নষ্ট চাঁদের আলো।। অলোক সান্যাল।। সুপ্রকাশ।।
ব্যস্ত বাজার। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। থকথকে কাদা চারিদিকে। তার সঙ্গে ঘোড়ার মল মিশে কটু গন্ধকে উসকে দিয়েছে। লোকজনের অবশ্য তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বড়ো ঝুড়ি করে এক প্রৌঢ়া বান রুটি নিয়ে বসেছিল। হঠাৎ বৃষ্টি তার খানিক ক্ষতি করে দিয়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরকে দুষছিল সে। বৃষ্টি শুরু হতেই কয়েকজন পাশের এল হাউসে ঢুকেছিল। বৃষ্টির সঙ্গে পিপাসার বোধহয় গোপন সমঝোতা আছে। আকাশ জল ঝরা থামাতেই বেরিয়ে এসেছে তারা। নেশার চোটে তাদের মধ্যে থেকে দু'জন ভেজা রুটি কিনে নিল। প্রৌঢ়া আবার আকাশের দিকে চাইল। এবার ঈশ্বরকে কৃতজ্ঞতা জানাল। এল হাউস ছেড়ে বাজারের আরও একটু ভেতরে বেশ কিছু সবজি বিক্রেতা বসে। সকালের বৃষ্টি তাদেরও বাধ্য করেছে দুপুর পেরিয়েও পসরা সাজিয়ে বসে থাকতে। পাশাপাশি রাখা পিপের ওপরে তক্তা সাজিয়ে অস্থায়ী টেবিল বানিয়ে নেওয়া। তার ওপরে কুমড়ো, স্কোয়াশ, বিন, আলু। বৃষ্টির জলে ভিজে তারা এখনো জৌলুস হারায়নি। তবে তাতেও সবজি বিক্রেতাদের ভাগ্য ফিরবে কিনা বলা মুশকিল। গতকাল থেকে বিক্রি তলানিতে। গোটা বাজার জুড়েই এক অবস্থা। ভীড়ে থিকথিক করছে, অথচ খদ্দেরের দেখা নেই। যারা আসছে, সকলে জড়ো হচ্ছে বাজারের শেষ প্রান্তে। সকলের যাবতীয় আগ্রহ কেন্দ্রীভূত হয়েছে সেখানে।
সামুদ্রিক লুঠেরাদের জাহাজে মহিলাদের কোনো ঠাঁই নেই। জলজীবনের এটাই দস্তুর। সেই মর্মে অঙ্গীকার করে তবে জাহাজ জলে ভাসে। কেউ বলে মহিলারা জাহাজে থাকলে তাদের কাজের পক্ষে অশুভ। শিকার জুটবে না। কেউ বলে তারা থাকলে সঙ্গ পাওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোঁদল শুরু হবে। দ্বিতীয় কারণই যুক্তি সম্মত। তবে মানুষের চিরকাল যুক্তির চেয়ে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব বেশি পছন্দসই। সম্ভবত তাই প্রথম ধারণাটির উৎপত্তি। তা বলে সমুদ্র যে একেবারে নারীশক্তিকে পরখ করেনি তা নয়। মেরি রিড কিংবা অ্যানি বনি আমেরিকান কলোনি পেরিয়ে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের রাজ দরবারেও চর্চার বিষয়। এটাও ঠিক, সংখ্যাটা নগন্য। নগন্য হলেও সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একজন মহিলা হয়ে পুরুষদের মতো তলোয়ারবাজি করা, লুঠ মার করা কিংবা ঘর সামলানো ছেড়ে জলের ফুর্তিময় জীবন কাটানো! শুধু আশ্চর্যের নয়, অসম্মানজনকও বটে। মেয়ে পুরুষ এক সারিতে বসতে শুরু করলে সমাজ রসাতলে যাবে যে! এমন ধারণা শুধু মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ভাবলে ভুল হবে। অভিজাত এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারেরও মেয়েদের ক্ষেত্রে একই মানসিকতা। তফাত বলতে তাদের বাইরের চাকচিক্য। অভিজাত মেয়েরা হল উৎসব অনুষ্ঠানে সোনালী সুতোর কাজ করা গাউন আর অলঙ্কারসমৃদ্ধ হয়ে হাজিরা দেওয়ার জন্য। চোখের বা মনের তৃপ্তি মেটানোর উপকরণ। সময় বিশেষে শরীরেরও। এমন একটা সমাজে যদি কোনো নারী পুরুষতান্ত্রিকতাকে চোখ রাঙায়, যদি নিজের দক্ষতায় পুরুষদের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেয়, তবে তাকে কি ছেড়ে কথা বলা যায়? এই প্রশ্নের অনিবার্য উত্তর দিতে বাথ টাউনের বাজারে শেষ প্রান্তে দলে দলে জুটেছে সকলে।
