশ্যটা অভূতপূর্ব। একটা বিশাল মন্ডপ, কিন্তু দর্শকদের সঙ্গে শিল্পীদের উচ্চতার পার্থক্য নেই কোনও। স্টেজ বলতে ধুলোময় জমিটাই। সেইটাই দর্শকাসনও বটে।

ধুলোময় জমির স্টেজের একদিকে অর্কেস্ট্রা দল। ধামসা, মাদল, বাঁশি আর আরও অনেক রকম বাজনাপত্র নিয়ে পালা জমাতে প্রস্তুত তারা। শুরুর আগে একটু বিড়ির মৌতাতে জাল দিয়ে ঘন করে নেওয়া ধুনকি মেজাজ। পালায় গান গাইবেন যে গায়ক, গলার সাম্মানিক উত্তরীয় গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত তিনি বেজায়। নাচের শিল্পীদের জন্য বাকি গোটা ময়দানটাই। আশেপাশের গ্রাম থেকে মানুষ ভেঙে পড়েছে পালা দেখতে। কিংবা অনেকে দেখছেও না। এদিক-সেদিক ঘুরছে, নেশা করছে একটু দূরের অন্ধকারে। বিবাহিত মহিলাদের কোলের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট শিশু। মনে হচ্ছে এই পালা বা গান-বাজনার শব্দ যেন এতটাই রক্তে মিশে আছে তাদের,  আওয়াজের ভীষণ তীব্রতাতেও তাই ঘুম ভাঙছে না এমনকি শিশুদেরও কিছুতেই। শূন্যে পাক খেয়ে যখনই জমি ছুঁয়ে নিচ্ছেন কার্তিকেয়, তখন তার পা থেকে ধুলো উড়ে এসে লাগছে সেই শিশুর মুখে। তার তরুণী মা আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছে ঘুমন্ত শিশুর কপাল। এসব দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ক্যামেরার আঠেরো-পঞ্চান্ন বালখিল্য লেন্সও কখন যেন ধুলোর আদর মেখে ঝাপসা করে দিচ্ছে ছবি।

….....................................

অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ


Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।