অভিমানভূম।। (পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)।। শুভদীপ চক্রবর্ত্তী।। সুপ্রকাশ।।

ভাবতেই কী আশ্চর্য লাগে, যে দেশে একটা গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার সামনের সারিতে রাখা হয় জাতপাত বা ধর্মের ঝনঝনানি, সেখানে দেশের এরকম একটা প্রান্তিক জায়গায় একই দিনে উদযাপিত হয় ‘ভাদু পরব’ আর ‘ছাতা পরব’। দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের হৃদয়ের কাছের দুই উৎসব। একেকটা উৎসব মানেই একেকটা গল্প এখানে।

অনেক পরে একদিন বাড়ি ফেরার পথে পুরুলিয়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম বাংলার অন্যতম রঙিন এই স্থানীয় গ্রামীণ উত্সব, ‘ভাদু’। একান্ত ভাবেই গ্রামের মহিলাদের নিজস্ব একটা উৎসব। বাংলা ক্যালেন্ডার ধরে বলতে গেলে, বছরের পঞ্চম মাস, অর্থাৎ ভাদ্র মাসের শেষ দিনে পালন করা হয় এই ভাদু উৎসব। প্রচলিত মত বলে, ‘ভাদু’ হল দেবী ভদ্রাবতীর (বা অন্য আরেকটি উত্স অনুসারে রানী ভদ্রেশ্বরীর) ডাক নাম। মানভূম অঞ্চলে দেবী ভদ্রাবতীর পরিচিতি উর্বরতার দেবী হিসেবে। উর্বরতা, অর্থাৎ জমির ফসল, এবং নারীর সন্তান। গ্রামের মহিলাদের কাছে দেবী ভদ্রাবতী ঘরের আদরের মেয়ের মতোই। তাই সারা মাস আনন্দ করলেও, দেবীকে ভাসানের মুহূর্তে বিষাদ আসতেও দেরি হয় না। দেবীর কাছে চাওয়া তো সামান্যই, আসন্ন মরসুমে যেন ফসল হয় ভাল আর ঘরের দুয়ার থেকে যেন দূরেই থাকে দারিদ্রের কালো ছায়া।

এদিকে একদিকে যখন শিলাই সংলগ্ন জলাশয়ে ভাদু ভাসান চলছে, অন্যদিকে তখন সেই একই মাঠে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে ‘ছাতা’ পরবের। এ এক আশ্চর্য উৎসব, যেখানে পুজো হয় বর্ষার দেবতার। প্রার্থনা? সেই প্রকৃতির রোষানল থেকে বাঁচতে চাওয়াই। যেন বৃষ্টি হয় ভাল। যেন ফসল হয় ভাল। যদিও এই পরবের সঙ্গে মিশে আছে পঞ্চকোট রাজপরিবারের নাম, তবুও আদতে সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আদিবাসী উৎসবই। উপস্থিত ধামসা, মাদল, হাঁড়িয়া, মহুয়া, মাংস পিঠা, পাতা নাচ। বিশাল একটা শাল কাঠের গুঁড়ির উপর টাঙানো কাপড় দিয়ে তৈরি ততোধিক বড় একটা ছাতা! এই পরব ঘিরেও রাজপরিবারকে জড়িয়ে একাধিক মিথ থাকলেও, আদিবাসী মানুষদের উদ্দীপনা সেই কথা মাথায় রাখতে দিচ্ছে না আর। পরে শুনেছিলাম, ছাতা পরবের মূল অনুষ্ঠানটা যেখানে হয়, অর্থাৎ পুরুলিয়ার চাকলতোড়ে, সেখানে নাকি একটা সময়ের পরে ‘দিকু’ অর্থাৎ শহুরে সভ্য মানুষদের থাকতেও দেওয়া হয় না আর। এখানে সেসব মাথায় নেই। ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে দেখছি আদিবাসী মেয়েদের সাজ। লাল-সাদা বা লাল-সবুজে মেশানো শাড়ি। খোঁপা করে টেনে বাঁধা মাথার চুলে হলুদ ফুল কারোর কারোর। মেয়েদের নাকি আসতেই হয় এই পরবে। জীবনসঙ্গী বা সঙ্গীনিও খুঁজে নেয় অনেকে এই মেলার মাঠ থেকেই।
…………………………………………….
অভিমানভূম
(পুরুলিয়ার ধুলো মাটি নদী আর মানুষদের গল্প-কথা-মিথ)
শুভদীপ চক্রবর্ত্তী

প্রচ্ছদ : সন্দীপ রায়
অলংকরণ : সুলিপ্ত মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা

সুপ্রকাশ

Comments

Popular posts from this blog

প্রতিযাত্রা।। দুর্লভ সূত্রধর।। সুপ্রকাশ।।

লেটারপ্রেসের কম্পোজিটর : এক বিষাদান্ত পরম্পরা।। অনন্ত জানা।। সুপ্রকাশ।।

রাস্তার শুরু।। জয়া মিত্র।। সুপ্রকাশ।।