শেষ মাথার ফাঁকা জায়গাটায় মাটিতে দুটো খুঁটি পোঁতা। কাদা মাটিতে হাঁটু ভেঙে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা শরীর। দাঁড়িয়ে রয়েছে নয়, খুঁটির সঙ্গে শেকলে বাঁধা হাত দুটো তার শরীরের পতন রোধ করেছে। বিস্রস্ত বসন। শতচ্ছিন্ন ব্রিচেসের নিম্নাংশ কাদা মাখা। ওপরের পোশাকেরও প্রায় একই অবস্থা। জাসটাকোরের (নী লেংথ জ্যাকেট) ওপরে ময়লার পরত জমায় তার আসল রং বোঝা দুর্বোধ্য। বৃষ্টি ভেজা হওয়ায় শুধু গাঢ় হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। জ্যাকেটের বোতামগুলো ঘর হারা হয়েছে। ভেতরের ওয়েস্ট কোটের অবস্থাও তথৈবচ। এবং সেদিকে তাকালেই বোঝা যায় বন্দী শরীরটি কোনো মহিলার। ওয়েস্ট কোটের ছেঁড়া অংশ দিয়ে এক দিকের স্তন বেরিয়ে এসেছে। নীচে ঝুলে থাকা মাথার চুলগুলো লজ্জা আবরণের চেষ্টা করছে। মহিলাটির নাম মার্থা হার্ভে। সামুদ্রিক লুঠেরা থমাস হার্ভের স্ত্রী। শুধু স্ত্রী বলা ভুল হবে, বরং ডেপুটি বলা যেতে পারে। মার্থা নিজেও একজন সামুদ্রিক লুঠেরা। থমাসের দল লুঠের কারণে যতটা শিরোনামে এসেছিল, তার থেকেও বেশি মনযোগ কেড়েছিল মার্থার জন্য। নারী লুঠেরা! প্রথম বিস্ময় তারপর ঘৃণা এবং ক্রোধ ছড়িয়েছিল সকলের মধ্যে। গত কাল থেকে সেই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ চলছে। উৎসবের মেজাজে। বিচারকের নির্দেশ মোতাবেক তাকে ভরা বাজারে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আরও একটা দিন এভাবেই থাকবে সে। ক্রোধিত মানুষজনকে ইচ্ছেমতো পাথর, লাঠি দিয়ে আঘাত করে মনের দুঃসহ জ্বালা মেটানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। মার্থার স্বামীর জন্য অবশ্য আলাদা বিচার। থমাস হার্ভে সামুদ্রিক লুঠেরা বটে, কিন্তু তার অপরাধ সীমিত। খুব বেশিদিন হয়নি সে এই দস্যুবৃত্তিতে নেমেছে। বাথ টাউনে সকলের ধারণা তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হতে পারে। তবে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। প্রকাশ্য শান্তি জুটেছে তার কপালে। বাথ টাউনের সকল রমণীরা দেখুক। দেখে শিক্ষা নিক।
মার্থার শরীর নড়ে উঠল। দেহ জুড়ে অসহনীয় যন্ত্রণা। মুখের কয়েক জায়গায় গভীর ক্ষত। বাঁ হাতের হাড় ভেঙেছে দু'জায়গায়। সম্ভবত বাঁ পায়েরও। গলার নীচে বুকের কাছটায় জ্বালাভাব ফিরে এসেছে আবার। কেউ ধারলো ছুরি দিয়ে 'বিচ' লিখে দিয়েছে। সকালে সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল। তারপর বৃষ্টি শুরু হল। ঈশ্বরও হয়তো মার্খার সহজ মৃত্যুতে অসম্মত। চোখেমুখে জনের ঝাপটা লাগতে একটু একটু করে চেতনা ফিরে পাচ্ছিল সে। বৃষ্টির জলেই পিপাসা মিটিয়েছে। পরনের মোটা জ্যাকেট এখনও ভিজে সপসপ করছে। আরাম লাগছে। মার্থাকে নড়তে দেখে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, "হাফ র্যাট এখনো বেঁচে আছে।" কথার সঙ্গে সঙ্গে একজন দু'জন করে ভীড় ঘিরে ধরল মার্থাকে। ভীড়ের মধ্যে থেকে হেঁড়ে গলায় বলে উঠল একজন, "ভালো হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ আমোদ করা যাবে।"
একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা কাদামাখা পাথরের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে সেটা খুঁটিতে গিয়ে লাগল। মার্থা অবসন্ন মুখ তুলে সামনে তাকাল। চুলের আবরণ সরে যেতেই উন্মুক্ত হয়ে পড়ল তার ভরাট বুক। যেখানে দগদগ করছে 'বিচ' শব্দটা। আশপাশে যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, এবার তারাও জড়ো হয়েছে। ছোটো বড়ো পাথরের টুকরো সকলের হাতে। অভ্যাস করার জন্য একটা সহজ নিশানা তাদের সামনে। এ সুযোগ কেউ-ই ছাড়তে রাজি নয়।
ভিড়ের মধ্যে একটা আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ। এ দেশীয় উপজাতি শ্রেণীর। ঢোলা রঙিন পোশাক। মাথায় ফেটি বাঁধা। তাদের মাঝে সাদা চামড়ার একজন। বেমানান লাগছে। ভার্জিনিয়ার কালেক্টরকে যে রিবেল ঘোষণা করা হয়েছে একথা সমস্ত প্রদেশের অধিবাসীদের জানা। নামও শুনেছে। পিটার রোচ। ইয়র্ক সিটিতে নাকি তান্ডব চালাচ্ছে সেই উন্মাদ শ্বেতাঙ্গ। স্বজাতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছে। তার কীর্তির কথা মুখে মুখে ঘড়িয়ে পড়লেও লোকটা এখনো অধরা। কোথায় যে লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। ভার্জিনিয়ার গভর্ণর আলেক্সান্ডার স্পোটসউড তাকে হাতে পেলে জ্যান্ত চামড়া ছাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সেই উন্মাদ এবং ধুরন্ধর শত্রু এখন যে ভার্জিনিয়া ছেড়ে উত্তর ক্যারোলাইনাতে তা দুই প্রদেশের প্রধানেরই অজানা। সরকারি তরফে অবশ্য রিবেল পিটারকে খুঁজে বের করার যাবতীয় চেষ্টা জারি। তার বর্ণনা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কাছে দূরের সমস্ত গ্রাম শহরে। সৈন্যরা প্রতিটি নেটিভ আমেরিকান অধ্যুষিত এলাকা চষে ফেলছে। তবুও সেই সোনালি চুল এবং নীল চোখের রিবেল ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।
হতাশায় ঘাড় নাড়ল পিটার। তার মাথার আকর্ষণীয় সোনালী চুল উধাও। নিজের কেশহীন মাথায় হাত রেখে অস্ফুটে পাশের জনকে বলল সে, "লজ্জা হয় আচাক। এরা আবার নিজেদের সভ্য বলে দাবী করে! বর্বরতার চূড়ান্ত।"
যাকে উদ্দেশ করে কথাটা বলল, সেই আচাক একদিন পিটারের প্রাণের শত্রু হয়ে উঠেছিল। নিজের বোনের মর্মান্তিক পরিণতির জন্য দায়ী মানুষটার রক্তপানে উদগ্রীব ছিল। তাদের মাঝে মাস্টার জন হোয়াইট না এসে পড়লে, সেদিন তার হাতে পিটারের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। সে-সব অবশ্য মাস দুয়েক আগের ঘটনা। এখন সময় বদলেছে। পরিস্থিতিও। সেদিনের আচরণের জন্য আচাক আজও অনুতাপ বোধ করে। পিটারকে সে চিনতে ভুল করেছিল। বাকি শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে এক সারিতে রেখে বিচার করেছিল। আসলে মানুষটা তাদেরই একজন। কিংবা বলা যেতে পারে পিটার আসলে শুধুই মানুষের প্রতিনিধি। গায়ের রং, পেশা কিংবা কোনো নির্দিষ্ট সমাজের নয়। মানুষের ওপর অত্যাচার দেখলে ফুঁসে ওঠে। আচাক তার বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল।
দেশীয় ভাষায় মৃদু স্বরে বলল, "খবরদার। এখানে কিছু করার ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। রিবেল পিটারের নাম উত্তর ক্যারোলাইনাতেও ছড়িয়েছে। কারোর নজরে পড়লে মুশকিল।"
সামনের নিষ্ঠুর দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাল পিটার। কানে আসছে মেয়েটার আর্ত চিৎকার, "আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাও। এভাবে আর না। দয়া করো। ফাঁসিতে ঝোলাও।" জড়ো হওয়া ভিড় মেয়েটার আর্তনাদে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। নাহ্, এখান থেকে সরে যেতে হবে। এরপরে নিজের ওপরে আর নিয়ন্ত্রণ রাখা যাবে না। পিটার ঘুরে দাঁড়াল। আর তখনই তার চোখ পড়ল বাজারের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায়। একটা ঘোড়ায় টানা ক্যারেজ। ক্যারেজে দু'জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। একজন খাটো চেহারার। মাথা তার মতোই কেশহীন। পাশের জন দানবাকৃতির। মুখময় কালো দাড়ি। দাড়ির গোছা কয়েকটা বিনুনি করে সামলে রাখতে হয়েছে।
পুরু ভ্রু জোড়ার নীচে দুটো চোখে বুঝি শরীরের সমস্ত রক্ত এসে জমা হয়েছে। পরনে ঝলমলে জাসটাকোর। মাথার তিনকোনা টুপিটা পোশাকের সঙ্গে খাপ খায় না। পা বাড়িয়েও থমকে দাঁড়াল পিটার। আচাককে জিজ্ঞেস করল, "ক্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে, লোকটা কে? পোশাক, গাড়ি দেখে মনে হচ্ছে উঁচুদরের কেউ। আবার চেহারা অন্য কথা বলছে!"
আচাক তার সঙ্গীকে ইশারা করতে সে বাজারের ভীড়ে হারিয়ে গেল। অল্প সময়ের মধ্যে আবার ফিরেও এল। তাকে দেখে আচাক জিজ্ঞেস করল, "জানা গেল?"
সমীহ জাগানো সুরে জবাব এল, "ব্ল্যাকবিয়ার্ড। লুঠমার ছেড়ে দিয়ে এখন খোদ সরকার বাহাদুরের অতিথি। বাথ টাউনেই থাকে।" নামটা কানে আসতেই যেন একটা ধাক্কা খেল পিটার। এই সেই সমুদ্র শয়তান! একদিন এর খেলা শেষ করার জন্য কতই না পরিকল্পনা ছকেছিল। আজ দেখ সেই দুর্ধর্ষ লুঠেরা সরকারের প্রিয় পাত্র। আর সে, ভার্জিনিয়ার কালেক্টর স্যার পিটার রোচ থেকে রিবেল পিটার। অদৃষ্টের কি বিচিত্র পরিহাসা ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কিং'স পার্ডন নেওয়ার খবর তার জানা ছিল। কিন্তু এভাবে যে সামনা-সামনি দেখা হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি। কৌতূহল মেটাতে ক্যারেজের কাছাকাছি জমায়েতের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল পিটার। খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল সমুদ্র শয়তানকে।
"তোমার হাত গোলা সঙ্গে আছে নাকি ফিলিপ?" এডোয়ার্ডের অদ্ভুত প্রশ্নে অবাক হল টাকমাথা ফিলিস মর্টন।
"কেন টিচ্?"
"পরীক্ষা করার উপযুক্ত জায়গা খুঁজছিলে না? সামনে দেখ। বাজারের ওই ভিড়ের চেয়ে ভালো জায়গা আর দ্বিতীয়টি হয় না।"
ফিলিপকেও সামনের দৃশ্য উত্তপ্ত করে তুলেছে। এ আবার কেমন বিচার! হ্যাঁ, জলজীবনে মেয়েদের জায়গা নিয়ে বাতিক তারও আছে। কিন্তু সামনে রক্তাক্ত শরীরটা তো একটা মানুষেরই। গায়ের রং কিংবা লিঙ্গ যা-ই হোক। সাজা দিবি তো ফাঁসিতে লটকে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। নয়তো মুণ্ডু আলাদা করে দে। তা নয়, তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে মারা। এভাবে ভেড়া কিংবা শুয়োরকেও তারা মারে না। আর এ তো একটা মানুষ। গম্ভীর গলায় জবাব দিল ফিলিপ, "না হে। তবে এখন আফসোস হচ্ছে। জিনিসটা সঙ্গে থাকলে সবকটাকে ভাজা ভাজা করে দিতাম। কীভাবে পাথর ছুঁড়ে মারছে দেখ টিচ্!"
"তুমিও তো মারতে পারো ফিলিপ।"
বলে আরক্ত দৃষ্টিতে নিজের ছায়া সঙ্গীর দিকে তাকাল এডোয়ার্ড। তার কথার মানে বুঝতে খানিকটা সময় নিল ফিলিপ। 'থুঃ' শব্দে একদলা থুতু ফেলল মাটিতে। তারপর ভারী শরীর নিয়ে ক্যারেজ থেকে একটা লম্বা লাফ দিল। কাদা ছিটকে উঠে ক্যারেজের কাছাকাছি যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের পোশাকে ছোপ ফেলল। বিরক্ত মুখগুলোর দিকে তাকিয়েও দেখল না ফিলিপ। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেঁটে গেল পাথর ছুঁড়তে মত্ত ভীড়ের দিকে। যাওয়ার পথেই নীচ থেকে একটা বড়োসড়ো পাথরের টুকরো কুড়িয়ে নিল। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভীড়ের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল ফিলিপ। পাথর ধরে রাখা হাতের মুঠো শক্ত হল। ডান কাঁধটা বার দুয়েকে ঝাঁকিয়ে নিল সে। বন্ধু থমাসের মুখে যা বহুবার শুনেছে, নির্ভুল উচ্চারণে বিরবির করে বলল, "ওহ জেসাস, সেভিয়ার অব সিনফুল হিউম্যান, ফরগিভ হার। ফরগিভ মি।" কথাটা শেষ হতেই চোয়াল শক্ত করে কামানের গোলার মতো ছুঁড়ল পাখরটা। টাকমাথা ফিলিপের নিশানা নিয়ে তার বন্ধুরা গর্ব করে। এবারও সে লক্ষ্যচ্যুত হল না। সুতীব্র গতিতে কপালের ঠিক ওপরে গিয়ে পাথরটা আঘাত করতেই 'ঘট' করে একটা শব্দ কানে এল। একটু পরেই বৃষ্টিধারার মতো রক্ত ঝরতে শুরু করল হতভাগিনী দস্যুর মুখ, চুল বেয়ে। ঝুলে পড়া মাথাটা, আরও বেশি ঝুলে পড়ল। শিথিল হয়ে পড়া শরীরও। পাথর ছুঁড়তে উদ্যত কিছু মানুষ হাত নামিযে ভীষণ বিরক্তি ভরে ফিলিপকে বলল, "মোটা পালোয়ান, একটু আস্তে ছুঁড়লে কী হত?"
"দিল সব আমোদ মাটি করে।"
সত্যিই তাদের আর অপেক্ষা করার প্রয়োজন আছে কিনা খতিয়ে দেখতে দু-একজন হাতের পাথর মেয়েটার শরীর লক্ষ্য করে সজোরে ছুঁড়ে মারল। একজন এগিয়ে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে ঝুলে পড়া মাথা টেনে ধরল। তারপর চিৎকার করে বলে উঠল, "কুত্তিটা খতম। মাথার খুলি দু-ফাঁক হয়ে গেছে।"
তাদের আগ্রহ শেষ হয়েছে বুঝে নিরাশ ভীড়টা পাতলা হতে শুরু করল। কেবলমাত্র ক্যারেজের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আট জন নড়ন না। মাঝের শ্বেতাঙ্গ মানুষটার চোখে একই সঙ্গে কৌতূহল এবং তৃপ্তি খেলা করছে। "কিছু বুঝলে?"
আচাককে জিজ্ঞেস করল পিটার। ভাবলেশহীন মুখে মাথা নেড়ে 'না' বলল সে।
"রিবেল না হলে সমুদ্র শয়তানের এমন রূপ কখনও দেখার সৌভাগ্য হত না। লোকটা কি সত্যিই দস্যুতা ছেড়ে দিয়েছে?"
"সবাই তো তেমনই বলে।"
"মনে হয় না। কিংবা ছাড়লেও ভেতরের সেই আগুন আজও বেঁচে আছে। একটু উসকে দেওয়া দরকার। এক কাজ করো আচাক। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের কাছের মানুষদের সম্পর্কে খবর নাও। কে কে আছে, তারা কেমন, কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সব খবর আমাদের দরকার।"
"কেন বলো তো?"
আশ্চর্য হল আচাক।
"আগুন দরকার যে আরও। এই উপনিবেশ থেকে অমানুষদের তফাতে রাখতে গেলে আমাদের আরও আগুন দরকার। এমনকি জলেও।"
..........................
নষ্ট চাঁদের আলো
অলোক সান্যাল
..........................
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
অলংকরণ : সৌজন্য চক্রবর্তী, অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৫৯০ টাকা
সুপ্রকাশ
Comments
Post a Comment